ফুফুর কফিন
Story
ফুফুর কফিন
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
ফুফুর ঘর থেকে ঠকাঠক্ আওয়াজ । ফুফু
তার নিজের বন্ধ ঘরে নিজেই একমনে পেরেক ঠুকছে । তার নিজের কফিনে ।
আমাদের বাড়িটা ছিল নদীর পাশে একটা গ্রা্মে ,
কাছেই কবরখানা । গরীব গুর্বো কেউ মরে গেলে সেখানে গর্ত করে কবর
দেয়া হতো । বড়লোকদেরও দু-তিনটে পাকা সমাধিস্তম্ভ এই কবরখানায় মাথা তুলে বসে থাকতো । আমাদের
বাড়ির জানালা থেকে সেগুলো স্পষ্ট দেখা যেতো । পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা
কবরখানার নির্জনতাকে আরো বাড়িয়ে তুলতো ।
সইদাফুফু আমাদের বাড়ির সীমানার এককোণে একটা ঘরে
একাই থাকতো ।খুব সকালে উঠে আপনমনে কি সব কথা আউড়ে যেতো , কচিৎ কখনো ঘুম ভেঙ্গে
গেলে আমরা বুঝতাম সকাল হতে আর দেরী নেই । ভোরে উঠে বাড়ির উঠানে সে চক্কোর লাগাতো ।
তারপর কবরখানা-মাঠের পাশ ধরে কিছুটা হাঁটতো । কখনো চলে যেতো নদীর ধারে – বিড় বিড়
করতে করতে পথ চলতো । ফেরার পথে রাস্তার ধারে ফুটে থাকা জবা আর পড়ে থাকা শিউলি ফুল
তুলে নিতো। ফুলগুলো তার বাসি কাপড়ের কোঁচড়ে আটকে পড়ে
ক্রসবিদ্ধ যীশুর উদ্যেশে গলাবাজি করতো ।
ফুফু বাড়িতে ফিরে নিজের খুপরিতে ঢুকে যেতো, সে
একজন বেওয়া , বিধবা মেয়েছেলে। ছেলেমেয়ে কেউ ছিলো না ।
তার ঘরে উনান চড়তো কি চড়তো না । সময়মতো দুবেলা এল্যুমিনিয়ামের থালায় ভাত ,
পান্তাভাত কিংবা রুটি- তরকারি , পেয়াজ-লঙ্কা ; তার ঘরে আমরা কেউ না কেউ পৌঁছে
দিতাম ।
মাঝে মাঝে খেপি ফুফুর ঘর থেকে ঠোকাঠুকির আওয়াজ
আসতো । কখনো ভেজানো দরজাটা একটু ফাঁক থাকলে দেখতে পেতাম ফুফু লম্বাপানা একটা
বাক্সে পেরেক ঠুকছে । এটা একটা কফিন বাক্স । তার খাটের নীচে আদ্যিকালের কিছু কাঠ ।
হাতুড়ি , করাত , অন্য কিছু সরঞ্জাম, আর ফুফুর জীবনের মতোই কিছু মর্চে ধরা পেরেক। এককালে
ফুফা-মশাই কাঠমিস্ত্রী ছিলো কি না।
সে অনেক কাল আগের কথা । মাইল তিনেক দূরে
খ্রীষ্টানপাড়া । সেখানেই একদিন ফুফা-মশায় মারা গেল অপঘাতে । তাকে
নাকি জিনে ধরেছিল । আমাদের গ্রামের কবরখানার পাশ দিয়ে সন্ধ্যেয়
খ্রীষ্টানপাড়ায় ফিরতে ফিরতে তার গায়ে সে কি ধুম জ্বর । সে জ্বর আর
কমলো না। কয়েক দিনেই তার শরীরটা হয়ে গেল ফ্যাকাসে , যেন
গোরস্থান থেকে উঠে এসেছে পালক ঝরা শকুন ! ঝাড়-ফুক হলো । তবুও
শেষ রক্ষা হলো না , ফুফু আর পরিবারের সবার সামনে দিনে দিনে তার শরীরটা হয়ে গেল
রক্তশূণ্য । ফুফা কবরে গেল । ফুফুর নাম হলো অলক্ষুণে – বেওয়া ডাইন !
