সোমনাথের বাড়ি ফেরা / গল্প


সমরেন্দ্র বিশ্বাস
# এক
অনেকদিন বাদে বাড়ি ফিরছে সোমনাথ। পোষাকে আষাকে ফিট্ফাট সোমনাথের ফর্সা চেহারাটার মধ্যেও যেন একটা বিরাট পরিবর্তনের বন্যা। স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে গিয়েছিল পড়তে। প্রথম প্রথমে চিঠি আর বছরে এক আধবার বাড়ি আসা-যাওয়ার যে যোগাযোগটুকু ছিল, শেষের দুটো বছরে নিজের ব্যস্ততা আর এক ধরণের আত্মমগ্নতার জন্যে তাও কেমন করে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আবার বাড়ি ফিরছে সোমনাথ।
রোদ ভরা বিকেলে রিক্সা ছুটে আসছিল টালিগঞ্জের দিকে। রাস্তার দু’ধারে পুরোনো বাড়িগুলোর বদলে অনেক নূতন বাড়ি উঠেছে। এরই পাশাপাশি ভিতরে ফাঁকফোকরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ছোট ছোট বাসস্থানগুলি। রিক্সায়ালা নগেনকে ও চেনে। সেও আগের চেয়ে অনেক বুড়িয়ে গেছে। তার রিক্সার তেলহীন বিয়ারিং আর জীর্ণ চেন থেকে উঠে আসছে ক্লান্ত যন্ত্রনার আওয়াজ।
পেছনে মুখ ঘুরিয়ে হাসতে হাসতে নগেন বলল, ‘খোকাবাবু, বহুৎদিন পরে তোমারে দ্যাখলাম।’ ওর কথা বলতে বলতে হেসে ওঠার স্বভাবটা এ বুড়ো বয়সেও যায় নি।
সোমনাথ উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, তা বটে। পড়াশুনা শেষ হয়ে গেল, তাই কলকাতায় ফিরলাম – সত্যিই অনেকদিন বাদে।’
সোমনাথ তার পাড়ার একজন রত্ন বিশেষ। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় চার-চারটে বিষয়ে লেটার নিয়ে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল।
- ‘তা খোকাবাবু, অখন এখানে থাকবা তো?’
-‘ঠিক নেই, দেখি কি করি।’
-খোকাবাবু, সত্যি তোমাগো দ্যাখলেও সুখ। ভগবানকে বলি- তোমরা আরও বড়ো হও। আমরা মুখ্যু –সুখ্যু মানুষ, আমরা তো দ্যাশের কোন কামেই লাগলাম না। – কয়েক মুহূর্তের নীরবতা নগেনের মুখে। পর মুহূর্তে আবার খুশীতে উচ্ছ্বল হয়ে পড়ে – তোমরাই আমাগো গব্বো।
সোমনাথ সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে বিনয়ে – না! না! কী সব বলছো!
তবুও ওর মনে খুশির জোয়ার। কলেজের সমাবর্তন উৎসবের দিন আচার্য তার দীক্ষান্ত ভাষণে বলেছিলেন, ইউ আর দি ক্রীম অফ্ আওয়ার সোসাইটি … কোথাও যেন একটা গোপন অহং বোধের পরিতৃপ্তি।
মাঝপথে রিক্সাটা থামিয়ে নগেন একটা বিড়ি ধরিয়ে নেয়। সামনের গলিতে কিন্তু আগে এমন জঞ্জাল জমা ছিল না। দুর্গন্ধ, রুমালে নাক ঢাকে সোমনাথ। শহরটা সত্যি কেমন বদলে গেছে। কিন্তু এখানে ওখানে ছড়িয়ে দুনিয়ার জঞ্জাল।

# দুই
মা! – ঝুঁকে পড়ে মাকে প্রণাম করে সোমনাথ।
আবেগ জড়িত গলায় মা অবাক হয়ে বলেন,- আজই আসবি, তা আমাদের আগে থেকে তো একটু খবর দিলে পারতিস্?
