ফিরে দেখা – গোকুলপুর কাঁটাগঞ্জ । [ আমার ছেলেবেলা ]
ফিরে
দেখা – গোকুলপুর কাঁটাগঞ্জ
১
পূর্বকথা : শেকড়ের খোঁজে
লাল ইঁট বাঁধানো রাস্তার
দু পাশে সারি সারি ঘর। ইঁটের, বেড়ার কিংবা মাটির। চারকাঠা
করে প্লট। কিছু
কিছু রাস্তায় পীচ-খোয়ার কঙ্কাল। পাড়ায় পাড়ায় সীমিত কয়েকটা টিউবয়েলের
চারপাশে বারো ঘরের ভীড়। কলতলাগুলোই
ছেলেমেয়েদের খোলা বাথরুম। ইঁটের
রাস্তার ধারে নিজের ঘরের পাশে বসে থাকতো সুরবালা পিসি, তাকে জড়িয়ে থাকতো তার ছেলে মেয়েরা – অশোক, বিকাশ, অতুল। উদ্বাস্তু ও অনাথ জীবনের দুর্দশার
আকাশ থেকে তাদের উপর এবং এমন আরো অনেকের উপর ঝরে ঝরে পড়তো অসহায় অনিশ্চয়তা।
সন্ধ্যার পরে ঘরে কেরোসিন
ল্যাম্প আর হ্যারিকেন। বাইরের
গাছ পালায় ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি পোকার আলো। পূর্বপাকিস্থান
থেকে আগত উদ্বাস্তুদের পূনর্বাসনের জন্যেই নির্মিত হয়েছিল এই সব গভর্মেন্ট কলোনীগুলো – যেমন গোকুলপুর, কাঁটাগঞ্জ, বেদীভবন,
চাঁদমারী। কাছেই
কলোনী পরিমন্ডলের বাইরে কৃষি-অধ্যুষিত অঞ্চল সাঁতরাপাড়া,
পাল্লাদহ। অপেক্ষাকৃত
সম্ভ্রান্ত প্রতিবেশী অঞ্চল জোনপুর। প্রায়
দু’কিলোমিটার দূরে রেল স্টেশন কাঁচরাপাড়া।
আমার বাল্য ও ছাত্রাবস্থার পটভূমি। এমনই একটা কলোনী গোকুলপুর। এখানেই আমার স্কুল জীবন ১৯৭৪
সাল পর্যন্ত। তারপরে
যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাওয়ার জন্যে কোলকাতায় থাকতাম। তা’হলেও ১৯৮০ পর্যন্ত নিয়মিত যাতায়াত ছিল গোকুলপুর বা সন্নিহিত এলাকায়। এতগুলো বছর আগেকার গোকুলপুর, কাঁটাগঞ্জ বা সন্নিহিত অঞ্চলের হালচাল কেমন ছিল তা নিয়েই এই ‘ফিরে দেখা’। এই
লেখাতে ধরতে চাওয়া হয়েছে একটা অঞ্চলের ষাট আর সত্তরের দশককে। গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ অঞ্চলটা পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায়, যেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে গেলেই উত্তর২৪পরগনার অন্তর্ভুক্ত সুপরিচিত কাঁচরাপাড়া রেল স্টেশনটা।
এ লেখা স্মৃতিচারণমূলক ও অসম্পূর্ণ
কিংবা নিতান্তই আংশিক। লেখায়
বর্ণিত মানুষগুলোর কেউ কেউ আর এ দুনিয়াতে নেই; কিন্তু আমার
মনে রয়ে গেছে তাদের টুকরো টুকরো স্মৃতি, তাদের দিন যাপন। এ
লেখায় উঠে এসেছে সে সময়কার কিছু বিক্ষিপ্ত ছবি, গোকুলপুর কাঁটাগঞ্জ
অঞ্চলের পুরাণো দিনের একটা সামাজিক রূপরেখা।
আমার জন্ম ১৯৫৭তে। ১৯৮০তে চাকুরী নিয়ে মধ্যপ্রদেশের (এখন ছত্তিশগড়) ভিলাই চলে আসি। তাহলেও আমার ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব, ‘অন্বেষা’
পত্রিকা এসব কিছুর মাধ্যমে গোকুলপুর কাঁটাগঞ্জ অঞ্চলের সাথে আমার আন্তরিক
যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। নিজেদের বাড়ি আছে, তাই এখনো যোগাযোগটা বেঁচে আছে।
‘অন্বেষা’
পত্রিকা ২০০৭ সালে তাদের রজত জয়ন্তীবর্ষে আমাকে লেখার জন্যে অমন্ত্রণ
জানিয়ে ছিল। তাদেরই
আমন্ত্রনে এ লেখার শুরু। তাই
প্রথমেই পত্রিকাটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরিচয় করিয়ে দেই ‘অন্বেষা’কে। এই নামে একটা ছাপা কাগজ প্রকাশিত
হয় গোকুলপুর থেকে। ‘অন্বেষা’র প্রথম প্রকাশ বাংলা ১৩৯০( ইংরেজী ১৯৮২) সালে। যে গোকুলপুর কাঁটাগঞ্জকে এককালে
দেখেছিলাম, যে পরিবেশের গর্ভ থেকে ‘অন্বেষা’ উঠে এসেছে, তার সাথে আজকের
মিল পাওয়া ভার! যে বিক্ষিপ্ত স্মৃতিটুকু ধরতে পেরেছি,
তাকেই সংক্ষিপ্ত পরিসরে লিখতে চেষ্টা করেছি। যা লিখতে পারলাম না, তা এই অঞ্চলের মানুষজন লিখবেন বা বলবেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা ঘটনা
আমার সীমিত একক দৃষ্টিতে বাদ যাওয়াই স্বাভাবিক। তবু পেছনে ফিরে একটু খুঁজে দেখি
আমাদের শেকড়কে।
২
ছায়া
সুনিবিড় দিন, ঝিঁঝিঁ জোনাকির রাত
ষাটের দশকের সেসব দিনগুলো
ছিলো প্রকৃতির কাছাকাছি। সন্ধ্যাবেলা
আসে পাশে ঝোপঝাড়ে শিয়ালেরা ডেকে উঠতো। গৃহস্থদের
হাঁস,
বাচ্চা ছাগল শেয়ালের হাতে মারা পড়তো। এখন যেখানে সুকান্ত পল্লী, সেটা ছিল জঙ্গলময় বাগান। নাম ‘দারোয়ান বাড়ি’। কিভাবে
এমন দারোয়ান মার্কা নামটা হলো, তা জানা নেই। তবে কালো কুচকুচে, স্বাস্থ্যবান, মসৃণ চেহারার এক চাষী ঐ বাড়ীটার দেখাশোনা
করতো, লোকটার নাম ছিল সুলতান।
ঐ বিশাল বাগানবাড়িটা সিপিএম
পার্টি থেকে দখল নিয়ে লোকদের মধ্য ভাগ করে দেয়া হয়। এমনি ভাবেই সুকান্ত পল্লী জনবসতিটা
গড়ে ওঠে। পল্লীটা
তৈরী হবার আগে দারোয়ান-বাড়ি বাগানটা ছিল নিঃঝুম!
