পাঠ প্রতিক্রিয়া : কাশ্মীরের কবিতা


[  আমার কথা কি শুনতে পাও?

হাওয়া বইছে উত্তরেহাওয়া বইছে দক্ষিণে

ছটফটাচ্ছে সমস্ত কথা-

আমার কথা কি শুনতে পাও?    – বি. ]

#

বর্তমান কাশ্মীরের উপদ্রুততাসেখানকার নানা সমস্যামানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে যখন নানা আলাপ আলোচনা চলছেতখনই হাতে এল একটা বই --- ‘কাশ্মীরের কবিতা বইটার প্রকাশক মন্থনসাময়িকীএটা কাশ্মীরের বিভিন্ন কবির লেখা কবিতার বাংলা অনুবাদ সংকলন

বইটার পাতা ওলটাতে ওলটাতে বসরত পীর-এর লেখা একটা বিবরণ পড়ে যে কেউ- থমকে যাবে --- ‘শ্রীনগর একটি বাঙ্কারের শহর বিশ্বের শহরগুলির মধ্যে সর্বাধিক সামরিক উপস্থিতি রয়েছেএখানে ... গত দেড় দশক ধরে এই শহরের রাতগুলো কারফিউতে হারিয়ে গেছে...’ তাঁরই লেখা Curfewed Night বই থেকে অনুদিত অংশের বিবরণে দেখি মধ্য শ্রীনগরের হাব্বাকাদাল অঞ্চল সম্পর্কে কিছুউক্তি এই অঞ্চল সম্পর্কে বলা হয়েছে --- “এখানে দেখার কিছুই নেইএটি এখন একটি ধ্বংসাবশেষ রাস্তা দিয়ে নেমে যানআপনি কিছু পোড়া ঘর-বাড়ি দেখতে পাবেন

সত্যিই কি ভূস্বর্গ কাশ্মীরের আজ এমনই একটা অবস্থাকেন  অবস্থাটা হলকেন তিনি এমনটা লিখলেনসে প্রশ্নে না গিয়ে এই অনুদিত কবিতার বইটা কিছুটা পড়ে নেওয়া যাক দেখা যাক ওখানকারকিছু মানুষজনের অনুভূতিতাদের কলমের কিছু লেখাতাদের মনোভাব

কবি আগা শাহিদ আলি ‘বিদায়বার্তা’ কবিতায় লেখেন ‘আমি স্বর্গের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছি নরকের নদী বেয়ে ...’ কিংবা ‘ওরা একটা করে বসতকে শ্মশান বানায় আর তার নাম দেয় শান্তি’ এই লাইনগুলোমনকে নাড়া দিয়ে যায় এই কবিতাতেই তাঁর দুটো লাইন --- ‘হ্রদের জলে মন্দির আর মসজিদের হাতগুলো একে অপরের / প্রতিবিম্বকে আঁকড়ে ধরে আছে মন্দির আর মসজিদের এই হাত ধরাধরি করেথাকার মধ্যে আমরা একটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইঙ্গিত পাই! --- তাহলে সব মানুষেরা সবসময়ই ধর্মান্ধ হয় না?

হিস্টিরিয়া’ (‘জমিন আঁকড়ে পড়ে থাকো কাশ্মীর’) কবিতায় মারিয়াম আলা আমজাদি যে ছবি আঁকেন তা আতঙ্ক  বিভীষিকার এখানে জন্মগত প্রতিরোধের কথাও উঠে আসে ---

জমিন আঁকড়ে পড়ে থাকো কাশ্মীর

আতঙ্ক আর বিভীষিকা

তোমার প্রতিদিনের দোস্ত

এমনকী মায়ের পেট থেকে পড়েই

নাদান শিশুরাও জেনে গেছে কীভাবে চিৎকার করতে হয়

শব  সরোবর’ কবিতায় কবি সাবির ‘আজার’ লেখেন ---

সরোবরের আয়নায়

কী দেখা উচিত আমার ...?

জলের গভীর থেকে

অচেনার মতো এক শব

চেয়ে থাকে

অপলক ...’

