পিতৃস্মৃতি, কিংবা মানুষের সূর্যকে চরানোর কবিতা
##
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
রোজ সকালে শিউলির ফুল আর বেলডালের ফাঁক দিয়ে
তিনি সূর্যটাকে ওঠাতেন।
পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু আমার বাবা
রোগা রোগা দুটো হাতে এমন সব নির্দেশ দিতেন-
সূর্যটার সারাদিন বিশ্রাম মিলত না।
খিদের নির্দেশে রাখালেরা ছুটে ছুটে গরুকে যেমন
পূব থেকে পশ্চিমের মাঠে নিয়ে যায়,
তেমনি করে তিনি সূর্যটাকে চরাতেন।
#
আকাশের ময়দানে, মেঘের জঙ্গলে সূর্যটাকে খেদাতে খেদাতে
তার দেখা হত রাণাঘাট লোকাল, শিয়ালদা স্টেশন,
হ্যারিসন রোড, আরও অনেক কিছুর সঙ্গে।
সূর্যকে চরানোর এই জীবিকায়
মায়ের হাতের আগুনে টগবগ করে ফুটে উঠত ভাত।
সূর্যের সঙ্গে খেলবার বা লড়বার এই প্রক্রিয়ায়
পিতার নির্দেশেই কাঁঠাল গাছের আড়ালে সূর্য অস্ত যেত।
কখনো কখনো রবিবারের কুলিয়া-বিলের কিনারে
তিনি লুকিয়ে ফেলতেন শ্রান্ত সন্ধ্যার সূর্যটাকে,
বোঝাতেন সূর্যের বিস্ফোরণ আর রঙের প্রাকৃতিক রহস্য।
তার চোখে মুখে সৎ শ্রমজীবি মানুষের প্রত্যয় ফুটে উঠত,
মনে হত, তিনিই সূর্যটার মালিক,
তার হাতে বাঁধা আছে পোষা সূর্যের সোনালি বকলস্।
রাত সাড়ে দশটায় পূবমুখী বিছানায় শুতে শুতে তিনি তৈরী হতেন
পরদিন ভোরে জাগবার, যাতে সূর্যটাকে সময়মতো জাগানো যায়।
#
এই পিতৃদেব একদিন জানু পেতে বসলেন,
সানুনয়ে দরখাস্ত দিলেন শাবক সূর্যকে।
সেই রাতে বর্ষা ছিল, জুলাই-এর নক্ষত্রেরা ছিল ছাউনির আড়ালে।
পরদিন সেই সূর্য না ওঠা সকালে
বাড়ির দিকে ছুটে এল কল্যানী লোকালের শোকার্ত হুইসেল,
উঠানে ছড়িয়ে পড়ল ডায়েরির ছেঁড়া পাতা, ডেলি প্যাসেঞ্জারির হাবিজাবি।
নিম কাটতে ফিরে এল স্তব্ধ বাহকের দল।
পূব গোয়ালের দরোজা খুলে
শিউলি আর বেলডালের ফাঁক দিয়ে
আজকের সূর্যটাকে জাগাবে কে?
#
অল্পক্ষণেই মেঘের দরোজা ভেঙ্গে মানুষজনেরা
বের করে নিয়ে এল শোকসন্তপ্ত ঘুমন্ত সূর্যকে।
আমি দেখতে পেলাম, বাবার রাখালিয়া সুখদুঃখের শাবক সাথী সেই অগ্নিপিন্ড।
মহাবিশ্বের খোলামাঠে হা-হা-রা-রা শব্দে সূর্যকে চালাচ্ছে মানুষ।
এই সূর্য পরিক্রমার মধ্যেই
শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকায় সদর্পে হেঁটে যাচ্ছেন শচীনবাবু
# #
কাব্যগ্রন্থ – পিতৃস্মৃতি, উদ্বাস্তু শিক্ষিকা ও অন্যান্য কবিতা
Photograph by - M R Naidu
Comments
Post a Comment