কবিতা ভাবনা [ রংরুট ]

 



মুখোমুখি সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

 

মুখোমুখি সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

সম্পাদক রংরুট: সকলের আগে ত্রৈমাসিক রংরুটের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।রংরুটেরএই বিশেষ সংখ্যায় আপনাকে স্বাগতম। আপনার লেখালেখির পরিধি মূলত কাব্যসাহিত্য কেন্দ্রিক। কবিতার প্রতি এই বিশেষ আগ্রহের সূত্রপাত ঠিক কি ভাবে?

 

সমরেন্দ্র বিশ্বাস:  আমার লেখালেখির শুরু অবশ্যই কবিতা দিয়ে। বাচ্চা বয়সে ট্রানজিস্টার রেডিওতে বা মাইকে গান শুনতামখাট পেতে পাড়ার কোন বাড়ির উঠোনে রবীন্দ্র জয়ন্তী হতোতাতে ছড়া বা ছোট খাটো কবিতা বলার সুযোগও মিলে যেতঘরে বৃহস্পতি বারে লক্ষীর পাঁচালি পড়া হতোশ্রাবণে সারা মাস ধরে পিসি ও প্রতিবেশীরা মিলে সুর করে মনসামঙ্গল পাঠ করতো। এ সবের মধ্য দিয়ে কখন যে নিজের মধ্যে কবিতা ঢুকে গেলনিজেই জানি না। 

 

 

কাঁচরাপাড়ার কাছেই জোনপুর অঞ্চলের মফস্বল স্কুলক্লাস সেভেনে আমার স্কুলে পড়াতে এলেন শুভঙ্কর ঘোষ (সাহিত্যিক ও পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক স্কটিশ চার্চ কলেজকোলকাতা) ওনার সংক্ষিপ্ত সান্নিধ্য আমার কাছে কবিতার জগতটাকে আরো খুলে দিলো। আরো যখন ছোট ছিলামসেই সব বাচ্চা বয়সে কবিতারা ঘুরে বেড়াতো ভোরের মালতী ফুলেকাঁঠাল গাছের নীচে ভিজে মাটিতে - ছায়ার মধ্যে গজিয়ে ওঠা বড়ো বড়ো ঘাসেকিংবা সঙ্গিনীর সঙ্গে রান্নাবাটি খেলতে খেলতে হঠাৎ ভেসে আসা কোকিলের ডাকে! এসবের মধ্য দিয়ে কি করে যে কবিতারা ভর করেছিল সেসব বোঝানো মুস্কিল। তবে পরিণতঃ বয়সে বুঝেছিকবিতারা সর্বত্রই ঘুরে বেড়ায়তাতে জান্তে-অজান্তে সব মানুষই কখনো না কখনো কম- বেশী সংক্রামিত হয়।  

 

 

সম্পাদক রংরুট: আমরা জানি কবিতা প্রকাশের বিষয়ে আপনি  খুবই  যত্নশীল একজন মানুষ। নিজের সৃজনশীলতার বিষয়ে অত্যন্ত বেশি রকমের নিষ্ঠাবান না হলে এই যত্নশীলতা অর্জিত হয় না। এই বিষয়ে আমরা জীবনানন্দ দাশের কথা স্মরণ করতে পারি। প্রতিটি কবিতার পিছনে আপনার যে পরিশ্রম যে অধ্যাবসায় ও যত্নশীলতা বর্তমানতার অনুপ্রেরণার উৎস কি?

 

