ছোটমার স্মৃতিকথা


#

জামসেদপুর সোনারিতে ছিল আমার দ্বিতীয় শ্বশুরবাড়ী । ওখানে ছোটকা আর ছোটমা-রা থাকতেন । ওনারা সম্পর্কে আমার বউ মানার ছোটকাকা আর ছোটকাকীমা । সেই সূত্রেই আমারও ছোটকা আর ছোটমা । ভিলাইতে আমার প্রথম শ্বশুরবাড়ী , তাই জামসেদপুরকে আমি দ্বিতীয় শ্বশুরবাড়ী ভাবতাম । ওখানে বেড়াতে গেলে একটা জামাই জামাই ভাব এসে যেতো ।

ছোটমা গৌরী ( মুখার্জী ) চক্রবর্তী – কে নিয়ে যে এত তাড়াতাড়ি একটা স্মৃতিকথা লিখতে হবে , তা ভাবিনি ! সাতই  আগষ্ট -২০১৬ তে আমাদের সবাইকে স্তব্ধ করে ছোটমা হঠাৎ একা একা চলে গেলেন মৃত্যুর ওপারে !

ওনাদের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় আত্মীয়তার সম্পর্কে – বিগত পঁচিশ বছর ধরে। তবে সম্পর্কটা শুধুমাত্র লোক দেখানো পোষাক হয়ে থাকে নি , বরং তা মনকে স্পর্শ করে ছিলো , গভীরে কোথাও একটা জায়গা করে নিয়েছিল । ছোটকা এখনও মাঝে মাঝে ওনাদের অস্থায়ী নিবাস , গড়িয়ার তেঁতুলতলা থেকে ফোন করে । কিন্তু ছোটমা নেই । কেমন একটা শূণ্যতা ! বুকে বড়ো বাজে ।

আমাদের বিয়ের অল্প কিছুদিন পরে প্রথম ছোটমার ওখানে যাই , তখন ওনারা সোনারি-র একটা একতালা বাড়ীতে ভাড়া থাকতেন । ছোটকা , ছোটমা , আমার শ্যালিকা ছোট মৌরী ( দেবারতি ) , আরও ছোট মিঠুন ( দেবপ্রীতি ) । সবাই মিলে কি সহজ , কি অনায়াস , কি আনন্দময় সে সব দিন । আমরা প্রথম যে বার গেলাম সেবার বেশ একটা চমক ছিল । আমরা পৌঁছলাম । হঠাৎই দ্বিতীয় শ্বশুরবাড়ীর সবাই ভাবলো নতুন জামাই-মেয়েকে নিয়ে কোথাও যাওয়া যাক । ব্যাস – ভাবা আর উড়ে চলা । প্লান-পরিকল্পনা নেই  , ট্রেনের রিজার্ভেশন জোগাড় হয়েছিল কিনা মনে নেই ; আমরা জামসেদপুর থেকে রওয়না দিলাম আর পৌঁছে গেলাম পূরী ! এই যে হঠাৎ ভাবা , আর হঠাৎ উড়ে চলা , এটাতে আমার মনে হয়েছিল ছোটমা-ছোটকার পরিবার প্রথাগত ঘর-সংসারের নিয়মানুবদ্ধতা , অর্থনীতির হিসাব নিকাশ কিম্বা রাশভারী অনুশাসনের মধ্যে আটকে ছিলো না। তা না হলে কেউ ভাবলো , তল্পি- তল্পা তুললো আর বেড়াতে চললো , এটা কি হয় ? পুরীতে আমাদের বেড়ানোর সেইসব দিনগুলো স্মৃতিময় হয়ে আছে ! ছোটকা ছোটমা মৌরী মিঠুন, আমি – মানা । কি সুন্দর সেসব স্মৃতি !

ছোটমা ধনী ,  সম্ভ্রান্ত , প্রতিষ্ঠিত পরিবারের মেয়ে ; কোলকাতার একডালিয়া-তে থাকতেন । তখনকার দিনের হিসেবে উচ্চশিক্ষিতা ( এম এ বি টি ) । এমন মেয়ের সঙ্গে ছোটকার কিভাবে যে মিল হলো, ভেবে পাই না । ছোটকা ভাষ্কর চক্রবর্তী তখন কেশোরাম জুট মিলে দাপিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করে বেড়াচ্ছেনওনারা একদা স্বচ্ছ্বল পরিবার , কিন্তু তখন পূর্ববংগ থেকে ছিন্নমূল । মোটেই ধনী নন , তবে ততদিনে উচ্চশিক্ষা , বরানগরের আই এস আই ইত্যাদির পাঠ শেষ  করে সবে মাত্র চাকরীতে ঢুকেছেন । তার মন বসেছে সমাজ উদ্ধারে –  তার বুকে তখন রাজনীতি , লোকের ভালো হোক , শ্রমিক আন্দোলন  , পরোপকার । ছোটকার জীবনটা গড়পড়তা যুবকদের রোজনামচা থেকে আলাদা কিম্বা কোলকাতার আশে পাশে ঘুরে বেড়ানো সম্ভ্রান্ত চেহারাগুলোর সঙ্গে তার মোটেই মিল না থাকার কথা । কিছুটা বেপরোয়া জীবন ভাষ্করের । তার এমন একটা জীবনকে বেছে নিতে পারা , মানিয়ে নিতে পারার মধ্যেই ছোটমার জীবনের মহত্বটা লুকিয়ে আছে । মানসিক দিক থেকে দৃঢ় , উদার , পরোপকারী ও মুক্তমনা না হলে ছোটমা তার বিবাহিত জীবনকে মানিয়ে নিতে পারতেন না ।