আব্বা ইয়াসিন আলি সরল মনের লোক , পরোপকারী মানুষ। আমি
তার বেশী বয়সের জন্মানো প্রথম সন্তান । খ্রীষ্টানপাড়ায় থাকা ফুফার পূর্বপুরুষদের
সঙ্গে আমাদের
নাকি দূর সম্পর্কীয় কি এক আত্মীয়তার খোঁজ মিলে গেছিল ।ফুফা
মশাইর ইন্তেকাল হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত এদিক ওদিক ঘুরে সাইদাফুফুর স্থান হল আমাদের
বাড়িতে । মূলতঃ সেটা আব্বার করুণা , সুদূর আত্মীয়তা আর
পরোপকারের প্রচ্ছন্ন তাগিদে । তার আশ্রয় মানে আমাদের
বাড়ির প্রত্যন্ত সীমানার এককোণে একটা ছোট্ট ঘরে । সে অনেক কাল আগের কথা , তখনো আমি
জন্মাই নি । সেই থেকেই ফুফু এখানে আছে । তার সম্পত্তির মধ্যে ছিলো ঘটি বাটি ট্রাঙ্ক , ফুফামশাইর কাঠ মিস্ত্রীর সরঞ্জাম আর একটা লম্বা
পানা কাঠের বাক্স । শুনেছি , প্রথম প্রথম ফুফু এমন ক্ষেপী ছিল না । কিন্তু সময়
পেরোতেই বাইরের লোকেদের কাছে সে হয়ে গেলো খেপি ফুফি , কেউ বা বলতো পাগলা পিসি !
কখনো দেখতাম ফুফু তার খুপরীর পাশে একটা গাছের
নীচে বসে কি একটা গান গাইছে । কখনো একটা কাঠকে রাঁদা দিয়ে চাঁছছে । লোকেরা বলতো ,
ফুফুর মাথায় ছিট আছে ।
একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম , ‘ ফুফু , এসব তুমি
কি করছো ?’
- ‘ পোলাপান
মানুষ , তুমি বুঝবা না বাবা।’
- ‘ তাও বলো তো
?’
-
‘
জান্তে চাও ? দ্যাখো , একট্যা মানুষ বাইচ্যা থাকতে থাকতে তার নিজের কফিন নিজেই
বানাবে ; এট্যা ভালো নয় কি । আমি তো বলি , পোত্তেক মানুষের নিজের কবর নিজেকেই
খুইড়্যা রাখুক।’
ফুফু বলতো - ‘ মাইন্ষের আয়ু পদ্মপাতায় জল ।
বেবাক জীবনটা তো কারো না কারো গলায় ঝুইল্ল্যা থাকলাম । ইন্তেহান কালে
যাতে আমারে নিয়্যা কারো ভাবতে না হয় ! একট্যা মানুষ বাইচ্যা থাকতে তার
নিজের কফিন নিজেই বানাবে ; তুমি বলো- এট্যা ভালো নয় কি ?’
আমি অবাক হয়ে দেখতাম ফুফুর করাত দিয়ে কাঠ চেরাই
করা , তাতে পেরেক ঠোকা, কব্জা লাগানো । আবার পেরেক আর
কব্জাগুলো খুলে ফেলতো । একদিন দেখি , ঘরে বসে ফুফু নিজের অসমাপ্ত কফিনে সিরিষ কাগজ
বোলাচ্ছে । সেটাকে আরো চকচক করছে !
মাঝে মাঝে ফুফু নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তো ,
কিছুটা পাগল পাগল ভাব – ছিটগ্রস্থ । বেরিয়ে
পড়তো দূরে , অনেক দূরে ! কাউকে যেন খুঁজছে । বিকেল , একটু পরে সূর্য ঢলে পড়তো । গাছের
নীচে ছোট ছোট বাচ্চাদের জটলা । ডুবন্ত সূর্যকে পিছনে রেখে ঘরে ফিরতে ফিরতে ফুফু
চিৎকার করতে থাকতো – ‘জিবইন্যা , ও জিবইন্যা , ওরে আমার জীবন ?’
- ‘সন্ধ্যা
হইলো , সক্কল মানুষ ঘরে ফিরলো , জিবইন্যা , তবু তুই ঘরে ফিরিলি না কেনে?’
- ‘জিবইন্যা , ও
জিবইন্যা , সন্ধ্যা হইলো , তুই কোথায় , এখনো তোর তালাশ পাইলাম না !’
-
বাচ্চারা
বলতো , ওই দ্যাখ , ক্ষেপী পিসি যাচ্ছে ! পেছন পেছন ওরাও ফুফুর চ্যাঁচানোর আওয়াজের
প্রতিধ্বনি তুলতো -‘সন্ধ্যা হইলো , সক্কল মানুষ ঘরে ফিরলো , জিবইন্যা , তবু তুই
ঘরে ফিরিলি না ?’
