নির্বাসিত হও
নির্বাসিত হও
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
#
তোমায় নির্বাসন দিলাম।
সমুদ্র সীমান্তের সমান্তরাল পথ ধরে
তুমি নির্বাসিত হও।
সংযুক্তা, আলো ঝলমল তোমার
পৃথিবী থেকে
তুমি নির্বাসিত হও।
#
দিগন্তে দিগন্তে হানাদারী জাগুয়ার চীৎকার পাড়ে,
দেহে ক্ষত – বুক নীল যন্ত্রণায়,
তবু
বন্দীশালার মানুষ গরাদের ফাঁকে ফাঁকে
দুচোখের তুলি দিয়ে এঁকে নেয় মুক্তির আকাশ।
গরাদের ঘরে আমি বেঁচে আছি রাত্রি দিন,
কেউ তো তেমন করে বাঁধে নি আমার হাত
দু’পা এগোলে এমন
কেউ নেই
মুখোমুখি বলে দেবে ‘না’ –
তবু স্থির বিশ্বাসে জেনে গেছি আমি
আমার দুহাতে ঝোলে বন্দীর শেকল,
আমার দু’পায়ে বেড়ি,
সম্মুখে প্রহরী;
পেছনে পেছনে ঘোরে ক্রূর ঘাতকের দল
নির্মম আক্রোশে
আমার গানের কলি তলোয়ারে ফালাফালা
প্রকাশ্য ময়দানে।
ইতিহাস ঘেঁটে ঘেঁটে বুঝে গেছি আজ
অভিজ্ঞতা দিয়ে দিয়ে বুঝে গেছি আজ
শেকল ছেঁড়ার গান,
লঙ্ মার্চের পথে
পাহাড় ভাঙার গান
বন্দী সব মানুষের অতি বড় প্রিয়!
#
সংযুক্তা, তুমি কি বন্দী
নও?
কিংবা তুমি দেখে দেখে সুনিপুন ভুলে গেছ সব?
আর তাই
দূরে সরে গিয়ে তুমি এখন আকাশে ওড়াও
ফুলেল রুমাল
তোমার বাতাসে ভাসে হেমন্তের অনুর্বর
বোকা বোবা রোদ,
অন্তর্গত বিশ্বাসে দিন দিন গাঢ় হয় ভীরুতার খাদ,
তোমার চেতনা ভাসে খুশীর বাতাসে
ভারহীন পেঁজাতুলা।
#
তোমার দুচোখে আমি হরিণ খুঁজিনি
খুঁজিনি ধানের খেত, গোলাপ
অথবা ভরা বর্ষার দিন।
বরং খুঁজেছি বৈশাখী আকাশের ঝড়ো মেঘ
দুর্বার উদ্দাম মিছিলের মুখ,
দেখতে চেয়েছি আমাদের হাতে হাতে
ফেস্টুনের দুই ধার।
রক্তে রক্তে যে আগুন ধরা আছে বুকে
কেন তুমি সুচতুর মাথা লুকোবার ঝোঁকে
নেভাতে চাইছো তার আদিম উত্তাপ?
উচ্চারণে যে শপথ ঠোঁটেতে ছুঁয়েছি
কেন তুমি অন্ধকারে সিক্ত দু ঠোঁটের রসে
নেভাতে চাইছো তার জারক তীব্রতা?
#
তোমার দুচোখে আমার স্বপ্নের মতো
এক হাস্নুহানা ভোর জাগতো,
আজও মনে পড়ে
ও দুচোখে চেয়ে চেয়ে অনেক সন্ধ্যায়
হারিয়ে গিয়েছি আমি!
নক্ষত্রহীন অনেক রাত্রি চুপিসাড়ে আসে
বিহ্বলতা মেখে,
কিংবা আমি কিছুকাল তোমার মন্দিরে
হারিয়ে গিয়েছি যেন কোন এক ব্যাবিলন ধ্বংসস্তূপে,
তারো পরে ধ্বস্ত হয়েছি বোধের গভীরে।
ক্রমাগত বিচূর্ণতা রেখে গেছে অট্টহাসি,
আমাদের দিকে চেয়ে তীব্র থেকে তীব্রতর
পৃথিবীর উপহাস!
#
আজ আর নয়
সমুদ্র সীমান্তের সমান্তরাল পথ ধরে তোমায়
নির্বাসন দিতে চাই,
সংযুক্তা,
আমি চাই আলো ঝলমল তোমার পৃথিবী থেকে
তুমি নির্বাসিত হও!
#
আমি খুঁজে নিতে চাই
সংগ্রামের পৃথিবীতে তোমার অস্তিত্ব,
বোধের অগ্নিবলয় তোমায় ঘিরুক।
জনসমুদ্রের ভীড়ে আমি দেখে নিতে চাই
সামুদ্রিক তুমি জল-ডুবুরীর মতো
হয়ে উঠছো বিশ্বস্ত
একটা ভ্রুণের অনুসন্ধানে,
একটা শিশুর অপেক্ষায়-
যার মধ্যে ফুটে উঠেছে আগামী পৃথিবীর
বেদ-বোধ-উচ্ছ্বাস-প্রত্যাশা-ভালোবাসা,
আমার স্বপ্ন, তোমার স্বপ্ন, পৃথিবীর স্বপ্ন!
© biswas.samarendra@hotmail.com / [ কাব্যগ্রন্থ - তবু স্পন্দমান পথ (1986) ]
Comments
Post a Comment