সম্পর্কে আমার শ্বাশুড়ী হলেও তার মধ্যে আমি গুরু গম্ভীর কাকীমা – কাকীমা ভাব দেখি নি । বরং অনায়াস বন্ধুর মতো । যেন এই মাত্র উঠে এলেন কফি হাউজের আড্ডা চুকিয়ে । কিংবা এইমাত্র যেন কলেজের ক্লাস শেষ করে খোলা রাস্তায় আকাশের নীচে দাঁড়ালেন । ওনার সঙ্গে কথা হোত – তখনকার নানা সাহিত্য , বই বা কোন সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিষয়েওই সময়কার অনেক লেখক লেখিকা বা সাহিত্য- মনষ্ক মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলো ।এরকম কিছু মানুষ তার বন্ধুও ছিলো । কবিতা সাহিত্য সংষ্কৃতি আমারও ভালো লাগার বিষয় । ছোটমা যখন সাহিত্য-সংষ্কৃতি কিংবা লেখক-লেখিকা বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে গল্প জুড়ে দিতেন , তখন আটপৌরে সংসারের এক গৃহিনী হিসেবে তাকে খুব বেমানান লাগতো ।

একডালিয়ার সম্ভ্রান্ত প্লেস থেকে গার্ডেনরীচে ছোটমা ঘর করতে যান । সে এক ভাড়া বাড়ী - সাত ঘর এক উঠান ! তখন ছোটকা কেশোরাম-এ চাকুরী করেনতারপর ওখানকার চাকুরী ছেড়ে ছোটকা টাটাদের কোম্পানীতে জয়েন করলেন । সেই কারনেই ওনারা সবাই টাটানগর চলে আসেন । সেখানেই দীর্ঘদিন বসবাস । টাটানগরে থাকলেও ছোটমার মনটা কিছুটা কলকাতা কেন্দ্রিক ছিল এই কারনেই কোলকাতার শিল্প সাহিত্য সংষ্কৃতির সঙ্গে তার একটা নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ।

তা বলে তিনি যে জামশেদপুরের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তা মোটেই নয় । সেখানেও বিস্তৃত ছিল তার একটা সামাজিক জীবন । ওখানকার একটা স্কুলে ছোটমা কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরে ছোট মেয়ে মিঠুনের জন্মের পরে , সন্তান প্রতিপালনের কারনে , তিনি শিক্ষকতার চাকুরীটা ছেড়ে দেন । সামাজিক উত্তর-দায়িত্বের কথা যদি বলতেই হয় , সেটাও ছোটমার মধ্যে ছিলো । জামসেদপুরে তার বাড়ীর আসে পাশে গরীব বা ঝুপড়ীর বাচ্চারা তার আপনজন । গরীব বস্তীর বাচ্চাদের তিনি নিজের ঘরে ডেকে পড়াতেন , তার জন্যে কোন পয়সা নেবার প্রশ্নই ছিল না । এইসব বাচ্চাদের টিউশ্যনির পর নিজের ঘরেই কিছু না কিছু খবারের ব্যবস্থা করতেন । গরীব মানুষদের জন্যে তার একটা গভীর ভালোবাসা ছিল , তাই এমনটা সম্ভবপর হয়েছিল ।

একটা আপাত নির্লিপ্ততা তার মধ্যে ছিলতাহলেও তিনি আজীবন তার সাংসারিক দায়িত্ব ও পরিজনদের জন্যে কর্তব্য পালন করে গেছেন। আমার শ্বশুরমশাই (প্রয়াত) শঙ্কর চক্রবর্তী কিছু কিছু ব্যপারে ওনাদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন ।  কোলকাতায় আমার যে সাদামাটা বিয়ের অনুষ্ঠানটা হয় , তাকে কার্যকরী করবার প্রায় পুরো দায়িত্বটাই , আপন মনে করে , ছোটকা আর ছোটমা নিজেদের মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। ওনাদের দুই মেয়ে মৌরী আর মিঠুন যে উচ্চশিক্ষিত হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে , তার পেছনেও ছোটমার অবদান রয়েছে । অন্যান্য কাজের মধ্যেও ঘরে পড়াশুনার ব্যাপারে তিনি দুই কন্যার সাহায্যকারিনী ও সফল আভিভাবক ছিলেন।