সমরেন্দ্র বিশ্বাস:  লেখালেখির বিষয়ে আমার যত্নশীলতা ঠিক কোন পর্যায়ে অবস্থান করেতা জানি না। তবে আমি এটা বিশ্বাস করিযে কোন কবিকে অবশ্যই যত্নবান হতে হয়। এ ব্যাপারে জীবনানন্দের যত্নশীলতা তো প্রবাদ প্রতিমশুনেছি প্রেসে লেখা ছাপাতে যাবার পরও তিনি বেশ কয়েকবার সেগুলোকে পরিমার্জনা করতেন। শুধু কবিতা কেনযে কোন সৃজনশীল মানুষের এটাই স্বাভাবিক ধর্ম। যিনি ছবি আঁকেনক্যানভাসের উপর একটা ছবির জন্যে তিনি কতবার যে তুলি বোলানরঙ পাল্টানরেখাগুলোকে পুরো মুছে ফেলেনআবার নতুন করে আঁকেন এমনি ভাবেই তৈরী হয় একটা সুন্দর ছবি। একধরণের অধ্যাবসায় ও যত্নশীলতাই যে কোন সুন্দর নির্মানের জন্যে জরুরী -  কবিতার ক্ষেত্রেও সেটাই সত্যি। একটা লেখা হয়ে যাবার পর সেটা একক থেকে বহুত্বের দিকে চলে যায়এই কারণেই কবিকেও যত্নশীল থাকতে হয়বারবার ভাবতে হয় ঠিক লেখা হচ্ছে তোঅবশ্য আজকাল মাস-প্রোডাকশনের যুগেকিংবা নিজেকে চটজলদি মঞ্চে প্রকাশের তাড়নায় কেউ কেউ কখনো কখনো কবিতা লেখার ক্ষেত্রে যত্নশীল হতে ভুলে যান, - সেটা অবশ্যই কাম্য নয়। জীবনানন্দ দাশের একটা উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে – ‘নিছক বুদ্ধির জোরে কবিতা লেখা সম্ভব নয় আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন – ’ – এখানেই আসে সৃজনশীলতা সম্পর্কে যত্নবান হওয়ায় বিষয়টাব্যক্তিগত নিষ্ঠার প্রশ্ন।

 

 

সম্পাদক রংরুট: এই প্রসঙ্গে জানতে চাইবো কবিতার কাঠামোগত দিকের বিষয়ে একজন কবিরনৈর্ব্যক্তিক ও শৈল্পিক ধ্যানধারণা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন কি আপনিকবির ব্যক্তিগত আবেগকে সাহিত্যের নান্দনিকতায় বিকশিত করতে যা খুবই মূল্যবাননাকি কবিতা মূলত  আবেগের  বহিঃপ্রকাশমাত্রঅনেকেই যেমনটা দাবি করেন আজকাল।

 

সমরেন্দ্র বিশ্বাস:  কবিতা মূলত মনের আবেগের বহির্প্রকাশ হলেও তার সঙ্গে নান্দনিকতা না জুড়লে সেটা সার্থক লেখা হয়ে উঠতে পারে না। তাই একজন কবির শৈল্পিক ধ্যান ধারণা থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয়। কবির ব্যক্তিগত আবেগকে শৈল্পিক নান্দনিকতার মধ্য দিয়ে বিকশিত করে তুলতে হয়। তবে এখানে একটা কথা -  ‘নৈর্ব্যক্তিকশব্দের অভিধানিক অর্থ যা ব্যক্তিসম্পর্কিত নয়। মানুষ ব্যক্তির মধ্য দিয়েই সমগ্রে পৌঁছায়কবিতার ক্ষেত্রে পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক থাকা কি সম্ভবএই নৈর্ব্যক্তিক ধ্যানধারণার বিষয়টি আমার কাছে তত স্পষ্ট নয়তাই এ ব্যপারটি আরো বেশী আলোচনার অপেক্ষায় রইলো। এ পর্যন্ত কবিতা নির্মানে কাঠামোগত ভাঙ্গচুর প্রচুর হয়েছেভাবনাগত নতুনত্ব এসেছেকবিতাতে কোন বাঁধাধরা অর্থ না-খোঁজার দাবী এসেছেচিত্রকল্প আরো বেশী বৈচিত্র্যময় হয়েছে এর কোনটাকেই অস্বীকার করা যায় না। তবে মনে রাখতে হবে শৈল্পিক নান্দনিকতাব্যক্তিগত আবেগ এসবের মধ্য দিয়েও কবিতা যেন তার পাঠকদের কাছে হৃদয়গ্রাহী হয়ে পৌঁছাতে পারেসেখানেই একজন কবির সার্থকতা।  

 

 

সম্পাদক রংরুট: আপনার কবিসত্তার ভরকেন্দ্র শাশ্বত মানবিক সংবেদনশীলতায় নাকি নির্মোহ দার্শনিক বিশ্ববীক্ষায়কবিগুরু বলতেনতিনি দার্শনিক নন। তিনি কবি। দর্শন ও সাহিত্যের ভিতর একটি দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের পালা চলতে থাকে। অন্তত রবীন্দ্রকাব্যের বিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রাখলে বিষয়টি দেখা যায়। এই বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত। জানতে চাইছি বিস্তারিত আলোকপাতে।

 

