রণজয়ী নই , তবু যুদ্ধক্ষেত্রে আমি / স্মৃতিকথা
# ১ #
কিছু দিন ধরেই চলছিল ভেতর আর বাইরের লড়াই । বাড়ি আর
হাসপাতাল ।সেদিন সকালে খবরটা হঠাৎ উড়ে এলো, বুক ভেঙ্গে শব্দ বেরিয়ে আসতে চাইলেও,
সেই কান্না একটা পাথরের পিন্ড হয়ে মাঝ আকাশে আটকে গেল। তমালের
মারা যাবার খবর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো ।গার্ডেনরীচ এলাকার বয়স্ক শ্রমিক ,
ভবানীপুরের বন্ধু ট্যাক্সিয়ালা , যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ধূসর ময়দান , টিউশনি পড়ানো
পুরোনো ছাত্রটির ডাক্তারি স্টেথোস্কোপ , শহরের কিছু পরিচিত লেখক- কবি বন্ধুদের কলম
, বেশ কিছু লিটল ম্যগাজিনের খোলা পাতা , দূর বিদেশে থাকা বন্ধুটির মুঠোয় ধরা
স্মার্ট ফোন , বাড়ির সামনে রুটি-তড়কা বেচা পুরোনো দোকানদার – যেসব কিছুর সঙ্গে
তমালের পরিচয় ছিলো – তারা কি সবাই থমকে গেলো ? হ্যাঁ – থমকে যাবারই তো কথা ! কেউ কি শব্দ করে কেঁদে উঠলো ? না , কার জন্যে
কাঁদবে ! যদিও বা চোখ থেকে কারো কারো দুঃখ গড়িয়ে পড়তে চাইলো, মুহুর্তেই তা বাষ্প হয়ে ভেসে রইলো আকাশে । সত্যিই
তো , কার জন্যে কাঁদবো আমরা ? তমাল তো এক আশ্চর্য ম্যাজিশিয়ান – যে কান্নার বদলে
চোখের তারা থেকে বের করে আনতে পারতো নীল ফুল , যে অনায়াসে যন্ত্রণাকে পাল্টে দিতো
মৃদু হাসিতে , শারীরিক কষ্টকে বদলে দিতে পারতো কবিতার ছত্রে কিম্বা দু কলি গানের
ম্লান আভাসে ! ওর চোখের মায়াবী যাদুমন্ত্রে পৃথিবীর প্রত্যেকটা দৃশ্য হয়ে উঠতো পরম
বন্ধুর মতো সাবলীল । ২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০১৬ , সকালবেলা । ভিলাইতে অফিসে ঢুকেই রঞ্জনের
( রায়) ফোন পেলাম – ‘ তমাল আর নেই ।’
মুহূর্তে স্তম্ভিত হয়ে গেলেও আমার প্রিয় বন্ধু তমালের জন্যে আমি একটুকুও
কাঁদি নি – কাঁদতে পারি নি। তবে এ সংবাদ পেয়ে ভিলাইতে আমার সংসার আর আমার ছেলে
কেদার খুব কেঁদেছিল ।
# ২ #
যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ষ্টইয়ারে ( ১৯৭৪) ও
ছিল সিভিল ।তখনও বন্ধুত্ব তেমন জমে নি । সেকেন্ড ইয়ারে আমি , তমাল , আরো কয়েকজন
সিভিল থেকে মেকানিক্যালে চলে এলাম ।সেকেন্ড ইয়ার থেকে তমালের সঙ্গে বন্ধুত্বের
ব্যাপারটা ধীরে ধীরে তৈরী হতে লাগলো ।কলেজের রকে বসে আড্ডা , একটা চার্মিনার
সিগারেটের কাউন্টারকে তিন চার জন মিলে ফোঁকা , ক্লাস টেস্টের উদ্বেগ , বিভিন্ন
ছাত্র আন্দোলন ,মিটিং-মিছিল , কবিতার খাতা , সত্যেনদার ক্যান্টিন এসবের মধ্য দিয়েই
