আমার কবিতা ভাবনা
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
উদ্বাস্তু কলোনীর ছেলে, কেরোসিন তেলের লাইন, রেশন দোকানের ভারী ব্যাগ,
কলতলার বারোয়ারী গুলতানি। এসবের মধ্য দিয়ে শৈশব কাটিয়ে
কৈশোর। পাড়ার মঞ্চে পঁচিশে বৈশাখে
কবিতা শুনতাম –‘এ
তো বড় রঙ্গ, জাদু, এ তো বড় রঙ্গ’
; নাহলে আবেগময় গলার আবৃত্তি
- ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর …… ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা,
আঘাতে আঘাত কর্ ……’ । এরই মধ্যে নিজের অজান্তে কখন
যে কবিতাকে ভালো লেগে গেলো, নিজেই জানি না। আমার চারদিকে না-এলিট , প্রায় একটা অকাব্যিক পরিবেশ। এরই মধ্যে কখন যে লুকিয়ে লুকিয়ে
কবিতা লেখা শুরু করলাম! আমার ক্লাস সেভেন বা এইট
– স্কুলে পড়াতে এলেন শুভঙ্কর ঘোষ (সাহিত্যিক,
ও পরবর্তী সময়ে স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যাপক)। দেখলাম, তিনি এসব কবিতা-টবিতা লেখাকে উৎসাহ দিতেন, বলা যায় আমার লেখা-লেখির জীবনে অবশ্যই তিনি এক প্রধান
প্রেরণা। কবি
হিসেবে তখনই স্কুল ম্যাগাজিনে সামান্য আত্মপ্রকাশ। এদিকে নিজেদের মফস্বল পাড়াতেও
কয়েকজন মিলে শুরু করলাম দেয়াল ম্যাগাজিন।
পাড়ায়
বাচ্চাদের সরস্বতী পূজার পয়সা বাঁচিয়ে সেবার ছাপা হলো ‘উদয়ের পথে’ পত্রিকা। নিজেরাই নিজেদের লেখা ছাপলাম। সময় এগিয়ে যায়। স্কুল পেরিয়ে চলে এলাম ইঞ্জিনীয়ানিং
কলেজ
– যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। তখন আমি কিছু কলেজ বন্ধুর কাছে ‘কোপ্তে’-লেখা সমর, মানে আমি ‘কবিতা’ লিখি, কিছুটা ব্যঙ্গ,
নিজস্ব হীনমন্যতা- এসব আর কি! এমনি ভাবেই আমার কবিতা লেখার শুরুয়াত।
কিছু মানুষের এই কাব্যপ্রীতি - কেন এই সাহিত্যসাধনা? নিজস্ব দিনযাপনের রুটিন মাফিক কাজের
সাথে সাথে মানুষ তার ভেতরের সক্রিয়তা ও শিল্পীসত্ত্বাকে প্রকাশ করার জন্য কোন না কোন
উপায় খোঁজে। কেউ
গান গায়,
ছবি আঁকে, কেউ সাহিত্যচেষ্টা করে, এম্নি কেউ তাস খেলে, উদোম ফুটবল মাঠে দৌড়ায় । এগুলো জীবনের অন্য কিছু অতিরিক্ত
ডায়মেনশন। আমার ক্ষেত্রে সেটা বইপড়া, কবিতা লেখা।
কিশোর বয়স থেকেই আমি বেছে
নিয়েছি বই, কমিকস, খবর কাগজ। তখন থেকেই লেখালেখিতে মস্কো। কম কথা বলা মানুষের জন্যে সাহিত্য
বা কবিতাই ঠিক। বিশেষতঃ আমার মতো মতো মানুষ – দুটো কথা মুখ থেকে বের করতে গেলে যার বুক দুরুদুরু করে কাঁপতে থাকে।
আমার কৈশোর দেখেছে দারিদ্র। খাবার অভাব। প্রতিবেশী ছেলেমেয়েগুলোর দুর্গাপূজায় নতুন জামা কাপড় হয় না, ছেড়া ফাটা জামা পরে ঘোরে, মন্ডপে আগমনী সুর কেমন বেমানান
ঠেকে! আবার দেখি, সামান্য কিছুটা চাল বা
গমের জন্যে রেশন দোকানের ভীষণ ভীড়, ঠ্যালাঠেলি, বাক-বিতন্ডা। ট্রেনে চাল পাচার করতে গিয়ে আমাদের
পাড়ারই ডাকাবুকো ছেলেটা লোকাল ট্রেনের চাক্কায় পিষে গেল! তারই মধ্যে মিছিল, রাজনৈতিক খুন-খারাপি! তাই কখনো কখনো কবিতা আমার কাছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের
উপায়। সেটা আমার না-বলতে পারা কন্ঠস্বর! কখনো কবিতা আমার না বলতে পারা প্রেম!