 সমরেন্দ্র বিশ্বাস:  যে কোন মানুষেরই নিজস্ব একটা দর্শন থাকেযেটা গড়ে ওঠে পৃথিবী সম্পর্কিত তার নিজস্ব অভিজ্ঞতাঅধ্যয়ণ ও ধ্যানধারণা থেকে। সেই দার্শনিক বিশ্ববীক্ষা প্রত্যেক মুহুর্তেই আমাদের চিন্তাভাবনাআমাদের সংবেদনশীলতাকে পরিচালিত করে। কবি যখন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে লেখায় চিত্রিত করেঅজান্তেই সেই দর্শন তার  লেখার মধ্যে চলে আসেতার গ্রন্থে আত্মগোপন করে থাকে। যে কোন দর্শনই দ্বন্দ্বময়সময়ভেদে তা পরিবর্তিত হতে পারে। এজন্যে এটা ঠিকই বলা হয়েছে যে দর্শন ও সাহিত্যের মধ্যে সবসময়ই একটা দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল। কে বলেছে রবীন্দ্রনাথ দার্শনিক ননব্রাহ্ম পরিবেশমানবতাবাদভারতবর্ষের ও পৃথিবীর তৎকালীন জীবন তার দর্শনকে প্রভাবিত করেছিল। রবীন্দ্রকাব্যের বিবর্তণের বিষয়টা তো আলাদা ভাবে আলোচনার বিষয়। তবে যে কোন কবির ক্ষেত্রে এই বিবর্তনগুলো সত্য ও স্বাভাবিক। তাই যে কোন কবির ক্ষেত্রে প্রায়শই দেখি তার লেখা বাঁক নিয়েছেতার ভেতরকার ব্যক্তি-দর্শনের প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া দ্বন্দ্ব ও তার সমন্বয়ই এর প্রধান কারণ! ঋষি অরবিন্দের বিপ্লববাদ থেকে অন্য এক আধ্যাত্মিক উপলব্ধির বিশাল রচনাকিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথমজীবনের ফ্রয়েড প্রভাব থেকে পরবর্তী সময়ের সাহিত্যে তীব্র সমাজমুখীনতা এসব তো দর্শনগত বিবর্তনেরই উদাহরণ!

 

 

সম্পাদক রংরুট: সাহিত্যসাধনা বা কাব্যচর্চার প্রসঙ্গে কবি  জীবনানন্দ পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাসচেতনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে একজন কবির জন্য এই পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও ইতিহাস চেতনা কতটা জরুরী বিষয় বলে মনে করেন আপনিআপনার নিজের কবিতায় এই বিষয়গুলি    কতটা প্রাসঙ্গিক ও কি ভাবে দেখা দেয়?

 

সমরেন্দ্র বিশ্বাস:  সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাস চেতনা অবশ্যই জরুরী। সেটা না হলে লেখায় পরিপূর্ণতা আসে না তা সে গদ্য হোক বা কবিতাই হোক। রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকাএজন্যেই একটা পরিপূর্ণ কবিতা! আল মাহমুদ যখন ম্যাকসিম গর্কি স্মরণেকবিতাটি লেখেনতখন বোঝা যায়তিনি সময় বা ইতিহাস-বিচ্ছিন্ন কোন সত্ত্বা নন! সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের রানারকবিতাটি ১৯৪৬ সালের সারা ভারত ডাক-তার ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা- যা তার তৎকালীন সময়ের চেতনায় সম্পৃক্ত। আমার লেখাতেও স্বাভাবিক ভাবেই কবিতার মধ্যে নানা জায়গায় উঠে আসে টুকরো টুকরো ইতিহাসের অনুসঙ্গ।  আসে তিতুমীরের কেল্লার কথা [পাড়া]গ্যাস কান্ডে ছটফটানো ভারতবর্ষের কথা [ভূপাল ডিসেম্বর ১৯৮৪]। কবিতায় লেখা হয় ব্যাবিলনের ওড়না আর হোয়াংহো নদীর দুঃখের কথা [হাওয়া শিকার]উঠে আসে গ্যালিলিওর মুখ [সত্য]। রাজা আর রাজনৈতিক মানুষদের নির্দেশে সাধারণ মানুষেরা একজন অন্যজনের সঙ্গে উপায়হীন বীভৎস লড়াইতে মেতে ওঠেতারই প্রসঙ্গে আমার কবিতায় উঠে আসে রোমান সাম্রাজ্যের এরিণা আর স্পার্টাকাসের কথা [স্পার্টাকাসের মাথা]। এই কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাস চেতনা শুধু আমার লেখাতেই নয়যে কোন সংবেদনশীলসময় সচেতন লেখক বা কবির লেখায় অনিবার্য ভাবে উঠে আসবে। 

