প্রতুল কৃষ্ণ চক্রবর্তী – একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ


#                         

খুবই দুঃখের খবর, প্রতুলদা সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন ১৪ই আগষ্ট-২০১৯এ, ওনার এতো তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটাই একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।

সময়টা ছিল ১৯৯০, তখন খবর পেলাম আমাদের পাড়ার প্রতুলদা ভিলাই স্টীল প্লান্টের ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছেন। শুনলাম, মারুতি উদ্যোগ লিমিটেডের থেকে তাকে স্টীল অথরিটি অফ ইন্ডিয়াতে নিয়ে আসা হচ্ছে, এই আনার পেছনে ছিলেন তৎকালীন সেইলের চেয়ারম্যান মিঃ কৃষ্ণমূর্তি, মিঃ জম্বুনাথন প্রমুখ; হয়তো প্রতুলদার ব্যাপক কর্মকুশলতা ও সুনামের জন্যেই! ভিলাই স্টীল প্লান্টে তখন আমি জুনিয়র লেভেলের অফিসার, আমার পাড়ার দাদার সঙ্গে দেখা করবো- এমনি ভাবতে ভাবতে  বুকে সাহস বেঁধে একদিন চলে গেলাম ওনার ইস্পাত ভবনের অফিসে। সানন্দে উনি আমাকে প্রথম দর্শনেই ভাই হিসেবে গ্রহন করলেন, সেই প্রথম প্রতুলদা’র সঙ্গে আমার পরিচয়।

যদিও প্রতুলদার কৈশোর আমার অঞ্চল কাঁচরাপাড়ার জোনপুরেই কেটেছিলো, তবুও তখন ওনার সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় ছিল না। ওনার ভাই মুকুন্দ-দার(প্রণব)সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলআমার স্কুল জোনপুর হাই স্কুলের দু’কদম দূরেই ওনাদের বাড়ী।

ভিলাইতে সেই প্রথম ওনার সঙ্গে  দেখা- পরিচয়, তার থেকেই তিনি ক্রমে ক্রমেই আমার নিজের আপন দাদা , যথার্থই আমার হিতাকাঙ্ক্ষী অভিভাবক হয়ে গেলেন! আমি বিয়ে করার পর থেকেই ওনার পরিবারের সঙ্গে আরো আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। তখন ওনারা সেক্টর নাইনের কোয়াটারে থাকতেন।

প্রতুলদা যদিও ইঞ্জীনিয়ার , হিসাবশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করে উনি ফাইন্যান্স প্রোফেশনে চলে আসেনশুনেছি – দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ওনাকে চাকুরী ছাড়তে হয়েছে। তার চাকুরী জীবনের দীর্ঘ ইতিহাস , চাকুরীর সঙ্গে চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে নানা ধরনের কোম্পানীতে উনি চাকুরী করেছেন, সেই সূত্রেই নানান জায়গায় তার বসবাসের অভিজ্ঞতা। শেষে স্টীল অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার একজিকিউটিভ ডাইরেক্টর হিসেবে উনি রিটায়ার করেন।

প্রচন্ড কুশলতার সঙ্গে, আপোশহীনতার সঙ্গে উনি চাকুরী করেছেন। দুর্নীতি দেখলেই রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন, কি করে কোম্পানীর ভালো করা যায়, কি করে কোম্পানীর আয় বাড়ানো যায় – এমনই উদ্দেশ্য নিয়ে নানা সময়ে নানা সাহসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

অথচ কে বলবে, কোম্পানীর উচ্চপদে থাকা এই মানুষটিই একসময়ে শৈশবে তার পাড়ায় তারাপদ’র বারোয়ারী বিলে চান করতেন, ঘন্টার পর ঘন্টা জলে চিৎ-সাঁতার দিয়ে শুয়ে থাকতে পারতেন, আপন মনে ধ্যান করতেন। কে বলবে, এই মানুষটা প্রথম জীবনে নিজের মাছ-মাংসের খাবারের কাটছাট করে গোপনে দুঃস্থ ছাত্রকে পড়বার পয়সা জোগাতেন!