ভারী সুন্দরকাব্যময় এই কবিতা সরোবরের আয়নায় আকাশ নয়জলজ জীবন নয়সেখানে দেখা যাচ্ছে ‘শবদেহ বড়ো মর্মস্পর্শী  করুণ এই দৃশ্যসত্যিই কি এরকমটাই কাশ্মীরের অবস্থা?

অর্জন দেব কাউল ‘মজবুর’ তাঁর কবিতা ‘কাশ্মীর’- লেখেন ---

কত নদী-ছবি লাল হয়ে গেল বোবা মানুষের রক্তে!

আমার মায়ের কমনীয় মুখ কে পোড়াল এই রাজ্যে?’

আফ্রিন ফরিদি ‘চিনার তলায়’ কবিতাটিতে লেখেন, --- ‘পোয়াতি মেয়েটি যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল’! এই লেখাটির পাদটীকা থেকে আমরা জানতে পারি১৯৯১ সালে সেনাবাহিনী ৩১ জন মহিলাকে গণধর্ষণকরেছিল এই কবিতাটা তারই পরিপ্রেক্ষিতে লেখা

অশান্ত কাশ্মীর তার দগ্ধ মুখ দেখায় এই সংকলনের কবিতার ছত্রে ছত্রেকারণ সেটাই হয়তো কাশ্মীরের প্রচলিত অবস্থা ‘শাহজাদা’ রফিক তাঁর ‘বিক্ষোভ জাগছে’ কবিতাটির সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরেনসেখানকার অবস্থা --- ‘পাগল হাওয়া আর আগুন / বিক্ষোভ জাগছে / লাশ --- বিবস্ত্র --- কবর / বিক্ষোভ জাগছে

 

এম সি কাস ‘আমার প্রতিবাদ’ কবিতায় সোচ্চার হয়ে ওঠেন দমনপীড়নের বিরুদ্ধেপ্রচলিত রাজনীতির বিরুদ্ধেধর্ষণ  হত্যার বিরুদ্ধে তিনি তাই লেখেন --- ‘আমার প্রতিবাদ আমার ভাইয়ের জন্য / যেমৃত / আমার প্রতিবাদ সেই বুলেটের বিরুদ্ধে / যা তার মাথায় বিঁধে আছে

কিংবা

বিশ্বাসঘাতক পুতুল রাজনীতিক সব যাদের ভেতর কোনো আত্মা নেই / তারা ছল চাতুরীর সুতোয় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে গণভোট নামের শব্দটিকে / আমার জান্নাত জ্বলছে সামরিক বাহিনীর হাতে

আগা শাহিদ আলি- আরেকটা কবিতা ‘যে দেশে কোনো পোস্ট অফিস নেই’ থেকে পড়ে নেওয়া যাক একটা লাইন --- ‘আবার আমি সেই দেশে ফিরে এসেছি যেখানে একটা মসজিদের চূড়াকে কবরেপাঠানো হয়েছে’  লাইন ভয়ঙ্করএটা পড়ে ধর্মনিরপেক্ষ দেশের বিবেকবান মানুষ অবশ্যই চমকে উঠবেএই কবিতারই গদ্য ঢঙে লেখা কিছু কবিতার লাইন আমাদেরকে দিয়ে প্রশ্ন করায়এমনটাই কিবর্তমান কাশ্মীরের পরিস্থিতি? --- “ ‘আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমরা অন্ধকার খুঁজি’ চেঁচিয়ে উঠল রাস্তার খ্যাপাটে লোকটা, ‘আমি সেই লোকটা হতে চাই যে রক্ত ঢেলে দ্যায় তোমার হাতদুটোশুকানোর জন্যে ...”