রাতে এখানে নাকি আকাশ থেকে পরীরা নামতো! ভূত আর
জিনে ভরা দারোয়ান-বাড়িতে অন্ধকার ভোরে ফুল তুলতে গিয়েই নাকি আমাদের
এক কিশোরী আত্মীয়া হাসি-কে ভূতে ধরে ছিল। তারপর থেকে দাঁত মুখ খিঁচে তার
ফিট হতো,
অজ্ঞান হয়ে বিড়বিড় করে হাত পা শক্ত হয়ে যেতো। পরে জেনেছি এর নাম এপিলেপটিক
ফিট। তখন
সবাই জানতো, হাসিকে মাঝে মাঝে ভূতে ধরে!
লেনিন পল্লীটাও এমনি ভাবেই
দখল করে তৈরী হয়। যেখানে
এখন লেনিন পল্লী, যেখানে আগে ছিল একটা বিশাল ক্ষেত। সর্বজিৎ সিং নামে যে দীর্ঘদেহী
শান্ত মানুষটা সরস্বতী পূজায় আমাদের আট-আনা চাঁদা দিত
সেই ছিল লেনিন পল্লীর ঐসব জমির রক্ষক কিংবা মালিক!
এখনকার জমজমাট খালধারটা
ছিল নির্জন। জোনপুর
থেকে নিমতলার দিকে যাবার পুরো রাস্তাটাই ছিল কাঁচা। রাতে রাস্তায় বেরোলে জোনপুরের
খালধারটায় ছিল গা-থমথমে নিঃস্তব্ধতা! কাঁচরাপাড়া স্টেশন থেকে চাঁদমারী পর্যন্ত কুলিয়া রোড ছিল একটা প্রধান সংযোগকারী
রাস্তা। স্টেশনের
কাছে কুলিয়া রোডের উপর এখন যে কংক্রীটের ব্রীজটা হয়েছে, সেখানে ছিল কম-চওড়া একটা কাঠের পুল। সেই কাঠের পুলের নীচে ছিল সরু
একটা জলের ধারা। বাঘের
খাল আর ঝিল থেকে বেরিয়ে আসা এই সরু খালের জলধারাটা উত্তরের দিশা থেকে দক্ষিনে রেল কলোনী
বাবুব্লক,
আমবাগানের দিকে বয়ে যেত।
কুলিয়া রোডের সমান্তরাল
ও কিনার ঘেঁসে পশ্চিম থেকে পূবে বিস্তৃত ছিল বাঘের খাল, তারাপদর ঝিল আর কুলিয়া বিল। এই
ঝিলের কাঁটাগঞ্জের অংশটাকে ‘ফিসারীর ঝিল’ও বলা হতো। এক
সময়ে বেশ কয়েক কিলোমিটার লম্বা এই ঝিলটা ছিল জলে টই-টম্বুর!
এখনকার মতো মরা নয়। ঝিলের
মাঝখানটা জুড়ে এখন কল্যানী-ব্যারাকপুরের যে চওড়া হাই-ওয়ে তৈরী হয়েছে, তখন সে সবও ছিল না।
অন্য দিকে ছিল সাঁতরাপাড়া গ্রামের
পাশে ছিল আরেকটা বিশাল জলাভূমি। মথুরা
বিল। এই মথুরা
বিল ও তারাপদর ঝিলের মাঝে ছিল সংযোগকারী খাল, সম্ভবতঃ যা কিনা
সেচের জন্যে ব্যবহৃত হতো। এখন
এই খাল মরে গেছে। তার
দু পাশে গড়ে উঠেছে হরেকৃষ্ণ কোঙার পল্লী। ঐ
খালের স্বচ্ছ্ব জলে সাঁতার-কাটা, স্নান-দাপাদাপির মহড়া আমরাও নিয়েছি। তখনো এতো বাড়িঘর তৈরী হয় নি। হু হু করে সারা দিনই হাওয়া বইতো; ইলেকট্রিক লাইট ফ্যানের বালাই ছিল না।
গোকুলপুরের অন্তর্গত সুকান্তপল্লীর
পাশেই ছিল তমাল দত্ত ও পরিমল দত্তদের জমির বিশাল সীমানা। বিশাল ভূভাগ নিয়ে ‘কাঠালয়ালা বাড়ি’। বড়ো
বড়ো কাঁঠাল গাছের বাগান। নীচে
ঘাসের পরিষ্কার জমি। আমার
ছাত্রকাল। তখন
সে জমিতে আমাদের পোষা ছাগলটাকে ঘাস খাওয়াতাম। বিশাল বিশাল গাছের নীচে শুয়ে
শুয়ে ঘন কাঁঠাল পাতার আড়ালে পাখিদের কিচির মিচির শুনতাম। দেখতাম গাছের মোটা গুঁড়িতে কাঠ-পিঁপড়েদের কসরত।
তখনকার দিনে নিমতলা অঞ্চলের
আবাসিক পরিসর ছিল সীমিত। লোকজন
খুব কম। বেলতলা
ছিল ছোট্ট একটা গ্রাম। এই
অঞ্চলগুলোর পাশে বিস্তীর্ণ ক্ষেত। ক্রমবর্ধমান
লোকসংখ্যার চাপে এসব অঞ্চল এখন বাড়িঘরে ভরে গেছে।
কাঁটাগঞ্জ, বেদীভবন, চাঁদমারিও ছিল উদ্বাস্তু কলোনী। ঐ সব অঞ্চলে জায়গায় জায়গায় তৈরী
হয়েছিল উদ্বাস্তুদের থাকবার জন্যে পাকা আবাসন। ক্যাম্প জাতীয় আশ্রয়। কিছু জায়গায় ছিল লোহা স্টীলের
খাঁচা দিয়ে তৈরী সিলিন্ডারের মতো কিছু লম্বা-গোলাকৃতি ঘর। ওগুলো বৃটিশ আমলের, মিলিটারিদের থাকবার জন্যে।
গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জের কাছেই এই অঞ্চলের মূল শহর ও রেল স্টেশন কাঁচরাপাড়া। এই স্টেশনটা অনেক পুরোনো। এখানকার কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপ
স্থাপিত হয় ১৮৬৩তে; ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ বানানোর জন্যে
১৯৬২তে এই ওয়ার্কশপটিকে রিমডেলিং করা হয়। এখানকার স্থায়ী চাকুরেরা ছিল
অবস্থাপন্ন। কিন্তু
সেসব দিনে গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ উদ্বাস্তু অঞ্চলের হাতেগোনা
কয়েকটি মাত্র লোক ওয়ার্কশপে চাকুরীর সুযোগ পেয়েছিল।
কাছাকাছি আকেকটি শহর কল্যানী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কল্যানী ছিল বায়ুসেনাদের মিলিটারি বেস। কাঁচরাপাড়ার কাছাকাছি আরেকটা
অঞ্চল কাঁপা। সেখানে
এখনো মিলিটারি বেসগুলো রয়ে গেছে। আমার
জন্মের অনেক আগে ১৯৫০এ, ন্যাশানাল কংগ্রেসের মিটিং করবার
জন্যে তড়িঘড়ি করে কল্যানী শহরটিকে বানানো হয়। পরে ডাক্তার বিধান রায়ের পরিকল্পনা
ও পরামর্শ অনুসারে কল্যানী তার পরিকল্পিত রূপ নেয়। ১৯৬০এ কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়
তৈরী হয়।
গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জের মানুষদের কাছে সেসময় ভারতবর্ষের প্রধান শহর দিল্লী, মুম্বাই, মাদ্রাজ নয় – প্রধান শহর
ও রাজধানী ছিল একমাত্র কোলকাতা। লোকাল
ট্রেনে ছিচল্লিশ কিলোমিটার সফর করলেই শিয়ালদহ রেল স্টেশন – মানে কোলকাতা। কয়লাটানা
স্টীম ইঞ্জিনে, রেলের কাঠের বগিতে চড়ে সেই সব ছেলেবেলায় আমরা
পৌঁছে যেতাম বিস্ময়কর চলমান একটা দুনিয়াতে – কোলকাতায়। এখানে ছায়া সুনিবিড় আম কাঠালের
জঙ্গল নেই, জোনাকি জ্বলা রাত নেই – আছে গাড়ী ঘোড়ার গর্জন, বাসের বাঘ-মার্কা শরীর, ট্রামের ঘন্টি, বড়
বড় বাড়িঘর, অফিস, পাকানো বাঁধা রাস্তা। রাতে কোথাও গ্যাসের লাইট, কোথাও ঝিকমিক করা ইলেকট্রিক বাল্ব।