বাড়ির চারদিকে, নিজের ঘরখানার দিকে তাকায় সোমনাথ। ওর মা পূর্বদিকের ভেজানো জানালাটা খুলে দেয়। সোমনাথ লক্ষ্য করে, ওর কাঠের ফ্রেমটাকে উই নষ্ট করে দিয়েছে, শিক্গুলো আল্গা হয়ে গেছে।
- দাঁড়া, তোর বাবাকে খবর পাঠাচ্ছি।
- বাবা কোথায়?
- কি আর করবে, বিকেলের দিকে ভবতোষবাবুর বই-এর দোকানে বসে গল্প-গুজব করে। রিটায়ার্ড লাইফ, এখন তো আর অফিসের ভাবনা নেই। - মা আস্তে আস্তে কথাগুলো বলে।
সোমনাথ জানে, ওর বাবা রিটায়ার্ড করেছে বেশ কয়েক বছর। তারপর বলে – মিন্টুকে দেখছি না তো, ও কোথায়? মিন্টু সোমনাথের ছোট ভাই।
- ওর আর কিছু হবে না – পাড়ার রকে বসে বসে আড্ডা মারতো। কলেজে তো আর পড়াশুনা কিছু করল না। সপ্তাহখানেক হলো ওকে মেসোর কাছে দুর্গাপুরে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওখানে ওনার জানাশোনা অনেক কোম্পানি টোম্পানি আছে, যদি কিছু করে দিতে পারে।
সোমনাথ মায়ের দিকে তাকায়। মাও যেন কেমন বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনের পরিধি, আশা আকাঙ্খাগুলোও সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। তার ভাঁজপড়া চামড়ার নিচে যে চোখদুটো মিট্মিট্ করছে, আগে উজ্জ্বল হয়ে সেটা জ্বলতো – সেই আলোতে ভর করেই গড়ে উঠেছে সোমনাথের ভবিষ্যত। আজকে সে চোখের দৃষ্টি কেমন পান্ডুর। জীবনের সব তাগিদই কি ফুরিয়ে গেছে?
সোমনাথ অ্যাটাচি কেস্টা তুলে রাখে। জামাটা কাঠের হ্যাঙ্গারে রাখতে রাখতে চোখে পড়ে মাথার উপর তার প্রিয় বিবেকানন্দের ফটোটা ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে – বিবেকের বিবেক ঢাকা পড়েছে কালো ধোঁয়ার আবরণে – যে আবরণ কাঁচের উপর জমা হয়েছে দৈনন্দিন জীবনের প্রাত্যহিকতায়।

# তিন
- সোম, কখন এলি?
- এই তো এই মাত্রই। তোমার চেহারাটা কিন্তু ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে বাবা!
- আর খারাপ!
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সে নীরবতা পলেস্তারা খসা দেয়ালের উপর পড়া ষাট ওয়াটের বালবের আলোয় মিলেমিশে কেমন যেন একটা অনুভূতির সৃষ্টি করল। জীবনের অস্বস্তিময় কঙ্কাল তার অস্তিত্ত্বকে অসহ্য নীরবতায় যেন বিহ্বল করে দিতে চাইল।
- রঞ্জুদার খবর কিছু?
রঞ্জিত রায়, সোমনাথের বড় দাদা; রাজনৈতিক নেতা, পলাতক। পুলিশ এখনো তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
অবশ্য সোমনাথ অন্য দলের ছেলে। রাজনীতিকে যারা বাউন্ডুলে মনের উদ্দামতা মনে করে। অথচ রঞ্জিত সোমনাথের চরিত্রের বিপরীত মরুপ্রান্তের অধিবাসী এবং এমন দলের যারা স্বচ্ছল ক্যারিয়ারটাকে খোলামকুচির মতো পায়ের তলায় ঠেলে জীবনের তাগিদে প্রতিবাদী শিরদাঁড়াটাকে সোজা রেখে ছুটতে পারে মাইলের পর মাইল।
আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সোমনাথের বাবা জিজ্ঞেস করে, – তোদের কলেজের বন্ধুবান্ধবদের অনেকের কি চাকরি-টাকরি হচ্ছে?