 

 

 সম্পাদক রংরুট: মহাকবি টি এস এলিয়টের ভাষায়, “No poet, no artist of any art, has his complete meaning alone. His significance, his appreciation is the appreciation of his relation to the dead poets and artists.  You cannot value him alone; you must set him for contrast and comparison among the dead.”  আপনিও কি এলিয়টের   মতো এই  মতে    বিশ্বাসীআপনার নিজের কাব্যসাধনায় কতটা  সত্য এই দর্শনঅর্থাৎ আপনার কবিতার পাঠককেও কি আপনার কবিতা অনুধাবনে এই পথেই অগ্রসর হতে পরামর্শ দেবেন আপনিনাকি আপনার অবস্থান কিছুটা ভিন্নমাত্রায়।

 

সমরেন্দ্র বিশ্বাস:  আমার পূর্বজ কবি ও শিল্পী এরা অবশ্যই অনুসরণীয়। তারা আমাদের জন্যে রেখে গেছেন অমূল্য সব সম্পদ। আমাদের উচিত সম্ভবমতো তাদেরকে জানা ও বোঝা। পুর্বজ কবি ও শিল্পীদের সৃষ্টিকে পুঁজি করে নিজস্ব লেখালেখির সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হলেওবর্তমান সময়ের কবিদের উচিত আরো কিছু নতুন করে ভাবানতুনতর কিছু সৃষ্টি করা। আমি যেটা বলতে চাইছিপ্রবীন ও প্রাচীন কবিদের অধ্যয়ণ করোকিন্তু পুরোণোতে আটকে থাকলে চলবে নাকয়েক কদম এগিয়ে আরেকটু অন্য রকম সৃষ্টি এটাই প্রগতির নিয়ম। আমার কবিতার পাঠক আমার থেকে কতটা কি নেবে তা জানি নাতবে উল্টো আমি পাঠকদের চিন্তাভাবনার মধ্যে সব সময়তেই রসদ খুঁজতে থাকি। শুধু মাত্র পূর্বজ কবি কেনঅনেক অনুজ কবির কাছ থেকে আমি অনেক সময় অনেক কিছুই শিখতে চেষ্টা করি।

 

 

সম্পাদক রংরুট: ইংল্যাণ্ডজাত মার্কিন কবি ডবল্যু এইচ অডেন গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেনএকজন কবি সবি কিছুর আগে সেই ব্যক্তি যিনি তাঁর ভাষার প্রেমে পড়ে গিয়েছেন। আমাদের এত ভালোবাসার এত দুর্দশা পীড়িত তবুও সংগ্রামী বাংলাভাষার একজন কবি হিসাবে এই বিষয়ে আপনার অবস্থান সম্বন্ধে যদি আলোকপাত করেন স্পষ্টভাবে। কবিতা কি সত্যই এমন নিবিড় ভাবে বিশেষ কোন ভাষা নির্ভর হতে  পারেনাকি অডেনের এই মতকে আমরা কবিতার নিজস্ব ভাষা বলে ধরে নেবো। যেমন চিত্রশিল্পের ভাষাচলচিত্রের ভাষা ইত্যাদি।

 

 সমরেন্দ্র বিশ্বাস:  কবিতা প্রকাশিত হয় মাধ্যম ভাষা। তাই কবিতাকে ভালোবাসতে গেলে ভাষাকে ভালোভাবে জানতে হবে। ভাষার মধ্যে জুড়তে হবে ভাবনাকে। আবেগ ও শিল্পের নান্দনিকতাকে মেলাতে হবে কবিতায়। আমি এখন থাকি ছত্তিশগড়ের হিন্দী ভাষাবলয়ে। যেহেতু আমি বাংলা ভাষাকে ভালোবাসিএটা আমার মাতৃভাষা তাই আমি বাংলাতেই কবিতা লিখি। ইংরেজী ভাষাটা জানলেওসে ভাষায় কখনোই আমি কবিতা লিখতে চেষ্টা করি নিকিংবা একটু ঘসামাঝা করে কখনো চেষ্টা করি নি স্বল্প-জানা হিন্দীতে ছোট্ট দুএকটা লাইন লিখে ফেলতে। কেউ কেউ যেমন একাধিক ভাষায় লিখতে পরেন। আমি পারি না। হতে পারে এটা আমার সীমাবদ্ধতা। কিংবা বলতে পারেন এটাই কোন এক কবির তার নিজস্ব বাংলা ভাষার প্রতি প্রেম।