আমার বাবার ছিল কোলকাতায়
চাকুরি। ডেলি
প্যাসেঞ্জারি করতো। তাছাড়া
আমার মামার বাড়ি ছিল কোলকাতার ট্যাংরা অঞ্চলে। এসব কারণে বছরে দুতিন বার আমার
কোলকাতা যাবার সু্যোগ মিলতো। আমি গ্রাম ও শহরের মধ্যকার দ্বন্দ্বটা
ওই ছোট বয়সেই ভীষণ ভাবে উপলব্ধি করতাম। গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ অঞ্চলে আমার সমবয়েসী তখন এমন সব ছেলে মেয়েরাও ছিল, যারা তাদের বয়সকালে একবারও কোলকাতা যায় নি, কিংবা কলকাতায়
যাবার কোন প্রয়োজন পড়েনি বা সুযোগ আসে নি।
৩
জোড়াতালির
জীবিকা,
ভাঙাচোরা অর্থনীতি
স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে
কল কারখানার বিকাশ লাভ করে। কল্যানী
শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠে। পরের
দিকে লোকেরা কল্যানী, নৈহাটী- কোলকাতা, হাওড়ার সংগঠিত ও অসংগঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিতে
ধীরে ধীরে কাজ পেতে শুরু করলো।
তখনকার দিনে হাতে গোনা
দু-চারটে স্কুলই ছিল। শিক্ষকের
ছিলেন খুব সম্মানিত ব্যক্তি। জোনপুরে
আমাদের স্কুলের পাশে কালিতারা মহিলা সমিতি নামে একটা সমিতি ছিল। সেখানে কুটির-শিল্পমূলক কাজ কর্ম হতো। ঘরে
ঘরে বিড়ি বাঁধা, খবর কাগজের ঠোঙা বানানোরও প্রচলন ছিল। এই অঞ্চলের কিছু কিছু মানুষ মনোহারী
জিনিষ ফেরি করতো। মনোহারী
জিনিষ মানে চুড়ি, আলতা, সিঁদুর,
খেলনা – এসব মাথাতে ঝাঁকায় করে বয়ে নিয়ে,
সুর করে হেঁকে হেঁকে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে,
জিনিষপত্র বেচাই ছিল এইসব ফেরীয়ালাদের জীবিকা।
চালের চোরাচালানও ছিল
একটা পেশা। দূর-দূরান্ত থেকে ট্রেনে লুকিয়ে চুরিয়ে এক ব্যাগ চাল আনতে পারলেই কিছু টাকা মিলবে। চালের চোরা চালান করতে গিয়েই
আমাদের পাড়ার একজন ছেলে ট্রেনে কাটা পড়েছিল।
কলোনীতে আমাদের বাড়ির
কাছাকাছি একজনের জীবিকা ছিল চুরি করা। মধ্য
বয়স্ক,
কালো কুচকুচে চেহারার লোকটা – কয়লার গোলা থেকে
কয়লা চুরি করে ধরা পড়বার পর কী বেদম মার! পেটের দায়ে আর কিছুটা
স্বভাববশতঃ সে চুরি করতো। সেই
লোকটার নীরবে মার খাওয়া, তার গোরুর মতো নিরীহ দুটো চোখে
নীরব দুঃখ - এখনো আমার
বুকে বিঁধে আছে।
সত্তর দশক ও পরবর্তী সময়ে
বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, সরকারী অফিস-দপ্তর, পৌর প্রতিষ্ঠান এবং পরিসেবামূলক কাজকর্ম প্রসারিত
হতে থাকে। কিন্তু
ষাটের দশকে এমনটা ছিল না। তাই
অল্প কয়েকজন বাদে এখানকার বেশির ভাগ মানুষের অর্থনীতির ভিত্তিটা ছিল স্থানীয় জীবিকা। সেই অল্প কয়েকজন যারা ভালো প্রতিষ্ঠানে
চাকুরী করতেন, যেমন বিভূতি চক্রবর্তী( টেক্সমাকো কোম্পানী), পরিমল দত্ত (সরকারী চাকুরী), - তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান অন্যদের থেকে
আলাদা ছিল।
ন্যাশানাল টেক্সটাইল কর্পোরেশন(NTC),
সরকারী সংস্থার তরফে যখন কাঁটাগঞ্জ-এ স্পিনিং মিল
স্থাপিত হয়, তখন এই অঞ্চলের প্রচুর লোকের কর্ম সংস্থান হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় উপযুক্ত বাজার
খুঁজে নেবার অপারগতার জন্যে এবং সুস্থ পরিচালনার অভাবে এই বিশাল মিলটা কাঁটাগঞ্জের
বুকে অনেকদিন ধরে বন্ধ পড়ে আছে।
ষাট সত্তরের দশকের এই
অঞ্চলের মোটামুটি চেহারাটা এই রকম – বেশীর ভাগ মানুষের
আয় যৎসামান্য। আয়ের
বেশীর ভাগটাই খরচ হতো পেট ভরাতে। তখন
ছেমেয়েদের শিক্ষা বাবদ খুব সামান্যই খরচ হতো। বরং তার থেকে বেশী খরচ হতো লোক
লৌকিকতা,
আচার অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণে। আমার এক পরিচিত ছেলের বাড়ীতে
ধূমধাম করে কার্তিক পূজা বা রাধাকৃষ্ণের নামে কীর্তন যজ্ঞ হচ্ছে; অথচ ছেলেটি স্কুলে পরীক্ষার ফি দিতে পারে নি। পোষাক-আশাকের
উগ্র ব্যবসায়ী যুগ তখনো চালু হয় নি – তাই সে সব নিয়ে সে সময় মাথা
ব্যথা ছিল না। বেশির
ভাগ মানুষের পক্ষে ভরণ-পোষণ মিটিয়ে সঞ্চয় করতে পারাটা
ছিল কল্পনার বাইরে। একটু
অবস্থাপন্ন দু-একজন ব্যবসায়ী লোকেরা সূদে টাকা ধার দিতো। ঘরের পিতলের থালা ঘটিবাটি বন্ধক
রেখে লোকেদের দেখেছি টাকা পয়সা ধার নিচ্ছে। মোটের
উপর এ অঞ্চলের মানুষদের ছিল জোড়াতালির জীবিকা; ভাঙা-চোরা অর্থনীতি।
৪
জোড়া
বলদের চোখে কাস্তে হাতুড়ীর ডাক
আমার ছোটবেলায় দেখতাম
সবাই
, মানে বেশির ভাগ লোকই, তিন রঙা পতাকার সাপোর্টার। বেশির ভাগ লোকই কংগ্রেসের সমর্থক। ভোটে ছাপ দিত জোড়া বলদ চিহ্নে। ভোটের পালে হাওয়া লাগলে এসব অঞ্চল জমজমাট হয়ে উঠতো। আমার বাড়ির সামনেই মধু সেন এর বাড়ি। প্রফুল্ল রায়, জিতেন সেন-এর মতো তিনিও ছিলেন এ অঞ্চলের জাতীয় কংগ্রেসের একজন নেতা। একদিন দেখি মধু সেনের বাড়ির বারান্দায় ভীড়। শান্তি দাস নামে একজন মহিলাকে দেখবার জন্যে তার বাড়িতে ভীড় উপচে পড়ছে। এই মহিলাটি কংগ্রেসের হয়ে আমাদের চাকদহ বিধানসভায় লড়ছেন। শুনলাম, কি ডাকা বুকো মেয়ে রে বাবা! তিনিই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভয়ানক সশস্ত্র লড়াই লড়েছেন।