 

শ্রীময়ী নন্দিনী ঘোষের ‘কারফিউর শ্রীনগর ধরা আছে দিনলিপির ঢঙে একাধিক কারফিউ দিনের বর্ণনা পেছনে দেওয়া পরিচয়-লিপিতে শ্রীময়ীর পরিচিতি নেইজানতে ইচ্ছে করে তিনি কাশ্মীরের মূলনিবাসী কি নাসে যাই হোকঅসাধারণ দক্ষতায় শ্রীময়ীর লেখনীতে উঠে এসেছে কাশ্মীরের দিনযাপনসেখানকার উপদ্রুত সময়ের কথা দীর্ঘ এই কবিতামালার উচ্চারণ  কৃত অনুবাদ সহজ ওমর্মস্পর্শীযেমন,

শহরটা নির্বাক ছায়াছবি যেন

রাস্তাগুলো ফাঁকা

সমস্ত পৃথিবী যেন আড়ষ্ট গতিহীন স্থির

খালি চুপিচুপি হাসপাতালে চলে যাচ্ছে

অসংখ্য শিশুর শরীর

কিংবা

কাশ্মীরে পৌঁছালো বিশ্বস্ত সূত্রের খবর

ক্যামেরা লাগানো আর রিমোট চালিত একটি বোমা

ঘুরপাক খাচ্ছে নিচে কারফিউ স্তব্ধ শহরে

কিংবা

টিভি বন্ধ হয়ে গেছে

খবরের কাগজের অফিসে ভাঙচুর

দূরভাষ বন্ধ আছে বহুদিন হল

#

মসজিদ বাকরুদ্ধ শুক্রবার থেকে

ইন্টারনেট খুঁড়িয়ে চলছে কোনোমতে

আমাদের সাথে গোটা পৃথিবীর

যোগাযোগ কোনোমতে রেখে

শোনা যায় দুজন ট্রাকচালক

রাস্তায় খুন হয়েছে গতকাল রাতে

#

তাই হাইওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে

 

কারফিউর  সময় চিত্রণে অনুমান করতে অসুবিধা হয় নাকেমনভাবে সময়ে সময়ে বরবাদ হয়ে যাচ্ছে কাশ্মীরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা!

পেয়ারে ‘হতাশ’ নামধারী কবি লেখেন ‘গজল ’ কবিতাযার সোজাসাপটা -টা লাইন তুলে দেওয়া যাক এখানে --

সে কেযে মারা গেছেসেই বা কে যে খুন হয়েছে!

সর্বত্র কাফনে মোড়া সেলাই করা মৃতদেহ দেখো

মরুবালুরা তোমরা সব দেখো!’

 যেন মৃত্যু উপত্যকার এক নির্মম চিত্র!

মোট ৪২ পাতার এই কবিতার বই ‘কাশ্মীরের কবিতা এই কবিতার লাইনগুলোতে লেখক কবিরা কিন্তু সরাসরি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য বা বিতর্ক রাখেননি তাঁরা সরাসরি লেখেননি ভারতীয়সংবিধানের ৩৭০ ধারার কথাজম্মু কাশ্মীর পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট-এর কথা, AFSPA-1990 আইনের কথামানবাধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা কারণ সরাসরি এসব কথা কবিতার বিষয় হতেপারে না কিন্তু এসব বিষয়গুলো কবিতাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে

এখানে কাশ্মীরের কবিতার মধ্যে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাসকান্নাবিক্ষোভ,  চিৎকারপ্রতিবাদ কবিদের আহত উচ্চারণই মনে করিয়ে দেয়উপদ্রুত অঞ্চলে শুধুমাত্র সন্ত্রাস দমনই নয়কাশ্মীর সমস্যা নিয়েতৃণমূল (grass-root) স্তরে অনেক কিছু চিন্তাভাবনার এবং কিছু কিছু কাজ করবার প্রয়োজন এখনও আছে

=====================      সমরেন্দ্র বিশ্বাস

সমালোচনাটি মন্থন সাময়িকীমার্চ-২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত #

আলোচিত পুস্তিকাকাশ্মীরের কবিতা প্রকাশকমন্থন সাময়িকীরবীন্দ্রনগরকলিকাতা-১৮ মূল্য-৩৫টাকা ]


Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

দয়াবতী, যাও, ফিরে যাও!