হাওয়া শিকার




সমরেন্দ্র বিশ্বাস
#

হিম্মতের চাইতে আর বড় অস্ত্র কিই বা হতে পারে? পৃথিবীটাকে সুন্দর করবার জন্যেই মানুষের এই সর্বাত্মক অভিযান, এই হাওয়া শিকারের কাহিনী
#
চলমান পাটাতনে চুমু খাচ্ছে হাওয়া
ঝিক্মিক্রোদ্দুরেরা জলস্রোতে রেখে যায় তীব্র অঙ্গীকার
শকুনেরা ঝাপটায় ডানা, ভেসে যায় এই জলযান
#
এবার দেখুন একটি যুবককে লঞ্চের পাটাতনে বসে একান্তই দার্শনিক তার দৃষ্টি আসুন, এই যুবকটির সঙ্গে আমরা ভ্রমণে বের হই, হাওয়ার গতিপথকে জরিপ করি
#
পকেটের ফুটো বেয়ে যৌবনের দিনগুলি পড়ে আছে পথে
অবেলার জীর্ণ শীর্ণ পোষাকেরা ধরে রাখে খিন্ন স্মৃতি
আসহায় যুবকটি লঞ্চের পাটাতনে চলেছে কোথায়?
#
সামনেই টাল খাচ্ছে কিছু গাঙ্পাখি
বহুদূরে তীরভূমি, আরো দূরে গ্রামগুলি যেন তার
                       অস্পষ্ট ইশারা,
দুচোখে পাণ্ডুর ক্লান্তি, দুচোখে অশেষ আশা
যুবক চলেছে হাওয়ার সন্ধানে!
#
 এই হাওয়াকে খোঁজবার, এই হাওয়াকে পোষ মানাবার ইতিহাস বড় পুরাণো মানুষ পছন্দ করে না প্রকৃতির প্রতিরোধ, মানুষের অত্যাচার তাই মানুষেরাই হাওয়াকে নিজের কোলে টানে, নিয়ন্ত্রণ-দখলের দলিলে সই করে
#
হাওয়া খুঁজতে যুবক চলেছে
হাওয়া প্রত্যেকটা মানুষের হৃৎপিন্ডে ধুকপুক করে
হাওয়া ঝড়ে-ঝঞ্ঝায় ভাসিয়ে নেয় যত আবর্জনা
হাওয়া বন্বন্করে ঘোরায় উইন্ড মিলের ডানা
হাওয়ায় হাওয়ায় গ্রামে গ্রামে জেগে ওঠে
         নবান্নের ঘ্রাণ, ভেসে যায় অত্যাচারী খুন
#
চলমান পাটাতনে বসে যুবকের হাড়-মাস কালি হলো
#
ছোটখাটো লোনা ঢেউ, আকাশে প্রহরী চিল
গাঙ্ফড়িং উড়ে এসে বসে স্থির কাঠে
একমনে যুবকটি স্তব্ধ বসে ভাবে
মুক্তিকামী মানুষ কেন আজ হিম সাদা ঘোড়া!
#
হাওয়ার শরীরে ইতিহাসের গন্ধ
হাওয়ার শরীরে ব্যাবিলনের ওড়না
হাওয়ার শরীরে হোয়াংহোর দুঃখ
হাওয়ার শরীরে পেট্রোগ্রাডের গর্জন
হাওয়াই মানুষকে বয়ে নিয়ে যায় এক সময় থেকে
                          অন্য সময়ে,
হাওয়া নবজাতকের ফুসফুসে জোগায় শক্তি,
তোলপাড় হয়ে ওঠে প্রত্যন্ত প্রদেশ, জল মাটি আকাশ
#
একটি দূরবর্তী গ্রামে অবশেষে জলযানটি যুবককে পৌঁছে দিল আসুন, আমরাও যুবকের সঙ্গে লঞ্চ থেকে নেমে গ্রামের পথ ধরে আরো এগিয়ে যাই
সেই গ্রামে কোন পূজা ছিল না তবুও ঢ্যাম্কুড়াকুড় বাদ্যি বাজলো, কিছু ধানের জমি দখল হলো, কিছু মাছের ভেড়ী লুট হলো অতঃপর গ্রামের লোকেরা বেরিয়ে এসে বললো,
-শিকারে যাচ্ছি!
-কি শিকার?
-হাওয়া শিকার হাওয়াকে পোষ মানাতে
কেউ গাইলো :
হাওয়া আমার ভাইরে
হাওয়া আমার বোন রে
হাওয়া মোদের শক্তি
হাওয়া আমার গান রে
কেউ বললো :
হাওয়াকে আমরা বাঁধবো
কিন্তু মারবো না
হাওয়াকে আমরা বাঁচাবো
এবং গান শেখাবো,
হাওয়া তখন ধানের শীষের মতো
হাওয়া তখন চাঁদের আলোর মতো
যেন আমাদের ঘরের উঠোনে স্বরচিত আলপনা
#
সেই গ্রামটির খোলা আঙ্গিনায় নাচ হলো, গান হলো পরিশ্রম হলো, আগামীর জন্যে জমি কর্ষিত হলো, মাটিতে মাটিতে বীজ় রোপিত হলো, ইতিহাস পড়া হলো, নৃতত্ব নিয়ে আলোচনা হলো এবং শ্লোগানের মতো আকাশে বাতাসে উচ্চারিত হলো :
আমরা মানুষ
আমরা বাঁচি অধিকারে
আমরা বাঁচি শ্রমে ও প্রেমে
যুবকটি দাঁড়িয়ে দেখলো, বাতাসে লেগেছে আন্দোলন
#
হাওয়া,
মানুষের ইচ্ছার অণুতে বাঁধা তোমার শরীর
হাওয়া,
আমাদের ইচ্ছা নিয়ে তুমি তোলপাড় উড়ে যাও-
নিরাময় হোক যত পুরাতন ব্যথা
#
হাওয়া গ্রাম ছাড়িয়ে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়লো এই হাওয়া একের পর এক পেরিয়ে গেল গ্রাম, জঙ্গল, টিলা, নদী অবশেষে জেটি ছুঁয়ে হাওয়া ঢুকলো শহরে হাওয়া কাঁপিয়ে দিল নগরের অট্টালিকা, উঁচু চিমনীর ধোঁয়া, বস্তীর মানুষের উল্লাস কয়লা খদানের এক বুড়ো শ্রমিক গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ফিক্ফিক্করে হাসতে লাগলো সামনের প্রাচীরে আলকাতরার লেখায় হাওয়া এসে ঝাপ্টে পড়লো – ‘হাওয়া দিয়ে দুনিয়াকে ঘেরো
#
দশক কিংবা শতকের ক্যালেণ্ডারে আঙ্গুল দিয়ে যুবকটি এখনই কোন ভবিষৎ বাণী করতে পারে না তবুও চোখের সামনে সে স্পষ্ট দেখতে পায় ভবিষ্যতের ছবি মানুষেরা দলে দলে বেরিয়েছে হাওয়াকে বাঁধতে হাওয়া বইছে প্রচণ্ড বেগে! এই হাওয়াই নাড়িয়ে দিচ্ছে স্থাণুবৎ সময়, কাঁপিয়ে দিচ্ছে প্রত্যেকটি মানুষের এযাবৎ অবস্থান!
[ কাব্যগ্রন্থ - হাওয়া শিকার (প্রকাশ-1995)]



Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

দয়াবতী, যাও, ফিরে যাও!