‘জিবইন্যা , ও জিবইন্যা , তুই কোথায় ?’ –
পাগলীর এই কথাগুলো লৌকিক বাতাসে যীশু অথবা আল্লাহ-র কাছে প্রেরিত অনুযোগ কিম্বা
সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনার মতো শোনাতো? কে এই জিবইন্যা তা আমি জানতাম না । ফুফুর এই
কথাগুলো গোধুলির আলোয় মাঠ পেরিয়ে ভেসে যেতো অনেক দূরে, কবরখানার গাছ-গাছালিতে
কথাগুলো ধাক্কা খেতো , কখনো বা তার কথাগুলো ছিন্ন-মাতৃত্বের আকুতি নিয়ে নদীর স্রোতে ধাক্কা খেতে খেতে কোথায় যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতো
! আমাদের বাড়িতে ফিরে এক সময় ফুফু এককোণের আলাদা ঘরটায় ঢুকে যেতো ।
আবার শুনতাম হাতুড়ির ঠকাঠক্ আওয়াজ । ফুফু
বিড়বিড় করতো । ‘সেই তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের সময় , শুন্ছিলাম
, ছোটকালে আমার মা আমারে ফ্যালাইয়া দিয়া পালাইয়্যা গেছিলো । আর বয়সকালে আমার মরদ আমারে
একল্যা ফ্যালাইয়া , একল্যা-একল্যা ঘুমাইতে গেলো
গোরস্থানে – তখন তার ধুম জ্বর , শ্যাষকালে তার মুখে এক ফোটা জল দিবার ছিল । বাড়ীর
লোক বল্লো , আমি ডাইন , আমি অপয়া আউরত । শ্যাষকালে তার মুখে এক ফোটাও জল দিবার
পারি নাই ! একদিন শ্বশুর বাড়িতেও লোকেরা আমারে তাড়াইয়া দিল , ওখানে থাকতে পারলাম
না। তারপর এদিক ওদিক ঠ্যালা-গুতা খাইতে খাইতে আইস্যা উঠলাম এহেনে । ইয়াসিন আলি
মানুষটা ভালো , দয়ার শরীল , কিন্তু ...... সে সব অনেক বৃত্যান্ত ...... । আমি
হইলাম পোড়াকপালি !’ ফুফুর এমনি কত কথা !
কথা থেমে গেলে আবার হাতুড়ির ঠকাঠক্ আওয়াজ ।
জিজ্ঞাসা করলাম – ‘ফুফু , কি করছো ?’
-
‘মনে
হচ্ছে এখানটায় মজবুত হওনের লাগে । তাই পেরেক ঠুকছিলাম । হাঁ , আমার ছোটপোলা , যাই
হউক না কেনে - কফিনটা তো পোক্ত করনের লাগে ।’
আমার আব্বা ইয়াসিন আলি, কেন জানি না , কোন
কালে কি ভেবে দয়া দেখিয়ে ফুফুকে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলো – অনেকদিন ধরেই সে
আমাদের সংসারে একটা বাড়তি মানুষের মতো টিকে ছিল ! এনিয়ে মায়ের সঙ্গে আব্বার কখনো
কখনো ঝগড়াঝাটি হতো। আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে ক্ষ্যাপাটে ফুফুর পাগলামি কখনো সখনো লজ্জাজনক হয়ে উঠতো , কখনো বা ভীষণ অসহ্য ।তবুও কেমন
ভাবে তা যেন আমরা মানিয়ে নিয়েছিলাম । বেশীর ভাগ সময়ে আমাদের ঘর থেকেই খাবার যেত ।
আমরাই তেল , সাবান , গামছা , কুর্তা-শাড়ি এসব দিতাম । এ দুনিয়াতে কিছু অনিবার্য
স্মৃতি ফুফুর পেছনে ঘুরঘুর করতো । এই স্মৃতিগুলো্কে পালন করা, একা একা বিড়বিড় করা,
রোজ রোজ নিজের কফিন মেরামত ও তাকে পরিচর্যা করা , একলা একলা সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায়
এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো – এইসব ছাড়া তার জীবনে বৈচিত্র্যময় আর বিশেষ কিছু ছিল না ।
একদিন দুপুরে ফুফু কবরখানার মাঠ পেরিয়ে নদীর পার
ধরে হাঁটছিল । মেঘলা আকাশ । স্কুল ছুটির দিনে কিছু পড়ুয়া জটলা মারছিল গাছের নীচে ।
তাদের একজন এগিয়ে এলো খেপি-ফুফির পাশে – ‘ পিসিমা , আপনে যে জিবইন্যা-র খোঁজ করেন
, তারে আমরা দেখেছি । এই নদীর ওপারে ...’