 

চলচিত্রের ভাষাচিত্রশিল্পের ভাষার মতো কবিতারও নিজস্ব ভাষা আছে ধরা যাক তার নাম দেয়া হলো কবিতা-ভাষা। এই কবিতা-ভাষাটা কিন্তু দেশজাতি বা বিশেষ কোন বর্ণমালা নিরপেক্ষ। একজন বাংলাভাষী মানুষের প্রেমের আবেগএকজন ফরাসী মানুষের প্রেমের আবেগ একই রকম। এই মানবিক আবেগটাকে কবিতাতে যে কোন আলফাবেট বা বর্ণমালায় প্রকাশ করা যেতে পারেতবে সেটা যেন কবিতা-ভাষাতে লেখা হয়।

 

কোন বিশেষ ভাষভাষী কবি কবিতাকে যখন কাগজ কলমে কবিতাকে লেখেনসে এক সেট বিশেষ বর্ণমালা বা একটা জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত ভাষা ব্যবহার করে। সেই মাধ্যমটা আমার জন্যে বাংলা। কবিতা-ভাষাকে মনে রেখে আমি আমার কবিতাগুলোকে বাংলাভাষাতেই লিখি বা লিখতে চেষ্টা করি। অবশ্যই বাংলাভাষা একটা সংগ্রামী ভাষা। বর্তমান বিশ্বায়ণের যুগে বাংলা ভাষাকেও লড়াই করে টিকে থাকতে হবে। তবে আশার কথাআমাদের সঙ্গে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলাভাষা। 

 

 

সম্পাদক রংরুট: ভাষার প্রসঙ্গই যখন উঠলোতখন বিশেষ করে জানতে ইচ্ছা করছে আমাদের এই বাংলাভাষা আপনার ব্যক্তিগত জীবন সত্যের সাথে ঠিক কি ভাবে জড়িয়ে আছেনাশুধু মাত্র কবিতা লেখা বা সাহিত্য সাধানার একটি মাধ্যম হিসাবে নয়। একজন অনুভুতিশীল সচেতন বাঙালি হিসাবে।

 

সমরেন্দ্র বিশ্বাস: বাংলাভাষা জড়িয়ে আছে আমার চেতনায়। আমার চিন্তা ভাবনায়আমার দৈনন্দিন জীবনে। বাংলাভাষা শুধুমাত্র আমার কবিতা লেখার ভাষা নয়এটা আমার জীবন চর্চা। যখন অফিসেরব্যাঙ্কের বা ব্যবসায়িক কিছু কাজ ইংরেজীতে করিসেটা আমার দায়। কিন্তু যখন ভাত খাইরাস্তায় হাঁটিচিন্তা করি কিংবা স্বপ্ন দেখিসেটা বাংলা ভাষাতেই। বিভিন্ন সময়ে আমাদের বাংলা ভাষার মধ্যে কিছু কিছু অন্য ভাষাও ( যেমন ইংরেজীহিন্দীউর্দু ) ঢুকে গেছে ভাষার প্রবাহমানতার মুখ চেয়েএকটা বহুভাষিক দেশেবিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে এটাকে মেনে নিতেই হবে।  অনুভূতিশীল বাঙ্গালী হিসেবে বাংলা ভাষার ব্যাপারে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই গানটা আমার ভেতরে অনবরত বাজতে থাকে – ‘ আমি বাংলায় গান গাই ……… ’

 

 

সম্পাদক রংরুট: সাহিত্যদর্শন বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিবর্তনের পথে আমরা যে অনেক দূর এগিয়ে এসেছিসে কথা হয়তো বলাই যায়। কিন্তু সমাজ সংসারবিবর্তনের পথে বিগত দুই হাজার বছরের হিসাবটুকুই যদি ধরি খৃষ্টাব্দের সূত্রে- তাহলে সত্যই কতটুকু এগোলো মানুষের সমাজ সংসার সভ্যতাআপনার মূল্যায়ন।

 

