ডাক্তার সত্যরঞ্জন দাস - একটা স্মৃতিময় জীবন


ডাক্তার সত্যরঞ্জন দাস (Dr. S R Das) - একটা স্মৃতিময় জীবন

অত্যন্ত দুঃখের খবর! ভিলাই-এর বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার সত্যরঞ্জন দাস 14.06.2020 তারিখ রবিবার সকালে বোম্বের এক হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন। কিছুদিন যাবৎ উনি অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। শারীরিক অবস্থার কারণে উনি তার আগের দিন হাসপাতালে ভর্তি হন, আর 14.06.2020 তারিখ সকালেই তার মৃত্যু হয়!
একবুক দুঃখ আর কিছু স্মৃতি নিয়ে লিখতে বসেছি।
ভিলাই-এর মেইন হাসপাতালে সকালে লাইন দিয়ে পেয়েছি ৩ নম্বর টোকেন। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছিলাম, একটু ফ্রেস হতে হসপিটাল সেক্টরে আমার ঘরে গেছিলাম। ফিরে এসে দেখি ডাক্তার বাবু মেডিসিনের আউটডোরে খুব সময় মতো পৌঁছে গেছেন, আউটডোরে রোগী দেখা শুরু করেছে। আমার ৩ নম্বর টোকেনের লাইন পেরিয়ে গেছে। কি করি! অন্য লোকেরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলাম, ডাক্তারবাবু তো আমাকে খুব ভালো করে জানেন। লাইনে দাঁড়ানো লোকেদের রিকোয়েস্ট করে চেম্বারে ঢুকে গেলাম – ডাক্তার বাবুকে বললাম, আমার নম্বর চলে গেছে, আমি আপনাকে দেখাতে এসেছি। উনি আমাকে বললেন, ‘সমরেন্দ্র, আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন। এখন আপনাকে দেখবো না। আগে লাইনে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদের দেখে নেই। যান, আপনি বাইরে যান!’ মুখ ব্যাজার করে বাইরে গিয়ে বসলাম। আমি তো ডাক্তার বাবুর পরিচিত, আমার লাইন মিস করেছি, উনি আমাকে এতটুকুও কনসিডার করলেন না! প্রায় এক ঘন্টা বাদে উনি ওয়ার্ড বয় দিয়ে আমাকে চেম্বারে ডাকিয়ে নিলেন। সস্নেহে আমার রুটিন চেক আপ করে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র লিখে দিলেন। তার প্রাথমিক রুক্ষ ব্যবহারে আহত হলেও, পরে বুঝে ছিলাম , তিনি প্রিন্সিপালের মানুষ। তার নৈতিকবোধ খুব জোরালো।
সেক্টর নাইনে তার কোয়াটারে একদিন বিকেলে গেছি। ডাক্তারবাবু বললেন, সমরেন্দ্র, নেহেরু নগরে একটা ছোটখাটো বাড়ী বানাচ্ছি- চলো তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। ওনার সঙ্গে চলে এলাম ওনার নতুন বাড়ী দেখতে। তখনও তো আমি তার সঙ্গে পরিচিতির সূত্রে ততটা কাছাকাছি আসি নি। তবুও এমনই ছিল তার আত্মীয়তা।
ডাক্তার সত্যরঞ্জন দাস (Dr. S. R. Das, MD) ভিলাই স্টীল প্লান্টের মেইন হাসপাতালের ডেপুটি ডিরেক্টর ও মেডিসিন বিভাগের হেড অফ ডিপার্টমেন্ট ছিলেন। তিনি অবশ্যই ভিলাই এর অন্যতম বিশিষ্ট ডাক্তার, একজন সৎ নাগরিক, অসাধারণ বুদ্ধিজীবি, সমাজমনষ্ক ও সাহিত্যপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ডাক্তার দাস বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থা( ভিলাই)- এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিনি ছিলেন বই পাগল। প্রচুর পড়াশুনা করতেন। বই কিনতেন। কখনো কখনো কোলকাতা থেকে আমাকে দিয়ে নতুন নতুন সব বই আনাতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহিত্যমনস্ক!