তমালের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা জমে উঠতে লাগলো । কোন পত্র পত্রিকায় নিজেদের লেখা
বের হলে একে অন্যকে পড়াতাম । মজার কথা বলা, হাসি ঠাট্টা তামাশা এসব ব্যাপারে ও ছিল
প্রাণবন্ত। ক্লাস শেষ হলে ও বাসে ফিরে যেত ভবানীপুর , আমি ট্রেনে চড়ে বাঘাযতীন
কিম্বা কাঁচরাপাড়া ।
কলেজে বিভিন্ন সময়ে নানা ইস্যু নিয়ে যেসব আন্দোলন হোত ,
তাতে তমালকে দেখতাম সামনের সারিতে । রাজনৈতিক ধ্যানধারনায়
আমাদের যে সব বন্ধুরা এগিয়ে ছিল তমাল তাদের মধ্যে একজন। দেশে জরুরী অবস্থা উঠে
গেলে যাদবপুরে তখন ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো- ডি এস এফ নামে – আরো অনেকের মতো
তমাল তাতে যুক্ত ছিল ।
ও আমার এমন এক বন্ধু যে কলেজে আমার থেকে ৬০ বা ৬৫ পয়সা ধার
নিয়েছিল ; ততোদিনে আমি ভুলেই গেছি ; ও গুনে গুনে পুরো পয়সাটাই ফেরত দিয়েছিল মাস
ছয়েক বাদে ! মনে পড়ে , কলেজে ক্লাস পালিয়ে (যাকে বলতাম মাস-কাট ) , আমরা দুজন বাসে
চড়ে পৌঁছে গেলাম কার্জন পার্কে । সে সব প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। অনেক আড্ডা
হোল – নিজের জীবনের কিছু অপ্রিয় সত্যি কথা তমাল কেমন সহজে বলে গেল । সেদিনই মনে
হয়েছিল ওর জীবনে সততা , সত্যবাদিতা ও নির্ভীকতার একটা আলাদা স্থান রয়েছে – অর্থাৎ
ও সৎ এবং সাহসী !
# ৩ #
কলেজের পরে ( ১৯৭৯-৮০) আমরা অনেকেই চাকরী নিয়ে চলে এলাম
এদিক ওদিকে । তমাল লেগে পড়লো আরো বড় কিছু কাজের স্বপ্ন নিয়ে – সামাজিক পরিবর্তনের
স্বপক্ষে রাজনৈতিক কাজ। হয়তো এ জন্যে কলেজে মাস্টার ডিগ্রী করবার কথা ওকে ভাবতে
হয়েছিল। ধীরে ধীরে নিজেকে যুক্ত করে নিল শ্রমিক অঞ্চলের কিছু কাজের সঙ্গে। ১৯৮১ তে
তমাল রাজনৈতিক কাজের হোল- টাইমার হয়ে গেল । তখন ওর মুখে শুনতাম গার্ডেনরীচ ,
ব্রেসব্রীজ নানা কারখানায় শ্রমিকদের লড়াই-র কথা। কখন কখন এসব কথা ওর চিঠিতে জানতে পারতাম। আশির দশকে বিভিন্ন
সময়ে যেসব কল কারখানায় লড়াই চলেছিল , তার মধ্যে আছে এ-স্টক , ভারত টিন , বি ডি
খৈতান , আরকো , টমকো , হিন্দুস্থান লিভার ইত্যাদি সব নাম । শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি
নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে তখন ওরা নানা কাজে ব্যাস্ত । বাটা থেকে ডানলপ ,
গার্ডেনরীচ থেকে বেলেঘাটা – তমালের ঠাসা কাজ । ১৯৮৫-তে ভারত টিন সংক্রান্ত আন্দোলনের
