পঁচিশে বৈশাখের কবিতা



সমরেন্দ্র বিশ্বাস

গুরুদেব, আজ আপনাকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখতে পারলাম না-
ভোরের হেলানো রোদ এখন খাড়া, সকাল থেকে বসে আছি,
আপনাকে নিয়ে সুন্দর একটা কবিতা লিখতে চাইছি-
কিন্তু পারলাম কই ?
প্রত্যেকটি অক্ষরের শেষে কারা যেন সার বেঁধে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে,
এক একটা লাইন শেষ করার আগেই কারা যেন দড়িতে বেঁধে রেখেছে কলমের ডগা;
বাইরে মানুষের উৎপাত, ঝড়ের দাপটে বিধ্বস্ত হচ্ছে আমার মনের স্থিরতা ।
#
আজ সকালে একটা মৌন মিছিল এগিয়ে গেল,
ওদের সামনে আপনার একটা ফটো থাকা উচিৎ ছিল।
মিছিলের আগে আপনার শ্মশ্রুমন্ডিত কোনো ফটো নেই
একটা নিহত মানুষকে বয়ে নিয়ে চলেছে শকটে
মিছিলের সরীসৃপ বোধের আলোয় ঝলসাতে চাইছে-কিন্তু পারছে কই?
#
গুরুদেব, আপনি ছিলেন বিশ্বশান্তির সপক্ষে, অথচ
কাগজে হেডলাইন জুড়ে হেডলাইটের মতো জ্বলজ্বল করছে
আর্জেন্টিনার কোল ঘেঁষা ছোট্ট এক দ্বীপ-
কে কার জাহাজ ডুবিয়েছে, কে কাকে অস্ত্র দিয়ে সশস্ত্র করে তুলেছে।
#
গুরুদেব, আপনার লেখায় আলোর দীপাবলী ছিল
উজ্জ্বলতা ছিল, বিবেকের অঙ্গীকার ছিল
কিন্তু কোথায় বিবেক, কোথায় সেই আলো ?
বেলুচিতে হরিজন মরে, দিকে দিকে দাঙ্গা বাঁধে
রিলিফের গাড়ি মাঝপথে ফিরে যায়,
বন্যার লোনাজলে বাসন্তীর ঘরদোর ডুবে ডুবে জল শোষে !
#
মানুষ কি মানুষ নেই ?
হয়তো মানুষ মানুষই আছে-
নইলে বাউল আজো পীরিতের গান গায়-
নইলে পরাণমাঝি আজো দু’পয়সায় খেয়া পারাপার করে ?
মানুষ তো মানুষই-
মানুষ মানুষেরই সুখে হাসে, মানুষেরই দুঃখে কাঁদে
মানুষেরই অত্যাচারে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
কবিগুরু, আপনি অনেক মানুষের কথা ভাবতেন,
অনেক জল ঝরেছে আপনার চোখে
আপনি জালিয়ানওয়ালার হত্যা দেখেছেন, প্রতিবাদে দীপ্ত হয়েছেন,
আপনি বিলেত ঘুরেছেন,
জমিদারি করতে করতে নৌকার গলুইতে বসে কত কবিতা লিখেছেন।
#
গুরুদেব, আপনি আর কতটা করবেন-
আসলে মানুষ কিছু বোঝে না, মানুষ ভালো কথা কিছু শোনে না ।
হারাণ শেখের ছেলে তিন বছর বয়সেই ক্ষেতে খাটা ধরেছে,
হারাণ শেখ আপনাকে চেনে না, তবে নিশ্চয়ই নাম শুনেছে,
হারাণ শেখেরা নিরবচ্ছিন্ন প্রজন্ম, হারাণ শেখ কবিতা পড়ে না
শুধু ক্ষিধে বোঝে।
#
আমি হারাণ শেখ নই,
আমি কবিতা পড়ি, মাঝে মাঝে লিখিও।
অথচ গুরুদেব, আজ আপনাকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখতে পারলাম না।
মনে হচ্ছে সময়ের অস্থিরতা মানুষকে করে তুলেছে অস্থির-
আজন্মের প্রতিবাদ শ্বাপদের মতো গোপনে এগিয়ে যাচ্ছে,
মূল্যহীন মানুষগুলো কবিতার বদলে
ফুটপাথের ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে আনছে এঁটোকাঁটা,
ফুরানো পাউডারের কৌটো আর ব্যবহৃত বেলুন।
কবিগুরু, আপনি এবার বলে দিন
এখন কি করবো-
আজস্র কবিতায় এই পৃথিবীকে ভরিয়ে তুলব,
নাকি কবিতা লেখার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে
আজন্মের মতো লেগে যাবো কাজে
যাতে করে বই-এর অজস্র কবিতার বদলে
সুন্দর পৃথিবী আপন নিজস্বতায় নিজেই হয়ে ওঠে একটা কবিতা।
#
তখন পৃথিবী একটা কবিতা
ধানের দোলার পৃথিবী
কচি কাচাদের হেসে বেড়ানোর খেলে বেড়ানোর পৃথিবী
হারাণ শেখের পিদিমজ্বলা দাওয়ায় দাওয়ায় উজ্জ্বল পৃথিবী
চপল মেয়ের চকিত চোখের স্বচ্ছ্লতায় ভরা নির্ভয় এ পৃথিবী
মানুষের প্রাজ্ঞ দৃষ্টির পৃথিবী।
#
আমায় ক্ষমা করুন, গুরুদেব,
আপনাকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখতে পারলাম না।
গুরুদেব,
এখন কি অজস্র কবিতার ফেস্টুন
না কি একটা পৃথিবী, একসঙ্গে অসংখ্য মানুষ
আর তাই নিয়ে এক এবং একমাত্র বেঁচে থাকার কবিতা ।
# # #
[ ৯ই মে-১৯৮২ / কাব্যগ্রন্থ – তবু স্পন্দমান পথ ]

Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

দয়াবতী, যাও, ফিরে যাও!