‘তোরা আমার সাথে মস্করা
করো ?’ – ফুফু হা হা করে ওঠে ।
অতি বিনয়ের সাথে সেই
ছেলেটা ফুফুকে বোঝায় –‘ না পিসিমা ,ওই নদীটা পেরোলেই আরেকটা শ্মশাণ । তার পাশেই
কতগুলো লাল লাল শিমূল গাছ , সেখানে কতগুলো গোয়ালের বাথান । সেখেনেই আপনার জিবইন্যা
শুয়ে থাকে , আমি নিজের চোক্ষে দেখেছি !’
‘তোরা আমার সাথে মস্করা
করো ?’ – ফুফু আবিশ্বাসে মাটিতে থুথু ফেলে সামনে এগোতে থাকে । পেছন থেকে ছেলেরা হি
হি করে হাসে ।
#(gap)
কয়েকদিন ধরে ফুফুর
কফিনে ঝাড়পোছ কমে গেছে, পেরেক ঠোকার শব্দও কম কানে আসে । তার বদলে শুনতে পাই ,
ফুফু বলে চলেছে – ‘নদীর পারে শিমূল গাছে / জিবইন্যা আমার বাইচ্যা
আছে’ । কখনো বলে চলেছে – ‘নদীর পারে বাথানে / জীবন আমার সেথানে’ ।
ফুফুকে জিজ্ঞেস করি – ‘
কি বলছো , নদীর ওপারে কে আছে ?’
সে চুপ করে থাকে । আমি জিজ্ঞেস
করি – ‘ ফুফু , তুমি সব সময়ে বলতে থাকো- জিবইন্যা, জিবইন্যা , তা কে এই জীবন-বাবাজি
?’
ফুফুর সংক্ষিপ্ত উত্তর
– ‘সে তোমরা বুঝবা না।’
#(gap)
সে দিন রাতে আমি জীবন
বাবাজিকে স্বপ্নে দেখলাম।
ক্লান্ত শরীরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না ।
আমার স্বপ্নে দেখা দিল ফুফুর ‘জিবইন্যা’। একজন পুরুষ, তার
হাতেও হাতুড়ী আর পেরেক । ম্লান হেসে জিবইন্যা
আমাকে কাঁধে হাত রেখে বলে চললো , ‘আরে চিনলি না । আমি তো তোর সৎ ভাই । তোর
থেকে অনেক বড়ো ! আর চিনবি-ই বা কি করে! মায়ের পেট থেকে খালাস হবার আগেই ডাক্তার
আমারে শান্টিং করে দিলো ।’
বলেই জিবইন্যা খিক খিক করে হাসতে লাগলো! –‘এসব বড়োদের কথা ,
এসব তুই বুঝবি না । আমি পেট থেকে খালাস হবার পর রাতদিন
সইদাবিবির সে কি দুঃখ রে , তুই এখনো ছোটো - এসব তুই বুঝবি না রে ভাই ...... !’ তারপর
হঠাৎ রাতের অন্ধকারে মানুষের দেহটা ঘরের জানালার শিক গলে বাইরে বেরিয়ে এলো । সেই
জীবন বাবাজি ফুরুত করে মাটি ছেড়ে আকাশে দিকে উড়াল দিল।
আমাদের বাড়ীর সামনের নদীটা তখন থর থর করে প্রচন্ড কাঁপছিল । দেখলাম জীবন বাবাজি
উড়তে উড়তে নদীটা পেরিয়ে শ্মশানের দিকে উড়ে যাচ্ছে । ফুফু একটা উড়ন্ত মানুষের পেছন
পেছন দৌড়াচ্ছে, ছুটতে ছুটতে নদীর দিকে যাচ্ছে । চীৎকার
করছে “জিবইন্যা আমার ফিইর্যা আয় , আমার প্যাটের ছাওয়াল – আমার প্যাট বানাইলো
ইয়াসিন আলি, নাইলে তোরে এমন ফ্যালাইয়া দিতাম না।’
ঘুমের মধ্যে আমি দেখলাম , নদীর ওপারে লাল লাল
শিমূল গাছে আগুন লেগেছে । আর আমার আব্বা একটা আলখাল্লা পরে জ্বলন্ত শিমূল গাছের
সামনে দাঁড়িয়ে পয়গম্বরের মতো চামর দোলাচ্ছে !