কবিতা কেন লিখি? –
এককথায় লিখতে ভালো লাগে বলে। কোন কথা সামনা সামনি কাউকে বুঝিয়ে
বলতে পারি না, যেসব গম্ভীর কথা কত সহজেই কবিতায় বলা হয়ে যায়। কবিতা লিখতে লিখতে আলোছায়ায় কত
কথা বার্তা চলে।
জীবনানন্দ বলেছেন, -
সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। আমার তখন মনে হতো সক্কলেই কবি। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কিছু
না কিছু কবিতা আছে। তার
প্রকাশ পরিস্থিতি সাপেক্ষ। আমার
কলেজ-লাইফের রাজনৈতিক বাতাবরণে একটা বিশ্বাস আমার জন্মেছিলো – কবিতা শিল্পের জন্যে নয়, কবিতা মানুষের জন্যে। শিল্প দিয়ে কি হবে, যদি মানুষকে না বাঁচানো যায়।
তখন
কিছু শ্লোগান ধর্মী কবিতার লাইন লিখে ফেলেছিলাম। তা ছাপাও হয়েছিলো।
ধীরে ধীরে অবশ্য কবিতা
সম্পর্কে আমার এইসব ধারণা অনেকটা পাল্টেছে।
জীবনানন্দর
বনলতা সেনকে বোঝার চেষ্টা করেছি, আবেগবিদ্ধ হয়েছি। সেই সঙ্গে পকেটে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘চিমনির মুখে শোন সাইরেণ-শঙ্খ, গান
গায় হাতুড়ি ও কাস্তে’ কিংবা ‘ফুল ফুটুক
না ফুটুক/ আজ বসন্ত’-কে বুক পকেটে নিয়ে
ঘুরেছি। পরবর্তী
সময়ে আমার অগ্রজ ও সমসাময়িক কবিদের পড়তে পড়তে অনেক কিছু জেনেছি।
পেশাগত ভাবে আমি ইঞ্জিনীয়ার। সেই অর্থে সাহিত্যের পেশাগত শিক্ষা
আমার নেই। কবিতার
ভূগোল,
কবিতার ব্যাকরণ আমার থেকে দূরে দূরেই থাকে। সেই জন্যেই বলা যায়, আমি উড়ে এসে জুড়ে বসা এক লেখক বা কবি! এ জন্যেই আমার
প্রথম জীবনের কবিতার প্রকাশ সোজা সাপ্টা কথায়। যদিও পরে বুঝেছি, সংবাদ কখনো সাহিত্য বা কাব্য হয় না। কবিতার মধ্যে নিজস্ব আবেগ ও অনুভূতি
জুড়তে হবে। কথার
মধ্যে কল্পনার রঙ মেলাতে হবে। কবিতাকে
হয়ে ওঠার মতো পোষাক আষাক পরাতে হবে। যেমন –শব্দ। কল্পনা। আবেগ। মনন
। প্রতীক
ও উপমার আবরণ। ইমেজ
বা চিত্রকল্প। তবেই লেখা হয়ে উঠবে কবিতা।
কেউ কেউ বলে কবিতার কোন শাস্ত্র নেই। কবিতার তেমন মানে বা বক্তব্য
থাকাও কোন জরুরী কিছু না। একথা
কখনো মেনেছি, কিন্তু সব সময় মেনে নিতে পারিনি।
যদিও সমস্ত ব্যাকরণকে
বাদ দিয়েই আমি কবিতাকে খুঁজে বেড়িয়েছি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে । তাই স্টীল প্লান্টের নাইট শিফট
ডিউটিতে জ্বলন্ত ফার্ণেস আর ঘামে ভেজা কুলি কামিনের মুখ আমার কবিতায় মোচড়
খায়। আমার