বাবার এই প্রশ্নে একটু অবাক হয় সোমনাথ। সবে মাত্র তো ফিরেছে। এতো তাড়াতাড়ি চাকরির তাগাদা? সোমনাথের একটা চাকরি জুটিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাতেও কি বাড়ির লোকেদের বিশ্বাস নেই?
রাগ গোপন করে একরকম মোলায়েম সুরে সোমনাথ বলে,- জানো তো, আমাদের দেশে কত লক্ষ বেকার! বল্লেই কি আর চাকরি মেলে। তবে পাশ যখন করেছি, চাকরি একটা পাবই। চিন্তা কোরোনা।
বাবা স্থবির চোখ মেলে সোমনাথকে দেখতে থাকে। অবশেষে বলে,- সোম, এবার একটু বিশ্রাম করে নে। অনেক তো ধকল গেছে।
একসময় বাবা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। একা ঘরে সোমনাথ বসে থাকে। কোথায় যেন বারবার ঘটে যাচ্ছে একটা ছন্দপতন। তার পরিচিত পরিবেশটা কেমন অপরিচিত হয়ে উঠেছে সময়ের ব্যবধানে।
ঘরের পলেস্তারা খসা দেয়াল তার দিকে তাকিয়ে যেন চিৎকার করতে চায়। অসহ্য! ভেতরে একটা দাহ অনুভব করতে থাকে সোমনাথ। ষাট পাওয়ারের বাল্বটার চোখে ঠুলি পরিয়ে একটা কালো অন্ধকার তার দিকে পা বাড়িয়ে আসে। ভেতরে ভেতরে বেদনার্ত বেড়ালের গোঙানির শব্দ। কেন এমন হয়?

# চার
নন্দা সোমনাথের দিদি। এই অর্থকষ্টের দিনে তাকেও চাকুরি নিতে হয়েছে, একটা প্রাইভেট ফার্মে। মাইনে-পত্তর মোটামুটি। নন্দা অফিস থেকে ফিরল।
- ভাইয়া! ভাইয়া! – প্রায় চিৎকার করতে করতে নন্দা ঘরে ঢুকলো। আবেগরুদ্ধ ওর স্বর- আনন্দে উত্তেজনাময়। মুখে টুকরো হাসি – স্থির তাকিয়ে রইল সোমনাথের দিকে।
- অমন হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন? - সোমনাথ হাসল।
- তোকে দেখছি!
দিদি আগের চাইতে অনেক বেশি স্মার্ট হয়েছে, চাকরি করার দৌলতে চেহারাটাও খুলেছে।
- যাক, এত্তোদিনে তবে বাড়ির কথা মনে পড়ল। আমরা তো ভেবেছিলাম–
- যাঃ বাব্বা! তোরা আমার কোর্সটাও কমপ্লিট করতে দিবি না!
ছোটবেলার থেকেই ওদের দুজনের বেশ জমে। নন্দা স্পষ্ট কথার ব্যাপারে চিরদিনই ট্যাক্সহীন, আর এই কারণেই ভাইয়ার সঙ্গে ওর লাগে বেশী।
কিছুক্ষণ পরে শাড়ি পাল্টে নন্দা ঢুকল সোমনাথের ঘরে। হাতে জলখাবার।
- ভাইয়া, আমাকে আজ এখন একটু বেরোতে হবে কাজে।
সন্ধ্যা সাতটা। সোমনাথ অবাক হয় – এখন কি কাজ?
- আমাদের জি এম এর বাড়িতে একটা পার্টি আছে। আর বুঝিসই তো, চাকুরি করতে গেলে এসব একটু আধটু করতে হয়, নইলে চলে না।
সোমনাথ বলে,- দিদি তোর চাকরিটা খুব ‘সফিস্টিকেটেড’?