পরিপ্রেক্ষিতে আরো অনেকের সঙ্গে তমালকেও লালবাজার লক আপে আট ঘন্টা বন্দী থাকতে হয়
। বন্ধ কারখানার গেটের সামনে শ্রমিকদের সমর্থনে তাঁবু – আরও অনেকের মতো সেসব ছিল তখনকার
তমালের সাময়িক আস্থানা । নিজের লেখা আত্মস্মৃতিমূলক উপন্যাসটি বের হলে এসব নিয়ে
আমরা আরো অনেক কিছু জানতে পারবো । কিছু বিষন্নতা নিয়ে , কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে এক
সময়ের সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী তমালকে সংগঠন ছাড়তে হয় ১৯৯২ তে ।
# ৪ #
ব্যক্তিগত জীবনে প্রেম ও বিয়ের ব্যাপারে তমাল আমার
সিনিয়ার । মণিদীপার সঙ্গে ওর যোগাযোগ ও প্রেম ।ওদের বিয়ে হয় ১৮ই নভেম্বর ১৯৮৭ এ । বিয়ের
দিন ঠিক হয়ে আছে ; ঠিক তার কিছু দিন আগে মণি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি । কিছুটা
জটিল অবস্থা । হবু বর সটান হাজির বহরমপুর হাসপাতালে । যেন রাজকন্যাকে দৈত্যের
কারাগার থেকে মুক্ত করে নিতে রাজপুত্র সর্বস্ব পণ করেছে ।মণি অবশ্য তাড়াতাড়ি সুস্থ
হয়ে উঠেছিলো । সময় মতো ওদের রেজিস্ট্রি বিয়েটা হয়ে গেল !
এর পরে
পরেই আমি প্রেমে পড়ি – বউ ভিলাই-এর মেয়ে । কোলকাতায় আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের
ফর্ম জমা ও অন্যান্য আইনি- যোগাযোগ তমাল /
অপূর্ব (দত্ত) বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে করে
দিয়েছিলো । বেহালায় অপূর্বর ভাড়া বাড়ীতে আমাদের বিয়ের কিছু দিন বাদে যে খাওয়া দাওয়া আড্ডা নামের রিসেপশন হয়েছিলো
তমাল ছিল তার একজন সক্রিয় উদ্যোক্তা । অপুর্ব-র বাড়ির সেই জমায়েতে তমাল-মণি , জিতেন-
অমিতা , ছুটিদি সহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিল ।
তমাল
রইলো কোলকাতায় , আমি ভিলাইতে । ওর চিঠিপত্র পাই । কোলকাতায় এলে দেখা সাক্ষাৎ হয় ।
তখনকার একটা কথা লিখছি - ওদের মেয়ে টুপাই জন্ম নিয়েছে । সদ্য বাবা হওয়ার আবেগে
ভবানীপুর থেকে লেখা ওর একটা চিঠির
(২৮-০৬-১৯৯১) অংশ তুলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে । তমাল আমাকে লিখেছে –
“ নদীর
নামে মেয়ের নাম রাখলাম চূর্ণী । খুব লক্ষী মেয়ে আমার , দু’দিন মাত্র বয়েস , তবু কত
বুঝদার । একটুও কাঁদে না , খাবার না পেলে নিজের হাত খায় । দুনিয়ায় যে খাদ্যাভাব ,
তা’ কৃত্রিম না অকৃত্রিম অতটা না বুঝলেও , প্রথমটুকু বুঝে গেছে । এখন এতেই চলবে !
কি বলিস ! শুরু হিসেবে যথেষ্ট ভালো নয় কি ?