প্রতুল কৃষ্ণ চক্রবর্তীর জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারী১৯৪৪এ- অধুনা বাংলাদেশের যশোর জেলায়। খুব অল্প বয়সে, দেশ তখন সবে মাত্র স্বাধীন হয়েছে, তিনি সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। অনেক ভাইবোনের বড় সংসার, সে জন্যে কিছু অর্থকষ্ট, অস্বচ্ছ্বলতার মধ্যে তার প্রথম জীবন কাটে। পশ্চিমবঙ্গে আসার প্রথম কিছু বছর কোলকাতার বেলেঘাটায় কাটলেও, পরে তারা কাঁচরাপাড়ায় চলে আসেন। স্কুলের পরবর্তী শিক্ষা কাঁচরাপাড়াতেই।

প্রতুলদা সাধারণ মানুষের জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। পড়াশোনায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তার জীবন-অধ্যয়ণ, তার মেধা, তার সৎ-সাহসই পরবর্তী জীবনে তাকে বড়ো মানুষ হতে সাহায্য করেছে।

তিনি সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন। ভিলাইতে আসার পরে বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার সভাপতি হিসেবে তিনি কয়েক বছর দায়িত্বে ছিলেন। কিছু কিছু লেখা লেখি প্রতুলদা করে গেছেন, তা পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে। নিজ অবস্থানে থেকে তিনি যথাসাধ্য মানুষের উপকার করে গেছেন – যে জন্যে অনেক লোক তাকে অনেক দিন মনে রাখবে।

জীবনের শেষ পর্বে তিনি কিছুটা আধ্যাত্মিক মনোভাবাপন্ন হয়ে যান, তখন প্রথগত সমাজজীবন থেকে তিনি নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলেন। অবসর পরবর্তী সময়ে ভিলাই স্মৃতিনগরে নিজস্ব আবাসে অধিকাংশ সময় থাকলেও, তিনি ও তার স্ত্রী বানী চক্রবর্তী কখনো কোলকাতা, কখনো ছেলের কাছে বোম্বেতে, কখনো দুই মেয়ের কাছে ধানবাদ বা দুর্গাপুরে ঘুরতে যেতেন।

এই ঘোরার সূত্রেই এবার আগষ্ট মাসে কোলকাতায় ছিলেন। তখন শ্বাসজনিত কষ্টের জন্যে হঠাৎ করে তাকে এক রাত্রে দমদমের এক হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্যে পরদিনই তাকে অ্যাপেলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।  সেখানে দিনকয়েক আইসিইউতে ছিলেন। ১৪ই আগস্ট সকালে হাসপাতালেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মরদেহ কাঁচরাপাড়ায় তার পৈতৃক নিবাসে নিয়ে আসা হয়। সন্নিহিত হালিশহরের শ্মশানঘাটে হুগলী তথা গঙ্গার তীরে সেদিনই ভিলাই-এর, মধ্যবলয়-এর এই প্রিয় পরিচিত স্বজনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

এই বাংলার মাটি, জল, হাওয়া, নদী, মানুষের উপর প্রতুলদার একটা টান ছিল। সেদিন ফুলে ঢাকা তার উজ্জ্বল দেহখানি আমরা সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সামনেই হালিশহর শ্মশানের অগ্নিময় আয়োজন,  গঙ্গার বুক কাঁদিয়ে ভেসে আসছিলো ভারী দুঃখময় বাতাস। শ্মশানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম, মৃত্যুর মধ্য দিয়েই প্রতুলদা তার প্রিয় বাংলার কাছে আর একবার ফিরে এলেন!

#

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

28.09.2019

© biswas.samarendra@hotmail.com

 


Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

দয়াবতী, যাও, ফিরে যাও!