নন্দার মুখের চেহারা কি একটুও পাল্টায় নি? ম্লান হেসে নন্দা বলে, - তুই কি বুঝবি? - গভর্ণমেন্টের টাকায় খরচ চালিয়েছিস। কখনো ভেবেছিস বাড়ির কথা কিছু? কি করে আমাদের দিন চলতো?
সপাং সপাং করে বেত পড়ল সোমনাথের পিঠে। নন্দা বেরিয়ে গেল। সবাই কেমন যেন সেন্টিমেন্টাল হয়ে উঠেছে। তার মনে হল, সদ্য ফেলে আসা বাইরের কলেজের দিনগুলো অনেক ভাল ছিল। মশা গুন্গুন্ করছে। ওদিকে পুকুরটা রাবিশ দিয়ে ভরা হয়েছে। নাঃ, একটু বেড়িয়ে আসতে হবে।

# পাঁচ
ট্রাঙ্ক-কম্বল নিয়ে পড়াশুনার জন্যে ভিন প্রদেশে যাত্রা করার ঠিক আগের দিনের সন্ধ্যায় পাখির সান্ধ্যকালীন ডানা ঝাপটানোর ব্যকুলতা নিয়ে অরুণার যে দীর্ঘশ্বাস আছড়ে পড়েছিল সোমনাথের বুকে, তার স্পর্শ এই সুদীর্ঘ বছরগুলির ব্যবধানেও অনুভব করতে পারে সে। এই মুহূর্তের পৃথিবীটাকে মনে হয় যেন ছন্নছাড়া। আজকের এই ছন্নছাড়া পৃথিবীতে অরুণা যেন তার কাছে দূরাগত সমুদ্রের গান। এই অসহিষ্ণু পৃথিবীতে দাঁডিয়ে অরুণার কাছে তার অনেক প্রত্যাশা।
দেয়ালে টানানো অরুণার ফটোটা – ওর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর তোলা – সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সোমনাথ। চা আর ঘরে বানানো কিছু খাবার, প্লেটে নিয়ে ঘরে ঢোকে অরুণা।
- এতো তাড়াহুড়ো করে এসব করার কোন মানেই ছিল না!
- দেখছিলাম, এই দীর্ঘদিন বাদে তোমার দিকে চা বাড়িয়ে দিতে দিতে আগেকার সেই হার্ট থ্রোবিংসটা ফিল করি কিনা – সোল্লাসে হেসে ওঠে অরুণা।
- তুমি কিন্তু একটুও পাল্টাও নি।
গম্ভীর হয় অরুণা। সে বলে, তোমার কাছে হয়তো পাল্টাই নি, আজকের পৃথিবীর কাছে আমি নিজেকে অনেক পাল্টে নিয়েছি, আর তারই জন্যে আমার চোখে পুরোপুরি পাল্টে যেতে বসেছে মানুষের পৃথিবীটা।
- কলেজে খুব ইউনিয়ন-সংস্কৃতি-রাজনীতি এসব করে বেরাচ্ছো এখনো? তোমাদের যতসব ক্ষ্যাপামি!
- আসলে আমরা কেউই তো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নই! - ধীরে ধীরে বলে চলে অরুণা – জানো সোমনাথ, আজকের পৃথিবীটায় প্রেম ভালোবাসা সব কিছুই যেন অর্থহীন হয়ে গেছে, সামাজিক অস্বাস্থ্য সরীসৃপের মতো দিনে দিনে গিলে ফেলছে মানুষের শুভচেতনা।
মৃদু ভঙ্গিমায় কথা বলার ফাঁকে অরুণার চোখ দুটো কি একটুও আলো দেয়নি? এখানেও একটা প্রচন্ড দাহ কোথায় যেন লুকিয়ে।
আজকের পৃথিবী অরুণাকে কোথায় টেনে নিয়ে গেছে – ওর চোখে জ্বলছে চেতনার আগুন! বাঁচতে চাওয়া কি পাপ? সুন্দরের স্বপ্ন দেখা কি সামাজিক অপরাধ? সুস্থ জীবনের প্রয়োজনে শহরে বন্দরে আগুন ছড়ানো কি গুন্ডামি?