কংগ্রেস নামটা ঐ সময়ে আমাদের অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় ছিল; তার প্রধান কারণ যে স্বাধীনতাকে আমরা পেয়েছি, তাকে সুনির্মাণের জন্যে লোকে তখনও কংগ্রেসের উপর ভরসা রাখতো। দ্বিতীয়তঃ ১৯৬২র ভারত চীন সীমান্ত সংঘর্ষ, ১৯৬৫তে পাকিস্থানের ভারত আক্রমণ ইত্যাদি ঘটনাগুলো মানুষের মনে একটা দেশাত্মবোধ জাগিয়ে রেখেছিল। এই কারনেই শত অভাব-অভিযোগের মধ্যেও মানুষেরা তৎকালীন সরকার ও জাতীয় কংগ্রেস দলটির উপর আস্থা রেখেছিল। তৃতীয়তঃ আমাদের উদ্বাস্তু প্রধান অঞ্চলে তথা
P.L.Camp এর জন্যে নানা খাদ্যদ্রব্য, দুধ, নানা ত্রাণসামগ্রী সাহায্য হিসেবে আসতো। সেগুলো বিতরণের জন্যে সমাজসেবী রূপে কংগ্রেসের লোকেরাই নিযুক্ত ছিল।
পরে আরেকটু বড় হয়ে জেনেছি, আমাদের ঐ অঞ্চলে সমাজবাদী বা কম্যুনিষ্ট কর্মীরাও ছিল। কিন্ত কম্যুনিষ্ট রাজনীতি যারা করতো, তারা সংখ্যা লঘিষ্ঠ ছিল বলে এতো প্রচারের আলোয় আসতে পারতো না। RSP, RCPI প্রভৃতি বামধারার দলগুলো তখন ঐ অঞ্চলে ছিল। তরুবালা পিসি আমার দেখা ঐ অঞ্চলের প্রথম মহিলা, যিনি RCPI এর সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আরো এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বকে। এখন যেখানে আদর্শ শিক্ষায়তন স্কুলটা, সেই স্কুল
মাঠে একটা গাড়িতে সৌম্যদর্শন একজন পুরুষ এসে নামলেন। প্রথম দর্শনেই তার চেহারা দেখে মাথা নত হয়ে আসে। উনি রবি ঠাকুরের পরিবারের লোক। সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর। চাকদহ বিধানসভাতে RCPI দলের হয়ে পরপর অনেকবার বিধানসভার ভোটে লড়েছেন তিনি; কিন্তু একবারও জিততে পারেন নি। অসাধারণ জ্ঞানীগুণী লোক। পরে জেনেছি, উনি একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ ও ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে কোলকাতায় যে সর্ব্বভারতীয় কমিটি একসময়ে তৈরী হয়েছিল, তিনি ছিলেন তার জেনারেল সেক্রেটারি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কম্যুনিষ্ট আন্দোলন, জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক অধ্যুষিত অঞ্চলের তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদি দিকে দিকে মাথা তুললেও গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ
অঞ্চলে এসবের কিছু চিহ্ন আমার চোখে পড়ে নি।
চীন ভারত যুদ্ধের উপর
বিতর্ক নিয়ে CPI ভেঙ্গে CPI(M) পার্টি
গঠিত হলো। এরপরে
দেখলাম লোকজন কংগ্রেস থেকে ধীরে ধীরে কম্যুনিষ্ট হতে শুরু করেছে। বামফ্রন্ট ১৯৬৭তে পশ্চিমবঙ্গে
ক্ষমতায় এলো। ঐ
সময়ে দেখেছি, পাড়ায় পাড়ায় কি টেনশন! এদিক ওদিকে কংগ্রেস আর কম্যুনিষ্টদের লড়াই। এই অস্থিরতা বেশ কিছুদিন ছিল। দিনের আলোয় গোকুলপুরের রাস্তায়
পার্টির লোকেরা সশস্ত্র অবস্থায় দল বেঁধে যাচ্ছে। বাড়ির সীমানায় দাঁড়িয়ে বেড়ার
ফাঁফ দিয়ে গুন্ডা কিংবা লড়াকুদাদাদের দেখে আমরা ছোটরা তো ভয়ে কাঁপছি।
গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ অঞ্চলের মানুষজন ধীরে ধীরে কংগ্রেসের থেকে কম্যুনিষ্ট কাস্তে হাতুড়ী
তারার দিকে ঝুঁকছে, কারণ দেশের এবং অঞ্চলের একাধিক সমস্যা। এইসব অঞ্চলের আরো একটা বিশেষ
সমস্যা ছিল, দলে দলে উদ্বাস্তুরা পূর্ব পাকিস্থান পেরিয়ে
এদেশে ঢুকছে। মানবিক
কারণে তাদের তো ফেলা যায় না। তাছাড়া
এইসব এলাকায় যারা থিতু হয়েছে, তারাও তো বেশীর ভাগই উদ্বাস্তু। তারাও ওপার বাংলা পেরিয়ে আসা
মানুষজন। তাই নবাগত উদ্বাস্তুদের কেউ দূর-দূর বলে হটিয়ে দেয় নি। এইসব
নতুন আসা উদ্বাস্তুরা স্থানীয় আত্মীয় স্বজনদের সহায়তা নিয়ে, বা ওদেশ থেকে নিয়ে আসা সহায়সম্বল, সামান্য টাকা কড়ি লাগিয়ে
এদেশে মাথা গোঁজবার ব্যবস্থা করতে লাগলো। কিন্তু কে দেবে তাদের চাকুরী, কে দেবে খাদ্য? ভারতবর্ষের ভাঙ্গা অর্থনীতিতে উদ্বাস্তু
সমস্যা ছিল গোদের উপর বিষফোঁড়া। বিভিন্ন
ত্রাণ ও রিলিফ বিতরণের ব্যাপারে কংগ্রেসের দুর্নীতি নিয়েও মানুষজনের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। ক্রমাগত সমস্যায় মানুষজন ধীরে
ধীরে কংগ্রেসের উপর আস্থা হারাচ্ছিল।
১৯৬৫-৬৬ নাগাদ ছিল পশ্চিমবঙ্গে তীব্র খাদ্য সংকট। চাল দুর্মূল্য। মনে পড়ে, মা আমাদের সস্তা মাইলো শস্যের খিচুড়ী, ‘কাউন’
চাউলের ঝাউ সেদ্ধ করে খেতে দিতো। কোথাও সস্তায় দুকিলো চাউল পাওয়া
যাবে,
তার জন্যে এখানকার মানুষ যত্র তত্র ছুটতো। এই সময়ে সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে
ব্যাপক খাদ্য আন্দোলন চলছিল, খাবারের দাবীতে গুলি চলেছে,
মানুষ শহীদ হয়েছে। খাদ্য আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ অঞ্চলে সেরকম কোন আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বলে শুনি নি।
সত্তরের দশকের প্ররম্ভে
জোনপুরে দেখেছি নকশাল আন্দোলনের ছোঁয়া। ঐ
সময়ে নকশাল ছেলেরা অতর্কিতে আমাদের জোনপুর হাই স্কুলের ছাদে লাল পতাকা তুলেছিল। এ ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা। সত্তরের দশকে এই অঞ্চলের অল্প
কয়েকজন মানুষকে তৃতীয় ধারার বামপন্থী আন্দোলনে সামিল হতে দেখেছি। সুকান্ত পল্লীর এক দাদা তখন ঐ
ধারার
‘গনফ্রন্ট’এর সাথে যুক্ত ছিল।
উদ্বাস্তু সমস্যা, খাদ্য সমস্যা, স্বাধীন ভারতের বেহাল অর্থনীতি,
বেকারত্ব ইত্যাদির হাত ধরে ঐ অঞ্চলের মানুষেরা কংগ্রেস থেকে কম্যুনিষ্ট
পন্থার দিকে মাথা ঝোঁকালো।
কিন্তু তাতেও মানুষ এবং
এই অঞ্চলের সমস্যার সমাধান হলো কি?