মেয়েটা
আমার খুব দুষ্টু ।গত কয়দিন ওর মাকে এমন জ্বালিয়েছে যে ডাক্তাররা বাধ্য হয়েছিল
১৩/৬/৯১ থেকে হাসপাতালে ভর্তি করে নিতে । শেষে ওর গন্ডগোলে অতিষ্ঠ হয়ে ২৬ তারিখ
বেলা এগারোটায় ওর মার পেট কেটে ওকে বার করে আনতে হয়েছে ।
সেলাইয়ের
জ্বালায় মনি বেশ কাতর হয়ে পড়লেও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকটাই ভুলে থাকতে পারছে
। এমন সুন্দর আমার মেয়ের মুখ, ঠিক অন্যের মেয়ের মত !মানুষের মেয়েরা তাদের বাবা-মার
কাছে যেমন বিশ্বসুন্দরী হয়ে থাকে আমার মেয়েটাও তেমনই বিশ্বসুন্দরী ।
হাসপাতালে
এখনও ৭/৮ দিন থাকার পর চূর্ণী এসে ঘরে ঢুকবে । কমরেডরা তাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আমার
ঘরটাকে যতটা পারা যায় ‘এ শিশুর বাসযোগ্য’ করে তুলতে । কেউ চায় আলমারির অবস্থা
পরিবর্তন করে একটু বেশী আলো হাওয়া ঢোকাতে , কেউ বা চাইছে মশা তাড়ানোর জন্য বেশী
করে স্প্রে করে রাখতে ।
এই
সমস্ত মিলিয়ে বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতাটা নেহাত মন্দ নয় । তুইও অবশ্য কদিন বাদে সেই
স্বাদ পাচ্ছিস । তা’ তোর বাচ্চার মায়ের খবর কী ? ......।”
এই
চিঠিটার মধ্যে নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে কর্মক্লান্ত একটা মানুষের কাব্যিক মন ।
তমালের জীবনটাই কাব্য , প্রেম , জেহাদ আর
লড়াই-এ ভরা । বিভিন্ন অবস্থা ও পরিস্থিতির স্মৃতিচিহ্ন মাখা টুকরো টুকরো সময় । ওর
পারিবারিক জীবনে আর্থিক কষ্ট এসেছে । বাবা মা বউ মেয়ে নিয়ে ভবাণীপুরের ভাড়া বাড়ী ।
রোগ বিরোগের দাপটে কখনো কখনো টাল মাটাল অবস্থা । পাড়ায় বেপাড়ায় টিউশনি , ছাত্র
পড়ানো । যাদবপুরের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সুজয় বোসের সহায়তায় ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ
এনার্জি স্টাডিসে প্রোজেক্টের কাজ । নন-কনভেনশনাল এনার্জি
নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তমালকে কখনো কখনো যেতে হয়েছে কোলকাতার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় –
সুন্দরবনে , উত্তরবঙ্গে । কখনো দিল্লী থেকে আসা প্রোজেক্টের মাইনের টাকা আটকে গেছে
। সংসার চালানোর জন্যে তমাল তবুও ক্লান্তিহীন । শেষের
দিকে ব্যাক্তিগত কারণে তমাল যাদবপুরের এই প্রোজেক্টের কাজটা ছেড়ে দেয়। নানান চড়াই
উতরাই – এসবের মধ্যে নিজের শিরদাঁড়া উঁচু রেখে তমাল পেরিয়ে এসেছে বছরের পর বছর নিজের
পথ!