অথচ এসব কোনো দিন চিন্তা করেনি সোমনাথ – সুযোগ বা পরিবেশ কোনটাই অবশ্য আসেনি।
সোমনাথ এই মুহূর্তে কিছুটা আবিষ্কার করতে পারছে, অরুণার চোখের শুভ্রতায় জীবনের আলো।

# ছয়
অরুণার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নির্জন পথ ধরে হাঁটতে লাগল সোমনাথ। প্রাগৈতিহাসিক পান্ডুরতা নিয়ে রাস্তার ল্যাম্পগুলো যেন আলো বিকোচ্ছে। কোন জরাজীর্ণ সমাজের প্রতিচ্ছবির মতো রাস্তাটা উলঙ্গ। প্রেতায়িত পথে দুলতে দুলতে এগোচ্ছে তার ছায়াটা।
হঠাৎ ভয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সোমনাথ। কী বীভৎস চেহারা! হাঁটু পর্যন্ত তোলা কাপড়, দাঁতগুলো মুখগহ্বর থেকে বেরিয়ে পড়েছে; কোলে একটা চটের ব্যাগ নিয়ে এগোচ্ছিল – হঠাৎ এই মূর্তিটা সোমনাথের রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভজনের মা না? এ কী চেহারা হয়েছে তার? সোমনাথ প্রথমে চিনতে পারে নি তাকে।
পাশ কাটিয়ে চলে যেত সোমনাথ। কিন্তু পারল না – বুড়ির চোখ দুটো নির্বোধ আসামীর মতো শ্বাস ছাড়ছে যেন।
একটা অবিশ্বাসের চাহিনি নিয়ে মুর্তিটি জিজ্ঞেস করে – এট্টা কথা জিগামু?
- আপনি কি রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না?
- মোরে এট্টা কাম দেবেন? যে কোন কাম – মুই ভাল বাসন মাজতে পারি, ভাল রান্তে পারি, পোলা–মাইয়্যা পালনের কামও পারি।- গড়গড় করে মুখস্ত বলে গেল। কোথাও একটুও আটকালো না।
আজকাল পথে যাকে দেখে তাকেই ধরে কাজের জন্যে। চরম দারিদ্র্যে ভুগতে ভুগতে আজ ভজনের মা এক মানসিক বিকৃতির শিকার!
বুড়ির চোখে তো একটুও জল নেই! অথচ ওর ছেলে ভজনকেই তো কারা এক সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছে, মাংস কুচি কুচি করে কেটে বস্তায় ভরে ডুবিয়ে দিয়েছে বিলে, কদিন পর বস্তা ভেসে উঠেছে …… ! ওসব নিয়ে আজ আর কোন অনুযোগ নেই ভজনের মা’র! সত্যিই কি বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু মাত্র কয়েক বছর?
ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় ভজনের মা’র ছায়া পড়েছে রাস্তায়। থেকে থেকে সেটা নড়ে চড়ে উঠছে। একধারে জীর্ণ পাঁচিলের পাশ ঘেষে চলে গেছে নর্দমা। কিছু বিছুটি গাছ গজিয়েছে পাঁচিলের গোড়ায়। বুড়িটার বেরিয়ে পড়া সামনের লম্বা দাঁত কটি আরো ভয়াবহ মনে হচ্ছে, এই কৃপণ আলোর ভৌতিকতায়! দূরে কোন একটা সুখী বাড়ির দোতালায় এত অল্প রাতেই সবুজ বাতি জ্বলছে।
বুড়ি আবার বলে - মোরে এট্টা কাম দেবেন? যে কোন কাম – মুই ……
পাশ কাটিয়ে সরে আসতে আসতে সোমনাথের মুখ থেকে কি একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে – সে আওয়াজ শোনা যায় কি? যায় না!