সমরেন্দ্র বিশ্বাস: বর্তমান সভ্যতার পথ ধরে মানুষের সমাজসংসারসভ্যতা অনেকটাই এগিয়েছে। ডিজিটাল যুগে আমরা অনেক কিছুকেই একটা সংখ্যা দিয়ে চিনছি। আমরা ভিডিও কনফারেন্সিং করে সাহিত্য বা সামাজিক সম্মেলনগুলো আজকাল সেরে ফেলছি। এতে মানুষ মানুষের সঙ্গে তার সরাসরি সামাজিক সংযোগটাকে হারিয়ে ফেলছে। যৌথবদ্ধ সমাজ ভেঙ্গে যাচ্ছে। দিনে দিনে মানুষ নিঃসঙ্গ আর একেলা হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারটা নিয়ে আমি অবশ্যই চিন্তিত। আমার ভয় হয় শুধু মাত্র সাহিত্য বা কবিতা দিয়ে এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা গুলোকে জোড়া দেয়া সম্ভব না। চাই ফেলে আসে পুরোনো দিনগুলোর মতো যৌথবদ্ধ সামাজিক জীবন যেখানে মানুষকে তার আধুনিক আরাম আয়েষ কিছুটা ছাড়তে হবেকিন্তু মানসিক দিক থেকে সে অবশ্যই বেশী সুখে থাকবে।

 

 

সম্পাদক রংরুট: সব শেষে এসে জানতে চাইবো আপনার ব্যক্তিগত সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি সমসাময়িক কার   কার কবিতাচর্চা আপনাকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেযেখান থেকে বাঙলা কাব্যসাহিত্যের অদূর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আপনি প্রবলভাবে আশাবাদী ভুমিতে অবস্থান করতে পারেন।

 

সমরেন্দ্র বিশ্বাস: প্রথম জীবনে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিল আমার কবিতার অনুপ্রেরণা। জীবনানন্দ দাশশক্তি চট্টোপাধ্যায় শিখিয়েছে কবিতার গভীরতা।  নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,  সমর সেন এনাদের কবিতাও আমার খুব ভালো লাগে। তাছাড়া  আমার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কবি শঙ্খ ঘোষ তো কবিতার দুনিয়াতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।  রনজিৎ দাশজহর সেন মজুমদারবিভাস রায়চৌধুরীজয় গোস্বামী - এনারা এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি। ইন্টারনেট এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কবি  কচি রেজার কবিতা পড়িমুগ্ধ হই। সাম্প্রতিক সময়ের বিকাশ সরকারশুভঙ্কর দাসতাপস রায়বেবী সাউতিলোত্তমা বসুশামসুল হক আজাদসৌমনা দাশগুপ্তা এরাও খুব ভালো লিখছেন। বাংলা কবিতার বিশাল পটভূমি- এখানে কাকে বাদ দিয়ে কার নাম করবো?  এসময়ে কবিতার দুনিয়াতে এগিয়ে এসেছেন অনেক তরুন- তরুনীবলিষ্ঠ তাদের লেখাভিন্নতর সেসব আঙ্গিকচমকপ্রদ তাদের ভাবনা তাদের কবিতা পড়িখুব ভালো লাগে। সব মিলিয়ে বাংলা কাব্যসাহিত্য সম্পর্কে আমি খুবই আশাবাদী।

 

 

সমরেন্দ্র বিশ্বাসের জন্ম কোলকাতায়১৯৫৭ সালে। স্কুল জীবন কাঁচরাপাড়ার জোনপুর হাই (এইচ এস) স্কুলে। এর পরে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক। চাকুরীসূত্রে ভিলাই স্টীল প্লান্টের আধিকারিক ছিলেনসম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত । ভিলাইতে ১৯৮০ থেকে দীর্ঘ বসবাস। ইতিপূর্বে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে -  তবু স্পন্দমান পথ (১৯৮৬)সময়ের পদাবলী / স্রোতে স্রোতে ভাসমান ভেলা (১৯৮৯)হাওয়া শিকার (১৯৯৫)পিতৃস্মৃতি,উদ্বাস্তু শিক্ষিকা ও অন্যান্য কবিতা (২০০৫)হাফিজের ফেয়ারওয়েল (২০১৫)অনন্ত জলশব্দে আমি (২০১৬) । সমরেন্দ্রর প্রকাশিত বেশ কিছু গল্প বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। স্থায়ী নিবাস কাঁটাগঞ্জ জেলা নদীয়া

 

কপিরাইট রংরুট কর্তৃক সংরক্ষিত

 

 রংরুট – শ্রাবণ ১৪২৭ / প্রকাশিত – 09/08/2020

Link :-

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=3379185462101476&id=100000301678954&sfnsn=wiwspmo&extid=N4Ifkp1KuQv8LTOP

 

Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

দয়াবতী, যাও, ফিরে যাও!