#(gap)
কিছুদিন বাদে ।একদিন
বিকেলবেলা হই চই ! দেখি ভিজে কাপড়ে সপ সপে , ফুফু আসছে । পেছনে এক দঙ্গল লোক ।
ফুফু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের লোকগুলোকে কিছু বলছে , আবার এগোচ্ছে , আবার পেছনে ফিরছে ।
একসময়ে সে ভিজে কাপড়ে নিজের কুঠুরিতে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিল ।
পাড়ার লোকজন আমাদের
বললো – ‘ আলি সাহেব , ক্ষেপী ফুফুকে সাবধানে রাখুন । না হলে অপঘাতে মারা পরবে ।’
- ‘ভাগ্যি ভাল ,
জাইল্যাপাড়ার কেষ্টর নজরে পড়ছিল , নাইলে নদীতে ভাইস্যা যাইতো , সাঁতার জানেনা ,
একলা একলা নদীতে নামছিল – নদীর ওপারে যাওনের লাগে ।’
আমরা ভেবে পাচ্ছিলাম না
– কি করবো । সহায়সম্বলহীন ফুফুকে বাড়ির লোকেরা নজরে নজরে রাখতাম , কখনো কখনো
বাইরের থেকে ছিটকিনি বন্ধ করে তাকে আটকে রাখবার চেষ্টা করতাম । বলতাম – ‘ফুফু, এখন
ঘুমাও ।’
ফুফু ঘুমাতো না ।বাইরে
থেকে শুনতাম ঠকাঠক আওয়াজ । সে পরখ করছে কফিনটা শক্তপোক্ত আছে কিনা। সাফ সাফাই আছে
কিনা । কফিন, অন্তিম ফুফুর নিজস্ব ঘর – মরে যাবার পরে তার নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাবার
জায়গা ।
যখন ফুফুর ঘরের পাশ দিয়ে যাই, শুনতে পাই বিড়বিড়
করে বলে চলেছে – ‘‘নদীর পারে বাথানে , জিবইন্যা আমার সেথানে, আমার ছাওয়াল, ওরে তুই
ফিইর্যা আয় ।” বারবার সেই একই কথা ।
কিন্তু আমার প্রশ্ন
থেকেই যায়, কে এই জিবইন্যা ? সে কি স্বপ্নে দেখা আমার সৎ ভাই? আমার আব্বার
বীর্যজাত সন্তান !
সেদিন রাত্রে দরোজা
ঠেলে ফুফুকে পৌঁছে দিলাম ভাত, ডাল , আলুসেদ্ধ আর তরকারি। তার চোখে খুশীর
আভা , মুখে এক চিলতে হাসির ঝিলিক ! তার সেই হাসিটুকু লটকে রইলো আমাদের বাড়ীর
জোনাকি-জ্বলা গাছ গাছালিতে , সেই রাত্রির চাঁদ ওঠা মেঘহীন আকাশে । ফুফুকে এমন
ঝিলিক হাসি দিতে কখনো দেখি নি ! ধীরে ধীরে গড়িয়ে রাত নামলো।
#(gap)
পরদিন ভোরবেলা । আমাদের
বাড়ীতে আবার লোকজনের আওয়াজ । জেলেপাড়ার কেষ্ট ও আরো কয়েকজন । আমাদের ডেকে তুললো ।
- ‘বাবু
মশাই-দাদারা – নদীতে চলেন।’
- ‘কেনো , কি
হয়েছে ?’