ছোটমার জীবনটা ছিলো কেমন অনায়াস ! কোন কিছুতেই তেমন কিছু টেনশন নিতে দেখি নি । আমার মনে হয়েছিল , ছোটমার আত্মসম্মান বোধ প্রখর ছিল। কোন অন্যায় বা অপছন্দের কিছু হলে , তিনি যে কাউকেই তা মুখের উপর জানিয়ে দিতেন।

টাকা-পয়সা সম্পত্তি ইত্যাদির উপর তার কোন স্পৃহা বা লোভ বলে কিছু ছিলো না। বাপের বাড়ীর সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি যখন ছোটমার হাতে এলো , তখন তিনি তা নিজের ভোগের জন্যে না রেখে , সমস্তটাই নির্দ্বিধায় রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানকে দান করে দিলেন ।

বিভিন্ন সময়ে জামশেদপুরে বেড়াতে গেলে , আমাদের জন্যে সে কি আয়োজন। নানা রকমের রান্না হচ্ছে । বাজার থেকে বড় বড় চিংড়িমাছ আসছে । মিষ্টি আসছে । এই মিষ্টি ছোটমার খুব প্রিয় ছিল। রক্তে সুগারের সমস্যা থাকলেও  মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করতেন । বিকেলে শহরে ঘুরতে যাবো , আমাদের জন্যে অটোরিক্সা দুয়ারে হাজির ! সোনারিতে বাড়ীর ছাদে দাঁড়ালে একদিকে দলমা পাহাড় , নীচে বয়ে যাওয়া ছোট নদী , গাছপালা জঙ্গল । একটু দূরে দুই নদীর সঙ্গম – দোমোহনী । খাও দাও , আড্ডা মারো , ঘুরে বেড়াও , আকাশ দেখো কিংবা ঘাসেও শুয়ে থাকতে পারো -  এমনি সাধারণ অসাধারণ সব ব্যাপারেই ছোটমার সম্মতি ছিল।  

ওনাদের সুখী জীবনটা একরকম ভালোই কেটে যাচ্ছিল । দুই মেয়ের বিবাহিত জীবন ,  ছোটকার রিটায়ারমেন্ট । শুভ ও ছোট মেয়ের বিদেশযাত্রা । কিন্তু শেষদিকে এমন একটা ঘটনা ঘটলো , যা মেনে নেওয়া বড় কষ্টের ! মৌরীর বর সঞ্জয়ের হার্ট-সক্রান্ত গোলযোগে মাত্র অল্প কয়েক ঘন্টার মধ্যে মৃত্যু ! এত অল্প বয়সে একজনের চলে যাওয়া – অনেক চেষ্টা করেও সঞ্জয়কে বাঁচানো যায় নি , কিংবা বলা চলে ওকে বাঁচানোর মতো যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় নি। এই ঘটনাটা ওই পরিবারকে একদম বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল । এই ঘটনায় ছোটমাও ভীষণ আঘাত পেয়েছিল ।

সঞ্জয়ের মৃত্যুর পর মৌরী যখন জামশেদপুরের চাকুরী ছেড়ে কোলকাতায় একটা চাকুরী নিয়ে চলে এলো , তখন ছোটকা – ছোটমা দুজনেই সোনারির ফ্লাটে তালা ঝুলিয়ে চলে এলেন কোলকাতায় । গড়িয়ার কাছে বাড়ী ভাড়া নিয়ে  মৌরীর কাছে থাকতে শুরু করলেন ।নতুন করে শুরু হোল কোলকাতার অন্য এক নাগরিক জীবন । তবু আমার মনে হয়েছে ,  সঞ্জয়ের মৃত্যুর ঘটনাটা পরিবারের জন্যে একটা দুঃখময় বিধ্বংসী ঘটনা । এমনটা না ঘটলে , আমার বিশ্বাস , ছোটমা আরো অনেক দিন বেঁচে থাকতেন । 

মৃত্যু তো অবধারিত । তবু হৈ চৈ না করে ছোটমা হঠাৎ চলে গেলেন ! মনে হলো যেন ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত এক প্রাজ্ঞ বালিকা গান গাওয়া শেষ করে , খাওয়া দাওয়া সাঙ্গ করে , গাছের ফুলগুলোকে স্পর্শ করতে করতে ,  নিদারুন কোন চমক দিতেই , নাকি গোপন কোন অভিমানে , কাছেই ঘন গাছপালা জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে পড়লেন । ছোটমা মরে যান নি । ‘ইতু’-‘ইতু’ বলে ডাক দিলেই আবার ছোটমা বেরিয়ে আসবেন । ছোটমা আমাদের কাছেই আছেন । আকাশের দিকে দেখো । অন্ধকার নক্ষত্রের দিকে তাকাও ।  কারুময়  , সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে , পত পত করে এখনো আকাশে উড়ে চলেছে  ছোটমার রুমাল !

 

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

© biswas.samarendra@hotmail.com

 


Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

হীরাকুদ, উৎপল সেন ও আমাদের অগ্রজেরা