# ৫ #
আমার প্রথম কবিতার বই বের হবে । তার ভূমিকা কে লিখবে ।
অগত্যা তমালের ভূমিকাসহ আমার বই ‘তবু স্পন্দমান পথ’ বের হলো ।বিভিন্ন সময়ে কবিতা
লিখে তমালকে চিঠিতে পাঠাতাম ।আমার অনেক কবিতার
প্রথম পাঠক , নির্মম সমালোচক ও ছিল ।
জবাবী চিঠিতে আমি নিয়মিতই পেয়ে যেতাম ওর লেখা কবিতা , লেখার খসড়া আর নানা
খবরাখবর ।
আগেই কিছুটা বলেছি , আমাদের কলেজের বন্ধুত্ব শেষ পর্যন্ত পারিবারিক
বন্ধুত্বে পৌঁছে গেছিল । কখনো কোলকাতা
গেলে তমালের বাড়ী যেতাম , সপরিবারে । এদিক ওদিক আমরা অনেক ঘুরতে গেছি – মন্দারমনি
, বকখালি । কয়েকবার তমাল , রঞ্জনরা সপরিবারে আমাদের ভিলাই ঘুরে গেছে ।
তখন আমরা গেছি অমরকন্টক , একবার পাঁচমারী । ভ্রাম্যমান আন্তরিক সেইসব দিনগুলির কথা
এখনো স্মৃতির অ্যালবামে ধরা আছে । তমালের গানের গলাটা ছিলো ভালো । মাঝ রাত পেরিয়ে
যাচ্ছে ; তমাল মনি রঞ্জন পাপুন মানা – গানে আমরা সবাই মেতে রয়েছি !
অবশ্য তমালের সঙ্গে শুধু যে আমারই পারিবারিক বন্ধুত্ব তা নয়
; ওর পারিবারিক আদলটা এমন ছিল , যে কেউই ওর আপনজন হয়ে যেত । কাজের মেয়েটার বাড়িতে
সমস্যা – তা নিয়ে তমালের দুশ্চিন্তা ।ওর এক আত্মীয়ের মাথা খারাপ – রাস্তায় এদিক
ওদিক ঘুরে বেড়াতো – তা নিয়ে তমালের দুঃখের শেষ নেই । গার্ডেনরীচের সমস্যাগ্রস্ত
একটি শ্রমিক পরিবার , তারাও যেন তমালের পরিবারের একজন । আমার বোনের বিয়ের সম্বন্ধ
ঠিক হচ্ছিল না – তা নিয়ে ওর কি প্রচেষ্টা ।
নানা স্মৃতি ঘুরে ফিরে আসে । ছুটিতে কোলকাতা যাচ্ছি ।ঠিক
হোল আমরা সপরিবারে সদলবলে সুন্দরবনে বেড়াতে যাবো , ওখানে আঁদাড়ে বাদাড়ে ঘুরবো । সব
কিছু ঠিক ঠাক । কিন্তু আমাদের যাওয়ার সময়ের কয়েক দিন আগে দক্ষিণবঙ্গে প্রচন্ড
বৃষ্টি- ভেস্তে গেল প্লান ।তমাল ও অন্যান্য বন্ধুরা মিলে ঠিক করলো – সুন্দরবন না
হলে কি আছে – ঘর থেকে যখন বের হাওয়ার কথা তখন আমরা কোথাও না কোথাও যাবো । আমাদের
কয়েক দিনের ডে-আউট – পৈলানে (অক্টোবর -২০০৩)। কতগুলো
ঘরভাড়া নেয়া হোল । সেখানে ছিল তমাল-মনি , বিতান – কাজরী , পার্থদা- রত্নাদি ,
আভিজিত , ভাস্কর , রঞ্জন –পাপুন আর আমাদের বাচ্চা –কাচ্চারা । সে কি গুলতানি , সে
কি আড্ডা ! হোটেলের ঘর ছেড়ে রাস্তার পাশে বাঁশের বেড়া দেয়া চায়ের দোকানে কাটতো
আমাদের সকাল বিকাল ।যদিও মাত্র কয়েকটা দিন , তবুও তখন ছিল একক পরিবারের মতো
সঙ্ঘবদ্ধ জীবন । আমার ছেলে কেদারের বয়স তখন চার – তমালকাকু কেদারকে শেখাচ্ছে কেমন
করে বিড়ি টানতে হয় । আমার ছেলেও কাকুর নির্দেশ মতো বিড়ি টানার চেষ্টা করে যাচ্ছে ,
আর দমকে উঠছে কাশি । তমালকাকুর বিড়ি-টানানোর ক্লাসের এটাই সুফল , আমার ছেলে
পরবর্তী সময়ে বিড়ি বা সিগারেট টানার দিকে ঝোঁক দেখায় নি ।
# ৬ #
তমালের চিন্তা ভাবনা আর কাব্যময় মানস-সত্ত্বাকে খুঁজে পাওয়া
যাবে ওর নানা লেখায়, আর চিঠি পত্তরে ।