আজকে যখন আমরা করোণা নামের এক ভাইরাস নিয়ে যুদ্ধ করছি, ২০০০ সালে লেখা ডাক্তার সত্যরঞ্জন দাসের একটা প্রবন্ধ “মানবিক অস্তিত্বে বিপন্নতা এবং ক্ষীণ নীল বিন্দুটিরও” শীর্ষক একটা প্রবন্ধে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ‘নতুন জীবানু সংক্রমণ’-এর। তখন তিনি লিখেছিলেন ‘গত ২/৩ দশকে আরও কিছু কিছু রোগের প্রাদুর্ভাবে আমরা বিশেষভাবে চিন্তিত – যেমন সিজিওনির্য়াস রোগ, ইবোলা ভাইরাস, লিমে রোগ, হান্টা ভাইরাস। এদের প্রকোপ যদিও মহামারীর আকার নিতে পারে নি, তবে কে বলতে পারে ভবিষ্যতে আরও কোনও জীবানু মনুষ্যজাতিকে বিপদে ফেলবে না।’ এই প্রবন্ধেই মনুষ্যজাতির স্বার্থে বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও তার যথাযোগ্য প্রয়োগের উপর তিনি জোর দিতে বলেছেন। সেই সঙ্গে এই ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন –‘দুঃখের বিষয় এই নিয়ে চিন্তাভাবনা সঠিক পথে গবেষণার সহযোগিতায় প্রকাশ পাচ্ছে না।’ মানবিকতার স্বার্থে একজন চিকিৎসক হিসেবে ডাক্তার দাসের এই উদ্বেগকে অবশ্যই শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হয়।
ভিলাইতে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থা ও ‘মধ্যবলয়’ পত্রিকা। মাঝে মাঝে ঘরোয়া সাহিত্য সভা বসতো। ওনার বাড়ীতেও বেশ কয়েকবার সাহিত্য আসর বসেছে, সেখানে আমিও গেছি। এই সাহিত্য সংস্থার উনি একজন সুহৃদ। বেশ কিছুদিন উনি এই সংস্থার সভাপতি ছিলেন। দু’একবার দেখেছি, কিছু নীতিগত প্রশ্নে উনি সম্পাদকমন্ডলীর তীব্র সমালোচক ছিলেন। শুধু এই বিষয়ে নয়, যে কোন বিষয়ে ওনার এই স্পষ্টবাদীতা ছিল সর্বজনবিদিত। কেউ কিছু মনে করবে, এটা না ভেবে যা সত্যি মনে করতেন সেটাই তিনি বলেই ফেলতেন। আরো অনেকের মতো চুপচাপ মুখ গুঁজে বসে থাকতেন না। এ ব্যাপারে উনি ছিলেন একরোখা!
ডাক্তার হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। কিন্তু তার এই আপোসহীন মনোভাব, আর একরোখা স্বভাবের জন্যে চাকুরীজীবনে যথেষ্ট ভুগেছেন! সবার মতো ইয়েসম্যান হলে, অনেকের মতো আপোসপন্থী হলে, তার চাকুরী জীবনের শেষ দিকটা খুব নির্বিঘ্নে, অমসৃণ - আরামের সঙ্গে কেটে যেত। কিন্তু তা হয় নি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি, তিনি ছিলেন একজন সৎ ও ভালো মানুষ।
গরীব মানুষদের জন্যে তার মন কাঁদতো। প্রায়ই বলতে শুনতাম, ওনার মেদিনীপুরের গ্রামের মানুষদের দুঃখদুর্দশার কথা। কি করে মানুষের ভালো হবে এই চিন্তা সবসময়েই তার মনের গোপনে কাজ করতো।
তিনি ছিলেন একজন চিন্তাশীল মানুষ। ভিলাই-এর পত্রিকা ‘মধ্যবলয়’ তে তিনি একজায়গায় লিখেছেন, - ‘অন্ন ও জীবিকার চিন্তায় আমরা সবাই যখন আচ্ছন্ন, সাহিত্যই সেই ছায়াচ্ছন্ন নিরুদ্যম মনে ও প্রাণে উৎসাহের আলো দেখাতে সক্ষম’ [মধ্যবলয় – মব – জুলাই ১৯৮৫]।
বিভিন্ন সময়ে তিনি কিছু কিছু কবিতা লিখেছেন। যেমন, -
‘পথ মসৃণ, বড় পিচ্ছিল / অন্ধকার হলেও হৃদয় / চমকায় – বিদ্যুত বর্ণ / চোখের তারায়’ [মব – জুলাই ১৯৮৮]।
ডাক্তার সত্যরঞ্জন দাসের জন্ম 01.10.1930তে, হাওড়া জেলার কামালপুর গ্রামে। আদি নিবাস পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল অঞ্চলের কাপাসবেরিয়া গ্রামে। ডাক্তারি পাশ করেন পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে। চাকুরীসূত্রে তার আগমন ঘটে ভিলাইতে। আমি তাকে প্রথম দিকে দেখেছি ভিলাই টাউনশিপের সেক্টর নয়ের কোয়াটারে থাকতে। পরে নেহেরুনগর - ওয়েষ্ট (ভিলাই)এ নিজের বাড়িতে উঠে এসেছিলেন। একদম শেষের দিকে তিনি মুম্বাই-এর কান্দিভেলীতে চলে যান।