কবিতায় নিরাপত্তাহীন মজদুরের দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। কালিঝুলি মাখা মকবুল মিস্ত্রীর
কথা আমার কলমে উঠে আসে, তার কতটা কবিতা , কতটা নয় – বুঝে উঠতে পারিনা। ফুটপাতে বসে থাকা মানুষের ক্ষিধে
আমাকে ক্লান্ত করে। পশ্চিমবঙ্গে
আমার কৈশোরের সামনেই ঘটে গেছে সত্তর দশকের কম্যুনিষ্ট আন্দোলন। তাও আমার লেখায় প্রভাব ফেলে। সেই সব দুঃস্বপ্নের দিন, সেইসব রক্তের ছিটে ফোটা কবিতায় উঠে আসে। কবিতা লিখি , প্রশাসনের নিপীড়ন আমার ভাবনাকে ধাক্কা দেয়। আমি প্রভাবিত হই। চারপাশে বন্ধ কলকারখানা, শুখা খেত, মানুষের দিনানুদিনের কষ্টকর ক্লান্তিময় জীবন
আমার কবিতায় মিশে যায়। এমনি ভাবেই চারপাশের পরিচিত জগত, প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষজনও কবিতায় চলে আসে। নীরবে কাউকে ভালোবেসে ফেলি, প্রেমে পড়ি – সেসব কথাও কবিতা হয়ে আমার খাতায় লুকিয়ে থাকে।
কবিতা ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’ হলেও, সেটা অন্ধকার কোন মহাজাগতিক কিছু নয়। সে অন্ধকার আমাদেরই অন্তর্মনে, আমাদেরই পৃথিবীতে, জলে স্থলে আকাশে,
প্রতিটি জীবনে, আমাদের অভিজ্ঞতায় লুকিয়ে বেড়ায়।
একটা স্ফুলিঙ্গ থেকেই
আমার কবিতারা আসে। স্ফুলিঙ্গটা
মনে এলেই ঝড় ওঠে। জ্বলে
ওঠে ফসফরাসের আগুন।
ধীরে ধীরে কবিতা লেখা হয়। লেখার পরে ভেবে অবাক হই, একটা ছোট্ট দৃশ্য, একটা সামান্য ভাবনা, একটা ছোট্ট লাইন । একটা
স্পার্কের মতোই একটুখানি আগুন। সেটাই
কেমন একটা কবিতার জন্ম দিয়েছে। একটা
কবিতা লেখার পর সংশয়। যদিও
মনটা হাল্কা লাগে, কিছুতো লিখলাম সেটা ভেবে মনে একটা
প্রশান্তি। বিবেক
পরিতৃপ্ত হয়। আমার
কোনো কবিতা যদি অন্যের অনুভূতি ও ইমাজিনেশনকে ছুঁয়ে যায়, অন্যের ভাবনায় সামান্য কিছু যোগ করে,
তখনি মনে হয় লেখাটা সার্থক।
সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা
অনুভূতি বিস্ময় – এসবের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় কবিতা। কবিতা এমন এক আশ্চর্য শিল্পকর্ম
যা মানুষের চেতনায় রঙে রঙ্গীন। রঙ - এখানে
যে রঙের কথা বললাম, তা হচ্ছে আমাদের ভেতরের চেতনা বা অন্তর্গত মননের রঙ। আমাদের
চেতনায় যদি এই বিশেষ রঙ লাগে, তা হলেই আমরা কবিতাকে গ্রহন করতে পারি, কবিতাকে
নির্মান করতে পারি। তা না হলে কবিতা আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়!