***
মাল্টি-ন্যাশানাল সাবান কোম্পানীর শ্রমিক প্রায় ২৩মাস ধরে
ছাঁটাই হয়ে আছে । তার কচি মেয়ে মারা গেছে কোলকাতার এক হাসপাতালে । যক্ষায় ১৬ বছরের
বালিকার এই মৃত্যু বড় করুণ ! তমালের এক আত্মীয়া ওখানকার নার্স হিসেবে মেয়েটিকে
দেখতো । এই মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে তমালের কবিতার কয়েকটি লাইন তুলে দিলাম –
“ জন্মভূমিতে একা বধ্যভূমিতে একা দাঁড়িয়ে রয়েছি
মাথার উপর
রাত্রির গাড়িতে
চলছে
জোছনার চাদরে ঢাকা
পূর্ণিমার নিহত শরীর
পিচকালো আকাশের
বুকে
সাদা তারার খই
ছড়িয়ে যাচ্ছে
আর
শূন্যতার বুক ফেটে
ঝরে পড়ছে নার্সের শিশির ।
#
বাবা নয় , মা নয় তার
জন্য তুমি ছাড়া আর কেউ কাঁদেনি সিস্টার ,
“ ষোল বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে চলে গেল,”.........
ছাঁটাই কি ভয়ানক সংক্রামক জীবাণু , তা তুমি কোন ছার
ডাক্তারের বাবাও বোঝে না !” [জন্মভূমিতে একা বধ্যভূমিতে একা ]
* * *
১৯৮৭ এর কথা । বর্ধমানের খবর উত্তাল । অভিযোগ - আউসগ্রামে
মেরু বাগদী নামে একজন উনিশ বছরের যুবককে পুলিশ গুলি করে মেরেছে । তারই
প্রতিক্রিয়ায় তমালের লেখা কবিতাটি উল্লেখযোগ্য –
আউসগ্রাম থেকে আরোয়াল বেশি দূরে নয় –
এই ভয়
নিরাপত্তা বিলাসের অবশিষ্ট স্বপ্ন ভেঙ্গে দিল ।
পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গেল মেরু বাগ্দি
- আরো এক বিপন্ন বিস্ময় ।
একান্তে নোয়াতে মাথা যতটুকু গোপন আহ্লাদ ,
টর্চ জ্বেলে খুঁজে খুঁজে বের করে তাকে বর্ধমানে
অন্ধকারে খুন করল রাষ্ট্রীয় জহ্লাদ । [আরো
এক বিপন্ন বিস্ময় ]
* * *
তমালের বাবা কিছুদিন অসুস্থতার পরে মারা গেলেন , ১৯৯৮এর কথা
।তখন অনেকেই বলতে লাগলো – প্রথাগত পারলৌকিক ক্রিয়া , শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠান তমালের করা
উচিত । অন্তর-দ্বন্দ্বে জারিত তমাল
পরিষ্কার জানালো , এসব পারলৌকিক কাজ অর্থহীন । এসব কথা মনে করিয়ে দিয়ে তমাল লিখলো
‘আমার শোকপালনের রকমটা একটু অন্য , আপনারা আমাকে মাফ করবেন’ – তার অংশবিশেষ তুলে
দিচ্ছি –
“ আচ্ছা , আপনি (তমালের বাবা - প্রতিবেদক)কি এখন আর কিছুতেই
ফিরে আসতে পারেন না ? আত্মায় আমি বিশ্বাস করি না- আপনিই আমায় শিখিয়েছিলেন বিশ্বাস
না করতে, তবু আপনি একবার ফিরে এলে আমার একটু সুবিধা হ’ত । এই যারা আপনাকে কোনোদিন
শ্রদ্ধা করেনি, কিন্তু পা ছুঁয়েছিল তাদের উল্টোদিকে আমি , আপনার একমাত্র পুত্র, যে
কোনোদিন আপনাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করিনি, একা দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমি এদের বোঝাতে
পারছি না ভৌমিকবাবু , আপনিই আমাকে শিখিয়েছিলেন- পরলোক নেই, তাই পারলৌকিক ক্রিয়াও
থাকতে পারে না , আপনিই আমাকে শিখিয়েছিলেন – শোক অন্তরের বিষয় – শোক স্বতোৎসারিত ,
শোক কেউ পালন করে না – পালন করে সামাজিক প্রথা । ......