# সাত
জীবনটা কি এই ছিল? এরই জন্যে কি এতটা প্রস্তুতি? এরই জন্যে কি এতগুলো পরীক্ষায় পাশ করে চাকুরী খোঁজা? রাতের নির্জন পথ ধরে সোমনাথ ছুটে চলে। দপ্দপ্ করছে তার শিরাগুলো।
দেয়াল, বাড়িঘর, ল্যাম্পপোষ্ট, সব কিছুই একে একে পেছনে ছিট্কে পড়ছে। স্কীড করা ফ্লিমের মতো দ্রুত সরে যাচ্ছে সব কিছু। অনেকদিন পর এখানে এসে সোমনাথ রায় এই কোলকাতার আধো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ছুটে চলছে। চলছে আর ঘামছে। ঘামছে আর চলছে।
পথ চলতে চলতে তার মনে পড়ে গেল রিক্সায়ালা নগেনকে। তার মা – বাবা – ছোট ভাই মিন্টু, দিদি নন্দা – তাদের বাড়ির অসচ্ছল অবস্থা – তার ফেরার দাদা রঞ্জিত রায় – ভজনের মা’র কুৎসিত চেহারাটা! আজ ওদের সবার সঙ্গে কেমন একটা বিরাট ব্যবধান গড়ে উঠেছে সোমনাথের। ওরা কি সবাই তাকে আলাদা পৃথিবীর মানুষ ভাবে?
অরুণার চোখের ঠিক্রে ওঠা দাহ এই মুহূর্তে আরো বেশি করে বোধগম্য হয়, অরুণা চায় আলো জ্বালতে। হয়তো ও-ই ঠিক।
পরিত্যক্ত রাতের নির্জন একটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সোমনাথ। এই মুহূর্তে তার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে – বাবা, মা- এই পৃথিবীতে তোমাদের বাঁচতেই হবে। এই মুহূর্তে তার মনে হয়, রঞ্জিত রায়ের জীবনটা এখনো ব্যর্থ হয়ে যায়নি। এই মুহূর্তে অরুণার পাশে দাঁডিয়ে বলতে ইচ্ছে হয় – তোমাদের দলে আমিও আছি।
পৃথিবীর কাঁধে শব। জীবনকে এই গোরনিদ্রা থেকে সে কি জাগিয়ে তুলতে পারে না?
একবার কারা যেন পরিসংখ্যান করেছিল – পৃথিবীতে কত কোটি মানুষ এই উন্নত সভ্যতার যুগেও না খেয়ে দিন কাটায়। সভ্যতা যতই সুউচ্চ হোক না কেন, তারই আড়ালে অজস্র মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আমাদের কি এখনো অসভ্য করে রাখে নি?
সোমনাথ দ্রুত হেঁটে চলে। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছে, সে শুনতে পাচ্ছে, চার ধারের ইট কাঠ পাথরের শিরায় শিরায় রক্তের গান – তার মনে হচ্ছে এই প্রেতায়িত অন্ধকার সে একটুও ভয় পায় না।
রাত বাড়ছে। অন্ধকারের নির্জনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগীর মতো ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ছে সভ্যতা। দূরে টিভি টাওয়ারের উপর জ্বলছে সিগন্যাল বাতি। এই সভ্যতার ওপরই আছড়ে পড়বে আগামী দিনের সূর্যোদয়।
সোমনাথ বাড়ি ফিরছে। বাড়ির লোকজন হয়তো না খেয়েই বসে আছে তার জন্যে।
# # #

[ ভারত-বাংলাদেশের নির্বাচিত গল্প সংকলন
/ আজকের অনুভব প্রকাশনা]
Pictures Taken from Internet.
/ Courtesy - Edvard M U N C H [The Anxiety- 1894]

Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

হীরাকুদ, উৎপল সেন ও আমাদের অগ্রজেরা