৫
ঢ্যাম
কুড়া-কুড় বাদ্যি বাজে, দেবী আইলো ঘরে
ষাটের দশকেও পয়লা বৈশাখ
আসতো দোকানে দোকানে – হালখাতার মহরতে। গনেশ পূজা হতো; মিষ্টি মিলতো। বোঝা
যেত নববর্ষ। এখনকার
মতো নিউ ইয়ারের শুকনো গ্রীটিংস কার্ড বা মোবাইলে SMS মেসেজের
জামানা তখন ছিল না।
বসন্ত
(Pox)-এর প্রকোপ এড়াতে জায়গায় জায়গায় মা শীতলার পূজা হোত – গোকুলপুর কালীবাড়িতে, স্কুল মাঠে। এমন আরো অনেক জায়গায় শীতলার থান
বা মন্ডপ ছিল।
তখনকার দিনে দুর্গাপূজা
ছিল অনেক বেশী সার্বজনীন ও ঘরোয়া – স্বভাবতই তা ছিল আন্তরিক। দুর্গাপূজায় ভাসানের জমায়েত হতো
গোকুলপুর বাজারটার মোড়ে। তারাপদর
ঝিলে হতো দুর্গা ভাসান। ভাসানের
পরে শূণ্য মন্ডপে বসে শান্তি-জলের ছিটে নেয়াটাই ছিল রীতি। ঘরে ফিরে এসে গুরুজনদের নমস্কার
করতাম। বাবা-মা ধান দুব্বা দিয়ে আমাদের আশীর্বাদ করতো।
আমাদের ছোটদের আসল সক্রিয়তা
ছিল দশমীর পরের দিন, মানে ঠাকুর ভাসানের পরের দিন। যে দিনটার চলতি নাম ছিল বার-দশেরা। দল
বেঁধে নেড়ি গেড়ি, ছোট ছোট বাচ্চারা বেরিয়ে পড়তাম
পাড়ার বাড়ি বাড়ি। ঢিপ্ করে বিজয়ার নমস্কার করলেই মিলে যেত বাতাসা, নকুলদানা,
নয়তো গুড় দিয়ে ঘরে বানানো নারকোলের নাড়ু। জামা- প্যান্টের পকেট তো আছেই, তা ছাড়া সঙ্গে থাকতো কাগজের
ঠোঙা। সেগুলো
ক্রমশই বাতাসা, নকুলদানা কিংবা নাড়ুতে ভরতে থাকতো।
প্রত্যেক বাচ্চার কাছে অন্যের বাড়িটা
যেন নিজের অধিকারের জায়গা। কোন
লাজ লজ্জা ছিল না। আজকাল
সেসব ব্যবস্থা পালটে গেছে, যৌথ পরিবারগুলোও ভাঙছে। এখন গ্রামের বাচ্চারাও আগেকার
মতো অন্যের বাড়ি ঘুরে ঘুরে বিজয়ার মিষ্টি চেয়ে খেতে লজ্জা পায়।
কোজাগরী পূর্ণিমায় ওখানে
প্রায় প্রত্যেকটা ঘরে হতো লক্ষীপূজা – কলাগাছের বৌকে
কাপড় পরিয়ে পূজা হতো।
কালীপূজায় মাটির প্রদীপ
বানানো হতো, তাতে সলতে পাকিয়ে তেল ঢেলে প্রদীপ জ্বালানো
হতো। এখনকার
মতো টুনি বাল্ব, এলইডি লাইটের দিন ছিল না। নানান অঞ্চলের কালী পূজার মধ্যে
গোকুলপুরের পঞ্চপ্রদীপ-ক্লাবের কালীপূজা জাক জমকে বিখ্যাত
ছিল। পঞ্চপ্রদীপের
কালীপূজা প্যান্ডালের পাশে স্টেজ বেঁধে রাতে সংগীত অনুষ্ঠান হতো। বড় বড় বেতার শিল্পীদের নিয়ে আসা
হতো স্টেজে। আসপাশের
অঞ্চলের ভীড়ে উপচে পড়তো জায়গাটা। পঞ্চপ্রদীপের
এই বিশাল আয়তনের কালীপূজাটা আজকাল উঠে গেছে।
অনেকের বাড়িতে কার্তিক
পূজা হতো। তার
মধ্যে গোকুলপুরের বাগলবাড়ির পূজায় খুব ধুমধাম হতো। রাস উৎসবে রাধাকৃষ্ণের চরকদোলা
ঘুরতো আমার পিসি স্নেহলতা রায়ের বাড়িতে, কালীবাড়ীর পাশে
দোকানদার রাদুর বাড়িতে।
ঝিল পাড়ে (কাঁটাগঞ্জ স্পিনিং মিলের উল্টো ধারে) ছিল পীরের দরগা। সেখানে ছিল মাটির একটা বেদী। মাঝে মাঝে পীর সাধকেরা চামর ঝুলিয়ে
ঘরে ঘরে ভিক্ষা চাইতে আসতো।
নিরন্ন মানুষেরা সংখ্যায়
অনেক। তাই
ক্ষুধা মেটানোর দায়ে সারাদিন ভ্রাম্যমান ভিক্ষুকদের দেখা যেতো। ভিক্ষাতে খুচরো পয়সা নয়, এক মুঠো চাল দেয়াটাই ছিল তখনকার রীতি।
এই অঞ্চলের বিশেষ উৎসব
কুলিয়া পাটের মেলা। নববর্ষে
কাঁটাগঞ্জে বুড়ির বটতলার মেলা। শ্রাবণ
মাসে কাঁচরাপাড়ায় ঝুলনের মেলা। একটু
দূরে কল্যানীতে দোলে সতীমার মেলা।
মানুষদের হাতে ছিল যথেষ্ট
সময়। ব্যপক
পুঁজির দুনিয়া, টিভি, ইন্টারনেট মিডিয়া
এসব কিছু মানুষের সময়কে ব্যস্ততায় ঢেকে দিত না। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও নানা পালা-পার্বন ও উৎসবের খুশি খুশি ভাব হাওয়ায় ভেসে ভেসে বেড়াতো। প্রত্যেক ঋতুতেই দেব-দেবীদের আবাহনের প্রস্তুতি – বাতাসে ঢ্যাম কুড়া-কুড় ঢাকের বোল।
৬
সংস্কৃতির
বিবর্তন
: উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ষাটের দশকে সিনেমার বাজার
এতো সরগরম ছিল না। কাছাকাছি
ছিল দুর্গা আর লক্ষী সিনেমা হল। গোকুলপুর
স্কুল মাঠে সরকারী বা কোন বিশেষ উদ্যোগে পর্দা খাটিয়ে ফ্রীতে দেখানো হয়েছিল ‘পথের পাঁচালি’ সিনেমা। মনে পড়ে খোলা মাঠে জমির উপর বসে আমরা পর্দায় দেখেছিলাম সত্যজিত রায়ের অপু-দুর্গার সেই ‘পথের পাঁচালি’।
টিভির যুগ তখনো আসে নি। ট্রানজিষ্টরের যুগ শুরু হয়েছে। তখনকার দিনে ট্রানজিষ্টর রেডিও
সহজ লভ্য ছিল না। ষাটের
দশকে গোকুলপুর এলাকায় শচীন বিশ্বাসের বাড়িতে একটা ট্রানজিষ্টর রেডিও আসে। সম্ভবতঃ আশ-পাশের অনেকটা অঞ্চল জুড়ে ওটাই প্রথম রেডিও। রেডিওর সাইজটা ছিল বিশাল একটা
কাঠের বাক্সের সাইজের, সামনেটা ছিল পুরু কাপড়ের পর্দার। সামনে ছিল তিনটে গোল গোল নব। একটা চালু বন্ধ করাবার, অন্যগুলো আওয়াজ বাড়ানো কমানোর আর রেডিও-সেন্টার পাল্টানোর। ওতে কোলকাতায় টানটান উত্তেজনা
নিয়ে আমরা ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী শুনতাম। মহালয়ার দিন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ
ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠে রেডিওতে চন্ডীপাঠ হতো। খুব
ভোরে ভোরে সেই মহালয়া শোনবার জন্যে আমাদের বিশ্বাস বাড়ির খোলা বারান্দায় অনেক লোক জড়ো
হতো,
বিশাল ভীড় জমে যেত।
যাত্রা ছিল সে সময়ের একটা
উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতি। কাঁটাগঞ্জ
CRFC Club এর মাঠে, গোকুলপুরের নর্দাণ ক্লাবের
মাঠে (কালীবাড়ীর উল্টো দিকে) রাতে যাত্রার
আসর বসতো। কখনো
যাত্রা দল আসতো কলকাতা থেকে। কখনো
কখনো যাত্রা করতো স্থানীয় লোকেরা। আরো
অনেকের মতো মনি গুপ্ত, কান্তি গুপ্ত, আসীম কর, দেবনারায়ণ রায়কে যাত্রার চরিত্রে অভিনয় করতে
দেখতাম।
রামযাত্রা ছিল এসময়ের
একটা সংস্কৃতি। লোকগুলো
রাম,
সীতা, হনুমান সাজতো। মাথার
উপর সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে খোলা মাঠে রাতে বসতো রামযাত্রার আসর। যাত্রার ফাঁকে সামিয়ানার বাইরে
এসে সীতা বিড়ি ধরিয়ে খেতো। সীতা
যে মেয়ে নয়, ছেলে- এরকমটা আবিষ্কার
করে আমার শৈশবে আমি অবাক হয়েছিলাম। যাত্রার
মাঝপথে রাম-সীতাদের গলার মালাগুলোর দাম নীলামে চড়তো। এক একটা মালার দাম একটাকা- দুটাকা- তিনটাকা –পাঁচটাকা
– এমনি করে চড়চড় করে বাড়তে থাকতো।
থিয়েটার তখন ছিল শহরের
সংস্কৃতি। ষাট
দশকের শেষের দিকে, সত্তর দশকের প্রারম্ভে ধীরে ধীরে
সুকান্ত পল্লীর মোড়ে, নর্দান ক্লাবের মাঠে, অথবা আরো কোথাও কোথাও স্টেজ বেঁধে থিয়েটার হতো। আমার বন্ধু উজ্জ্বল ঘোষ, অমর নাথ এরা ছিল ভালো অভিনেতা। নাটকের ব্যাপারে সিদ্ধেশ্বর পোদ্দার খুব সক্রিয় ভূমিকায়
থাকতো। নাটকে
তখনও বাদল সরকারের স্টাইল ঢোকে নি। মূলতঃ
ব্রজেন দে-র নাটকগুলোই এখানে মঞ্চস্থ হোতো।
কালীপুজায় পঞ্চপ্রদীপ
ক্লাবের তত্বাবধানে বিশাল গানের ফাংশান- অর্থাৎ জলসা
হতো। নামী
দামী গায়কেরা, বেতার-শিল্পীরা আসতো। বিখ্যাত গায়ক শ্যামল মিত্র, গায়িকা হৈমন্তী শুক্লাকে এই পঞ্চপ্রদীপের স্টেজে আমি প্রথম দেখি। গোকুলপুরের পঞ্চপ্রদীপ-মোড় জনারণ্যে ভরে যেতো। আসপাশের
বাড়িঘরগুলোর চালে লোক উঠে বসে থাকতো। যাতে
ভালো করে জলসা দেখা আর শিল্পীদের গান শোনা যায়। একবার তো কালীপুজার কোন এক নামী
শিল্পীর জলসায় একটা ছোটখাটো দুর্ঘটনা হয়েছিল। দোকনের ছাতে বসা অনেকগুলো লোকের
ভার সহ্য করতে না পেরে একটা দোকান ঘরের চালা (অনন্ত রায়
/ সুশীল রায়ের দোকানটা) হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো। পঞ্চপ্রদীপের এই জলসা আর ব্যাপক
কালীপূজা অনেকদিন হলো বন্ধ হয়ে গেছে। পরবর্তী
সময়ে এ ধরণের জলসা খালধারের জনকল্যান সংঘের মাঠে কয়েকবার হতে দেখেছি।
বড় বড় ক্লাবগুলো ছাড়া
বাচ্চাদের ছোট ছোট অনেকগুলো ক্লাব অঞ্চলগত ভাবে ছিল। এই সমস্ত ক্লাবগুলো মুলতঃ ক্ষণজীবি। এগুলো কখনো গজিয়ে উঠতো, কিছুদিন বাদে আবার বন্ধও হয়ে যেতো। এদের কার্যকলাপ ছিল ফুটবল, কবাডি খেলা; বৎসরান্তে একবার স্বরস্বতী পূজা করা। তাছাড়া ছিল একসঙ্গে জটলা বেঁধে
আড্ডা দেয়া। এই
সমস্ত ছোট ছোট ক্লাবগুলো বাচ্চা আর কিশোরদের যৌথ সমাজজীবনে শিক্ষিত হতে প্ররোচিত করতো।
মধু সেনদের বাড়ির সামনে যে রাস্তা সেখানে তৈরী হয়েছিল ছোটোদের ক্লাব – ‘আঞ্চলিক ছাত্র সংগঠন’। আমি নিজে এই সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। পরে ওই ক্লাব ভেঙ্গে এর কিছু সদস্যরা মিলে আমরা তৈরী করি অন্য একটি সংগঠন – ‘বলাকা’। ‘বলাকা’ ক্লাবের অফিস আস্তানা কিছুই ছিল না, একটা মাঝারি সাইজের সুদৃশ্য সাইনবোর্ড রাস্তার ধারে ঝুলতো; তাতে ‘বলাকা’- শব্দটার নীচে লেখা থাকতো কথাগুলো ‘প্রগতিশীল ধর্ম নিরপেক্ষ সংগঠন’। পাড়ার এক বয়স্ক শুভাকাঙ্খী আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বলাকা’ ক্লাবের নামটার নীচে ওই প্রগতিশীল ধর্ম নিরপেক্ষ – এই সব কথাগুলো কেন লেখা হলো? তখন তাকে গুছিয়ে উত্তর দিতে পারি নি। তবে এখন বুঝছি, ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়া গেঁয়ো বাচ্চাগুলো সেই সময়ে প্রগতিশীলতা ও ধর্ম-নিরপেক্ষতার অমন যে ফতোয়া জারি করেছিল, সেটাও কম কথা নয়।
এখানেই অন্য আরেকটি সংগঠন সে সময়ে তৈরী হয়েছিল, নাম ছিল – ‘অমরগোষ্ঠী’। সিদ্ধেশ্বর পোদ্দার, শিবু দে (আমার প্রাইমারীর মাষ্টার মশাই রমেশ দে’র ছেলে)- এরা ‘অমরগোষ্ঠী’র মধ্যে ছিল। একই জায়গায় কিশোরদের এই দুই সংগঠন ‘অমরগোষ্ঠী’ আর ‘বলাকা’ ; এদের মধ্যে ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ রেশারেশি – একদল যেন অন্যদলের শত্রু! পরবর্তী সময়ে ‘অমরগোষ্ঠী’ থিয়েটার নাটক নিয়ে এ অঞ্চলে কিছু কাজ করেছিল।