“ আপনি এদেরকে একবার বলে যান তো ভৌমিকবাবু – যে রকম অনেক
প্রতিকূল পরিবেশে আপনি বলে গেছেন – যে রকম ’৭০ এ আপনি বলেছিলেন , ‘মূর্তিভাঙ্গা ও
ব্যক্তিহত্যার লাইন ভুল’ – পার্টির কাছে ও আপনার প্রিয় ছাত্রদের কাছে অপ্রিয় হবেন
জেনেও বলেছিলেন – যেরকম, ’৮১তে আমি হোলটাইমার হ’য়ে ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় মাকে আপনি
কান্নাকাটি করতে বারণ করেছিলেন – বলেছিলেন ‘ও কোন অন্যায় করছে না, আমি টিউশনি করে
সংসার চালাবো’ – সেরকম আপনি আরেকবার আসুন ভৌমিকবাবু , পরিস্থিতি হয়তো তত কঠিন নয় ,
কিন্তু , আপনার অনুপস্থিতিতে আমি আমি একটু দুর্বল বোধ করছি , এই সময়, আমি যে কথা
বললে , এরা আমাকে গোঁয়ার বলবে , আঁতেল বলবে , এবং তাছাড়াও আরো অনেক খারাপ কথা
বলবে, সেই সামান্য নিরীহ কথা একটু আমার হয়ে বলে দিন তো যে – ‘ আমার শোকপালনের
রকমটা একটু অন্য, আপনারা আমায় মাপ করবেন’ – ” [
সূত্র – তমালের চিঠি , ১৮/০৫/১৯৯৮]
* * *
তমাল
যে অসাধারণ কবি ছিলো , তা বোধ হয় বোঝা যাবে বৃষ্টিকে নিয়ে লেখা একটা কবিতায় ।
“ বাদল বেলায় তোমাকে
নিয়ে যাব সেই দিগন্ত পেরিয়ে চিত মাটি আর উপুড় মেঘের জলসায় / সেখানে আকাশের চারণ
কবিরা কালো কালো আলখাল্লা পরে গুরু গম্ভীর
গান গাইবে / হাজার হাজার স্বচ্ছ সরু দীঘল আঙুল দিয়ে মৃত্তিকার বুকে পিয়ানো বাজাবে
জলজ শিল্পীবৃন্দ / গাছগুলো তালে তালে নাচতে থাকবে আর পায়ের নীচে বাঁধানো আয়নায়
নাচবে তাদের সবুজবিম্ব / সব ভুলে তুমি শিশুর মতন হাততালি দিয়ে চেঁচাবে চিত
মাটি আর উপুড় মেঘের জলসায় ” [চিত মাটি আর উপুড় মেঘের
জলসায় ]
অমিতাভ সেন নামেই তমাল কবিতা লিখতো । ওর প্রকাশিত
এই অসাধারণ কবিতাটি উইলিয়াম রাদিচে সহ অনেকের প্রশংসা পেয়েছিল । একটা বিশেষ
অনুষ্ঠানে এই কবিতাটির জন্য আমিতাভ সেনের পুরস্কারটি কবি তমাল ভৌমিকের হাতে তুলে
দেয়া হয়েছিল ।
# ৭ #
তমালের
জীবনটাই একটা যুদ্ধক্ষেত্র ।অনবরত একটা লড়াই । সামাজিক ক্ষেত্রে , আর্থিক অবস্থানে
, শরীর স্বাস্থ্যে , এমন কি পারিপার্শিক আদর্শগত অবস্থানের দান্দ্বিকতায় ।এই
যুদ্ধক্ষেত্রটাকে তমাল মানিয়েই শুধু নেয় নি , এটাকে যথাসম্ভব উপভোগ করে জীবনটা
কাটিয়ে গেছে । শেষ দিকে ক্যন্সারের