আধুনিক কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কবিরা
কখনো কখনো সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ দ্বারা আক্রান্ত হন। 'Surrrealist’
শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিলো বাস্তবের সীমা অতিক্রম করার প্রয়াস
বোঝাতে। যেমন - ‘সমস্ত
মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিলো ...... / জ্যোৎস্নারাতে
বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল
আকাশ।’ [হাওয়ার রাত – জীবনানন্দ দাশ]। যুক্তির অনুশাসনের বাইরে মানুষের
মনে যে এক মগ্নচৈতন্যের অতিবাস্তব জগৎ আছে; সেখানে ডুব দিয়ে
তার অতলস্পর্শী রহস্যকে উন্মোচন করাই সুররিয়ালিজমের কাজ। সুররিয়ালিস্টরা জেগে জেগে
অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখে । যেমন কখনো
আমার কবিতাতেই আমি লিখেছিলাম - ‘পৃথিবীর প্রাচীন
পুঁথির উপর ঢলে পড়ছে জোৎস্নার জন্ডিস ।……. যুবতীর মাই-ছোঁয়া ইলেক্ট্রিক শক আচমকাই ফিরে যায় হলদেটে বাল্বের দিকে।…… টার্মিনাল স্টেশনের
সময়কে উলটে দিয়ে আকাশের সভাগারে উড়াল দেয় ধূর্ত বণিক আর পঙ্গু বুদ্ধিজীবির দল।…… ’ [সময় সফরের জানালায়] ।
এখানে বর্ণিত প্রতীকগুলো অসংলগ্ন।
কল্পনার রাজ্যে এম্নিই সব অদ্ভূত ঘটনা ঘটে চলে! আধুনিক কবিতায় এজাতীয় সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদের ব্যবহার আজকাল আমরা আকছার
দেখতে পাই।
কবিতায় মাস-কমিউনিকেশনের কিছুটা সমস্যা থেকে যায়। এজন্যেই কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তিত হওয়া দরকার’। কিন্তু সহজেই যে হৃদয় পরিবর্তিত
হবে এটা মনে করার কারণ নেই। তবুও চেষ্টা করি; কিছু অনুভব, কিছু ভিন্ন মাত্রার উচ্চারণ কবিতার মধ্য
দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। প্রকাশভঙ্গীর
বিশিষ্টতার জন্যেই কবিতার পাঠক সীমিত। এই
সীমাবদ্ধতার কথা ভেবেই পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর জন্যে কখনো কখনো কবিতার পাশাপাশি আমি গল্প
বা গদ্য লেখারও চেষ্টা করি।
প্রথম জীবনে ছন্দতে লিখতে
চেষ্টা করেছি । পরবর্তী
সময়ে আমার কবিতাতে অন্ত্যমিল, ছন্দের ব্যবহার -
এসব খুব একটা নেই।
কখনো
গদ্য ছন্দে, কখনো একটানা গদ্যে কবিতা লিখেছি। শুধু আমাকে ভাবতে হয়েছে এর মধ্যে
কিছু অনুভব , কিছু কাব্যগুন আছে কিনা। কথ্য ভাষা আমার কবিতায় কখনো সখনো আসে। অনলংকৃত ভালো কবিতাও আমার কাছে সমাদরের – কারণ এক্ষেত্রে লেখাটা সহজ, এবং অনেক ব্যবহারিক।
একসময়ে বিশিষ্ট কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত বলেছিলেন,
‘কবিতা খবরের কাগজের মতো পড়া হোক।’ কবিতাকে সহজভাবে সাধারণের কাছে বোধগম্য করবার
জন্যে। বোধগম্য সহজ কবিতা অবশ্যই
প্রত্যাশিত , তবে তার জন্যে কবিতার রূপ-গুন, ধর্ম ও স্বকীয়তা-বর্জনের বিষয়টা মেনে নেয়া যায় না।
আর একটা কথা, কবিতা কোনো অনড়, স্থানু বিষয় না। চর্যাপদ কিংবা তারো আগে থেকে
শুরু করে বিবর্তিত হতে হতে কবিতা আজকের চেহারা নিয়েছে। সামাজিক অবস্থা ও পরিবর্তিত দর্শণ,
কবিতার চেহারা ও বক্তব্যকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ ও চেহারা দিয়েছে। আজকের কবিতা আগামী পঞ্চাশ বছরে আরো অনেক পালটে যাবে।
কবিতার মধ্যে এমন কিছু
অলৌকিক ব্যাপার আছে যার জন্যে মানুষ কবিতাকে পরিত্যাগ করতে পারে নি । যুগে যুগে মানুষেরা কবিতার সঙ্গে
থেকেছে। আমিও চাই- কবিতার সান্নিধ্য ও সাহচর্য। সময় ও সমাজের পাশে সবসময়ে মিশে থাকুক কবিতার
ভাবনা। শিল্প, চিত্রকলা, চলচিত্র কিংবা
সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতোই আমাদের কবিতা হয়ে উঠুক সময় ও জীবনের কণ্ঠস্বর!
© biswas.samarendra@gmail.com ===== 12/03/2020 – R1
Comments
Post a Comment