-
‘চলেন,
চলেন, জলদি চলেন। সব বলতেছি ।’
ভোর সকালে ক্ষ্যাপা ফুফু নদী পেরোনোর চেষ্টা
করছিলো ।
জাল নিয়ে মাছ ধরতে আসা কেষ্টর নজরে পড়তেই সে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলো
।কিন্তু বাচানোর আগেই খেপি ফুফি তলিয়ে গেছে নদীর অতলে ।
নদীর পাড়ে দেখলাম কিছু মানুষের জটলা। আব্বার
সাথে সাথে আমিও গেলাম। জেলে পাড়ার অনেকে নেমে গেছে জলে , ডুব দিয়ে দেখছে ফুফুর
লাশটা পাওয়া যায় কিনা !নদীর অন্যপাড়ে তখনো হাতছানি দিচ্ছে শিমূল গাছে রক্ত রঙ্গীন
ফুলে ভরে থাকা অন্য কোন না জানা জীবন ! ফুফু কানে কানে বলে যাচ্ছে - ‘নদীর পারে
শিমূল গাছে, জিবইন্যা আমার বাইচ্যা আছে’।
ফুফুকে পাওয়া গেল পরদিন । নদীর স্রোতে তার দেহ
একটা চরের কাছে জঙ্গলে আটকে ছিল । থানা পুলিশ করে ফুফুর দেহটা যখন আমাদের বাড়ীর
আঙ্গিনায় পৌঁছল, তখন বিকেল ।
উঠানে শুইয়ে রাখা ফুফুর দেহটা ঘিরে অনেক
মানুষজন। সেই সব মরদ-আউরত, বুড়ো-বুড়ী, এমন কি বাচ্চা কাচ্চারা। যারা ফুফুকে করুণা
করতো, যারা উপদেশ দিতো , যারা তাকে সবার সামনে ক্ষ্যাপাতো – তারা সবাই হাজির । আমার
আব্বা ইয়াসিন আলির
ভাবলেশহীন চোখ মুখ !
ফুফুর কুঠুরী থেকে বের করে নিয়ে আসা হলো কাঠের
কফিনটা । যেটা ফুফু নিজের হাতেই তৈরী রেখেছিল । সাদা কাপড়ে
মোড়া তার জলে ভেজা বেঢপ দেহটাকে কোনমতে ঠেসে ঠুসে ঢুকিয়ে দেয়া হলো সেই কফিনে ।
ভীড়ের মধ্য থেকে কেউ ডুকরে কেঁদে উঠলো ।
এমন সময় দেখা গেলো আরেকজন বেওয়া আউরত – পরনে
সাদা পোষাক । খেপি ফুফির কোন আত্মীয়া কি ? না – তার সঙ্গে
সম্পর্ক রাখে এমন কোন আত্মীয়া তো কোন কালে ছিল না ।তিনি শক্ত পোক্ত এক মহিলা -
বৈধব্য তাকে দমাতে পারে নি , যদিও তার যৌবন অতিক্রান্ত । বেওয়া-মহিলাটি
কুঠুরির থেকে বের করে নিয়ে এলো ফুফুর হাতুড়ী আর পেরেক । হাতের ঈশারায় সে চারপাশ
থেকে লোকজনদের সরে যেতে বললো ।কয়েকজন লোক কফিনের ঢাকনা বন্ধ করলো । তা হতেই সবাইকে
অবাক করে দিয়ে অচেনা স্ত্রীলোকটি কফিনের ঢাকনায় হাতুড়ী দিয়ে পেরেক ঠুকতে লাগলো ।
উপস্থিত লোকজন হৈ হৈ করে উঠলো । বেওয়া-মহিলাটি ভীড়ের দিকে চেঁচিয়ে বলে উঠলো –‘এটাই
নির্দেশ !’
কার নির্দেশ ? কিসের নির্দেশ ? এই বিধবাটি
হাতুড়ী দিয়ে কফিনে পেরেক ঠুকছে ? – নাকি সাঙ্কেতিক ভাবে এই মেয়েমানুষটিও অভিষিক্ত
হতে চলেছে মৃত সইদাফুফুর বৈধব্যময় জীবনের সহায়-সম্বলহীন অন্ধকার কুঠুরিতে ।
দশজন লোক বয়ে নিয়ে গেলো সেই ভারী কফিন । সমস্ত
লোকেদের নিষেধ সত্বেও পেছন পেছন সঙ্গী হলো সেই বিধবা মহিলাটি ! কবরস্থানে একটা
গাছের নীচে মাটি খুড়ে কফিনসহ সাইদা ফুফুকে দাফনানো হলো ।
সেদিন সারা রাত্রি কি এক অজ্ঞাত গোলযোগের কারণে
কারো বাড়িতে বিদ্যুতের লাইট জ্বললো না। যা
জ্বললো তাহলো কেরোসিনের কূপী, টর্চ লাইট , কিংবা মোমবাতি ! এদিক ওদিক অন্ধকারে
ঘুরতে লাগলো মৃত ফুফুর ক্ষ্যাপামি । আর ভেসে আসতে লাগলো
অসংখ্য বিধবা-আউরতদের সারিবদ্ধ কফিনে হাতুড়ী ঠোকার ঠকাঠক শব্দ !
PUBLISHED STORY
(C) biswas.samarendra@hotmail.com
Comments
Post a Comment