এখান থেকে এখন এক বা একাধিক পত্রিকা বের হলেও ষাটের দশক পর্যন্ত কোন সাহিত্য পত্রিকা (স্কুল ম্যগাজিন বা স্যুভেনীয়র নয়) বের হয় নি। আমার জ্ঞান অনুযায়ী ‘উদয়ের পথে’ নামক সাহিত্য পত্রিকাই গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ
অঞ্চলের প্রথম সাহিত্য পত্রিকা। পত্রিকাটি
প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৭৯সালে ( ইংরেজী ১৯৭৩)।
‘আঞ্চলিক ছাত্র সংগঠন’এর সদস্যরা সরস্বতী পূজার
খরচা থেকে পয়সা বাঁচিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশ করতে উদ্যোগ নিয়েছিল।
‘উদয়ের পথে’ পত্রিকার সম্পাদনা আমিই করেছিলাম। উপদেষ্টা ছিলেন দেবনারায়ণ রায়। লেখক লেখিকার তালিকায় যারা ছিলেন
তারা হলেন – জয়নারায়ণ রায়, রীতা
রায়, আলো দে, সত্যেন্দ্রনাথ বিশ্বাস,
সমরেন্দ্র বিশ্বাস, উত্তম বসু (ননীগোপাল বসুর ছদ্মনাম), তুষার চক্রবর্তী(বিশু)। ‘উদয়ের পথে’র দ্বিতীয় সংখ্যা এর কয়েক বছর বাদে বের হয়। এই সংখ্যায় প্রকাশনার সঙ্গে উজ্জ্বল
ঘোষ,
নীহাররঞ্জন ঘোষ (ব্যাঙ্ক কর্মী – এককালে গোকুলপুরে ভাড়া থাকতো) বিশেষভাবে যুক্ত ছিল। পত্রিকাটিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা সুন্দর ছোটগল্পও ছাপা হয়েছিল। এই দুটো সংখ্যার পরেই ‘উদয়ের পথে’র প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।উপরের হিসেব মতো এই এলাকায় ‘অন্বেষা’
পত্রিকাকে ‘উদয়ের পথে’ পত্রিকার
উত্তরসূরী বলা যায়।
এক্ষেত্রে আরো একজনের
নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য – সে হলো আমার সহপাঠী পীযূষ বাক্চি। সন্নিহিত
জোনপুর এলাকা থেকে খুব আন্তরিক, সুচারু ও নিয়মিত ভাবে সাহিত্য
পত্রিকা প্রকাশনার কাজ চালিয়ে গেছে পীযূষ বাক্চি। ওর পত্রিকা ‘কিংশুক’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২সালে। সে সময়ে আমি চাকুরী সূত্রে ভিলাই
চলে এসেছি, তবুও পীযূষের পত্রিকার সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ
ছিল। পরবর্তী
সময়ে পীযূষ বাক্চির সম্পাদনা ও উদ্যোগে জোনপুর
থেকে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে ‘দীপিকা’ পত্রিকাটি (প্রথম প্রকাশ – ১৯৮৭)। সেদিক থেকে জোনপুরের ‘কিংশুক’ ও ‘দীপিকা’ পত্রিকা নিঃসন্দেহে গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ অঞ্চলের
‘অন্বেষা’ পত্রিকার প্রকাশকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
পয়সার অভাবে ছাপা পত্রিকা
সব সময়ে বের করা সম্ভব হতো না। তাই
লেখালেখির তাগিদে তখন প্রকাশিত হতো হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা। সত্তর দশকে ‘উদয়ের পথে’র দেয়াল পত্রিকার কয়েকটা সংখ্যা বেরিয়েছিল। তাছাড়া সিদ্ধেশ্বর পোদ্দারের ‘স্বাতী’ দেয়াল পত্রিকার নাম মনে পড়ছে।
এসব পত্রিকা ছাড়াও আশির
দশক,
তার কাছাকাছি সময়ে এ অঞ্চল থেকে আরো কয়েকটা সাহিত্য পত্রিকা বের হয়,
যেমন ‘মুকুল বার্তা’, ‘বনলতা’,
‘পাতাবাহার’। কল্যানী
থেকে
‘পূবের আকাশ’, গয়েশপুরের ‘তরুণ প্রভা’ ও কাঁচরাপাড়া থেকেও কয়েকটা পত্রিকা সে সময়ে
বের হতো। পীযূষ বাক্চির সম্পাদনায় জোনপুর থেকে ‘প্রতিমুখ’ নামে একটা কাগজ বেশ কিছুদিন বেরিয়েছিল। মনে আছে, তাতে আমার একটা ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছিল। পরে কাগজটি বন্ধ হয়ে যায়।
মনে পড়ছে ‘গনবিজ্ঞান
বার্তা’ পত্রিকাটির নাম। কাঁচরাপাড়ার ‘বিজ্ঞান দরবার’ সংস্থার প্রকাশিত পত্রিকা ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ অনেকটাই নিয়মিত ও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। কুসংষ্কার বিরোধী আন্দোলন ও বিজ্ঞানমনস্কতা
জাগরণের জন্যে ‘বিজ্ঞান দরবার’ সংস্থা,
তাদের প্রকাশিত কাগজটি ও পুস্তিকাগুলোর ভূমিকা অবশ্যই খুব প্রশংসনীয়।
পরবর্তী সময়ে এইসব অঞ্চল থেকে অনেক পত্রপত্রিকা বেরিয়েছে। যে পত্রিকাগুলো সম্প্রতি মোটামুটি নিয়মিত দেখতে পাচ্ছি বা আমার কাছে সাম্প্রতিক সময়ে এসে
পৌঁছেছে, তার কয়েকটা হলো চাতক, নান্দনিক, অন্বেষা, আজকের অনুভব(কাঁচড়াপাড়া), মৈত্রীদূত (কল্যানী)। এ ছাড়াও এসব অঞ্চলগুলো থেকে যে সব ছাপা কিংবা দেয়াল পত্রিকাগুলো বেরিয়েছিল বা ভবিষ্যতেও বেরোতে পারে তার তালিকাটা যথেষ্ট দীর্ঘ। এইসব পত্রিকাগুলোর নাম – ‘রেনেসাঁ’, ‘শনিবারের আড্ডা’, ‘অনামী’, ‘উত্তরের হাওয়া’, ‘রোদ্দুর’ ইত্যাদি। এছাড়া আরো কিছু পত্র পত্রিকা থাকতে পারে যা আমার তালিকা থেকে বাদ গেল।
এককালে উদ্বাস্তু সমস্যায়
জর্জরিত,
স্বল্প শিক্ষিত ছিল গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ অঞ্চলের
মানুষজন। বর্তমানে
সাস্কৃতিক ও শিক্ষাগত উন্নয়ন অবশ্যই হয়েছে। স্বল্প