চিকিৎসা চলছে , সঙ্গে কেমোথেরাপির যন্ত্রনাময় সাইড এফেক্ট – যখন তমালকে ফোন করেছি
, ওর মধ্যে এতটুকুও হতাশার প্রকাশ দেখি নি , ওর কথায় কখনও যন্ত্রণার দারুন
অভিব্যাক্তি দেখি নি । ইতিমধ্যে বন্ধুদের সহযোগিতায় ওর “ নির্বাচিত কবিতা ” বইটি
বেরিয়ে গেছে । জীবনের অভিজ্ঞতার
পরিপ্রেক্ষিতে নিজের লেখা আত্মস্মৃতিমূলক উপন্যাসটি ছাপার কাজ চলছে । ওর সঙ্গে তখনও নানা বিষয় নিয়ে
কথা হতো – বন্ধু বান্ধবদের কথা , আমাদের পারিবারিক কথা , লেখালেখির বা নতুন বই
ছাপার কথা, সমাজ সংসারের কথা । মারা যাবার মাত্র কয়েক মাস আগে রীতিমত পড়াশুনা
করে রশিদ খালিদি-র বইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে
একটা প্রবন্ধ লিখেছে , যাতে উঠে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয় ও সমস্যা [ দ্রষ্টব্য –
মন্থন সাময়িকী / জানুয়ারী ২০১৬ সংখ্যা ] -
রোগ শয্যায় থাকা একজন মানুষের পক্ষে এটা ভাবা যায় না ।
সাধারণ
ভাবে এটা কল্পনা করাও কঠিন , ফুসফুসে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষটি জীবনের শেষ সময়
পর্যন্ত নিজস্ব রণাঙ্গণে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে । ও মারা যাবার পরে , তমালের স্মরণে ৫ই মার্চ ২০১৬ কোলকাতার শরৎ স্মৃতি
সদনে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিলো – পরিজন ও বন্ধুবান্ধব অনেকেই সেখানে উপস্থিত
ছিল । ভিলাই থেকে গিয়ে আমি সেখানে হাজির থাকতে পারিনি । তবুও অনেক অনেক দূর থেকে
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তমালের মুখ। ওর মুখ
মঞ্চের একপাশ থেকে উঁকি মারছে । তমাল হাত নেড়ে বলছে – “রণজয়ী নই , তবু
যুদ্ধক্ষেত্রে আমি সমস্ত জীবনভর ছিলাম , আর আগামীতেও আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আপনাদের
পাশে পাশেই থাকবো ”।
আজও
মাঝে মধ্যে হঠাৎ দেখতে পাই তমালের সক্রিয় উপস্থিতি । শুনতে পাই ও আমাকে ফোন করছে
, বলছে
“ ব্যাটা , অনেকদিন তোর খোঁজ খবর
নেই । তাই তোকে ফোন করছি । ...... আমি, টুপাই , মনি , রঞ্জন -পাপুন সবাই মিলে প্লান করছি এবার পূজোয় তোর ওখানে
বেড়াতে যাবো ......!”
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
1st May - 2016.
(C) biswas.samarendra@hotmail.com
Comments
Post a Comment