মুম্বাইতে কাকীমা (মিসেস দাস)ও উনি, ওনাদের ছেলে-বৌমা অংশুমান-শর্মিতাদের সাথে থাকতেন। দূরে থাকলেও উনি প্রায়ই খোঁজ খবর নিতেন ভিলাই-এর মানুষজনদের। কখনো কখনো ফোনেও কথা হতো। যোগাযোগ রাখতেন।
অল্প কিছুদিন আগের আরেকটা কথা মনে পড়ছে। আমার মেয়ে অনন্যা মুম্বাইতে কোম্পানীর কিছু কাজ করতে গিয়ে মুস্কিলে পড়েছিল। যেখানে বিশেষ কাজে গেছিল, সেখানকার কিছু আনসিডিউল বা না-পরিকল্পিত কাজ করতে করতে ওর দেরী হয়ে গেছিল। ওখানে থাকার সুবিধে মতন হোটেল খুঁজে পাচ্ছিল না। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। আমি মুম্বাইতে ডাক্তার বাবুকে ফোন করে ঘটনাটা জানালাম। উনি বললেন – ওনার ওখানে মেয়েকে পাঠিয়ে দিতে। মাঝ রাত পেরিয়ে একটা ক্যাব নিয়ে অনন্যা ওনার ফ্লাট কান্দিভেলীতে হাজির। মেয়ের আশ্রয় মিললো, আমরাও নিশ্চিন্ত হলাম।
গত ২০১৬ ডিসেম্বর মাসে ওনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়, কান্দিভেলী, বোম্বেতে, ওনার ফ্লাটে। আমি দেখা করে এসেছিলাম।
কাকীমা, মিসেস দাস, খুবই স্নেহশীলা মহিলা। আমাদের কিছু বন্ধুবান্ধবদের ওনার ভিলাই বাড়ীতে যাতায়াত ছিল। আমরা গেলে ওনারা খুশীই হতেন, যথেষ্ট আপ্যায়ণ করতেন। ডাক্তার বাবুর তিন ছেলে, সবাই প্রতিষ্ঠিত। ভরাপুরা সংসার রেখে পরিণত বয়সেই তিনি প্রয়াত হলেন, রেখে গেলেন অনেক স্মৃতি!
তার মৃত্যুতে ভিলাই হারালো এক সুহৃদকে। দেশ হারালো একজন ভালো মানুষকে। এমন অসামান্য ভালো মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে কমে যাচ্ছে – এ দুঃখটাই মনে রয়ে গেল।
======== =======
ভিলাই-এর পত্রিকা ‘মধ্যবলয়’ তে ওনার যে প্রবন্ধগুলো ছাপা হয়েছে, লেখাটির শেষে তার কয়েকটার উল্লেখ করলাম।
> মানবিক অস্তিত্বে বিপন্নতা এবং ক্ষীণ নীল বিন্দুটিরও [মব – অক্টোবর – ২০০০]
> চিকিৎসক কিছু বিপর্যস্ত, তবে হতাশ নয় [মব – এপ্রিল – ২০০০]
ভাষা প্রসঙ্গে [মব – জানুয়ারী – ২০০১]
> জিন জিনোম, জিন প্রযুক্তি ও ভবিষ্যত [মব – এপ্রিল – ২০০১]
> বার্ধক্য [মব – শারদীয়া- ২০০১]
> মানুষ কি ভগবানের সমকক্ষ হতে চললো? [মব – জানুয়ারী – ২০০২]
> বন্ধু – বিখ্যাত পুস্তক বিড়ম্বনা [মব – শারদীয়া- ২০০২]
> মানিয়ে নেওয়াই জীবন – ইমরে কার্ত্তেস [মব – শারদীয়া- ২০০৩/ নোবেলজয়ী সাহিত্যক ইমরে কার্ত্তেস এর উপর লেখা।]
> ধম্মপদ – প্রাচীন সাহিত্য [মব – নববর্ষ- ২০০৪]
> গাঙ্গেয় সভ্যতা কি বিপন্নতার সম্মুখীন?[মব – শারদীয়া- ২০০৪ ও তার পরবর্তী সংখ্যায়, দুই কিস্তিতে প্রকাশিত]।
> পৃথিবীর আধুনিকতম দ্বিপদ প্রানীটির আদিমতার সন্ধানে [মব – শারদীয়া- ২০০৫]
> নবচর্যাপদ ও শশীভূষণ – সাহিত্যিক ও দার্শনিক গুরুত্ব [মব – অক্টোবর জানুয়ারী ২০০৫]।
> গঙ্গার ভাঙ্গন [মব – শারদীয়া- ২০০৬]।
> সাহিত্যের উপযোগিতা [মব – শারদীয়া- ২০০৯]।
> বঙ্গ দেশের কীর্তন [ মব – নববর্ষ – ২০১২ ]
> মৌল মানবতন্ত্র [মব – শারদীয়া – ২০১২, এই প্রবন্ধে র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ]
> ভারতজ্ঞবিদ পশ্চিমী পণ্ডিতগন ও হিন্দু ধর্ম [মব – শারদীয়া- ২০১৪]।
> সাহিত্য পত্রিকার ভবিষ্যত [ মব – নববর্ষ – ২০১৫ ]
> বহির্বঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার ও প্রসার [ শারদীয়া – ২০১৯]
======== =======


Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

দয়াবতী, যাও, ফিরে যাও!