শিক্ষা,
নিরক্ষরতা, স্কুলে না যাওয়া যে যুগটা এককালে ছিল,
সে দশাটা আজকের এই অঞ্চলগুলি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। ২০১১র সেন্সাস অনুসারে, গয়েশপুর পৌরসভার জনসংখ্যা মোটামুটি ৫৯হাজার, এর মধ্যে স্বাক্ষরতার হার ৯০ শতাংশ [ যেখানে পশ্চিমবঙ্গের গড় স্বাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, সূত্র
- ইনটারনেট]। এজন্যে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ১৯৬০-৮০ সালের তুলনায়, গোকুলপুর- কাঁটাগঞ্জ- গয়েশপুর অঞ্চলের মানুষজনের স্বাক্ষরতার শতাংশ হার অনেকটাই বেড়েছে।
৭
পরিশেষে : শত চিন্তার দ্বন্দ্ব হোক, শত ফুল বিকশিত হোক
গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ অঞ্চলের দিনগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই, সেই
সব বিগত সময়কে আজকের দিনগুলোর সাথে যখন তুলনা করি, তখন
কতগুলো কথা উঠে আসে। এই লেখার পরিশেষে সেসব কথাগুলো একটু
ছুঁয়ে যেতে চাই। এগুলি অবশ্যই আমার নিজের ভাবনা-চিন্তা, একান্তই নিজস্ব মূল্যায়ন।
ষাট ও সত্তরের দশকে
গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ ও তার সন্নিহিত অঞ্চলের চেহারায় দারিদ্রের যে তীব্র ছাপ ছিল,
তা আজকে নেই। কলকাতা, কল্যানী
ও আসে পাশের নানা উপার্জনের দিক খুলে যাওয়ার কারণে এখানকার মানুষ আর্থিক দিক থেকে
উন্নততর অবস্থায় এসেছে। আগের থেকে সাধারণ ভাবে তাদের গড় আয়ও
বেড়েছে।
আয় বাড়া এক কথা, আর জীবনযাত্রার মান বাড়া অন্য কথা। এই
অঞ্চলের মানুষজনদের গড় জীবনযাত্রার মান? পার্শ্ববর্তী
বহু শহরতলীতে যেমনটা বেড়েছে, এখানে তা ততটা বাড়ে নি। জীবন
যাত্রার জন্যে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দিক, বিশেষতঃ
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিসেবা, এই এলাকার মানুষজনের জন্যে
যথেষ্ট নয়।
সম্প্রতি পৌর সভার
মাধ্যমে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিসেবা
হয়েছে। পানীয় জলের সরবরাহ অনেক ভালো হয়েছে। ভবিষ্যতে
এরকম উন্নয়নমূলক কাজ হয়তো আরো হবে। তবে পৌর পরিকল্পনার অধীনে আরো অনেক কাজ
করা যেতে পারে। যেমন, জঞ্জাল
অপসারণ পদ্ধতির উন্নতি, রাস্তা ঘাটগুলোর নাম বা নাম্বার দিয়ে
চিহ্নিতকরণ, ড্রেন ব্যবস্থার আরো উন্নয়ণ, জলাশয়গুলিকে উপযুক্ত ভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
উন্নয়ণমূলক যে কোন
কাজকে মানবিক কর্তব্য ভেবে নিয়ে তাকে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেয়ার জন্যে আন্তরিক, অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। বিভিন্ন
সমবায়মূলক কাজকর্ম এখানে তেমনভাবে তৈরী হয় নি। ছোট
শিল্প,
কৃষি, ব্যবসা সব ক্ষেত্রেই সমবায় মূলক
প্রচেষ্টা (Co-Operative Society) চালু করার চেষ্টা উচিত ছিল। আসপাশের
যে সব এলাকায় এখনো কৃষিনির্ভর অবস্থা রয়েছে, সেখানে
সার্ভে করে সমবায় ভিত্তিক ঋণ দেয়া, ফসল সংরক্ষণ, বিপণন ও কৃষকদের স্বার্থরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করবার
প্রয়োজনীয়তা এখনও আছে। তা’হলেই তো গর্ব
করে বলতে পারবো, উদ্বাস্তু-প্রধান,
সমস্যায় ভরা, নিম্ন আয়ের এই অঞ্চলের করুণ
ইতিহাসকে আমরা ধীরে ধীরে নির্মানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি।
দেশ ও সমাজের চারপাশে
বাধাহীন বিবেচনাহীন পুঁজিবাদী বিকাশ ও তার ফলাফল হিসেবে নানা সমস্যা আসবেই। সেই
অনুযায়ী গ্রামীন ও মফস্বল সভ্যতার মধ্যেও একধরণের বিকাশগত অস্থিতি
(Imbalance) দেখা দেবে। গ্রামীন
সভ্যতার চিরাচরিত আন্তরিক ও মানবিক সম্পর্কগুলোর মধ্যেও ভাঙন দেখা দেবে।
- এসব লক্ষণ গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ ও তার
সন্নিহিত অঞ্চলেও ঢুকে গেছে। সুসংস্কৃতির পাশাপাশি এ অঞ্চলে একটা
আন্তরিক ও মানবিক পরিমন্ডল কিভাবে গড়ে তোলা যায়, সে
ব্যাপারে ভাবনা চিন্তার অবকাশ আছে। এসব সমস্যা শুধু এই অঞ্চলের না, দেশের কোনে কোনে এরকম সমস্যা অনেক জায়গাতেই তৈরী হয়ে আছে!
এই অঞ্চলের
সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ক্লাবগুলোর ক্ষেত্রে যৌথ মঞ্চ গড়ে তোলার চেষ্টা করা উচিত। আজকেও
এ অঞ্চলের বেশির ভাগ সংগঠন ও পত্র পত্রিকাগুলো একক এবং আলাদা আলাদা। আপাততঃ কোনো বিশেষ পার্টির মঞ্চ থেকে নয়, বিভিন্ন সংগঠন ও পত্র পত্রিকার একটা যৌথমঞ্চ থেকে মাঝে মাঝেই সামাজিক বা
সাংস্কৃতিক বিষয়ের উপর যৌথ প্রোগ্রাম বা সভা সমিতি হওয়া উচিত। ছোট
ছোট গ্রুপগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় তৈরী হলেই সংস্কৃতির প্রকৃত প্রসার হতে পারে।
আমরা সবাই আলাদা আলাদা নিজের বৃত্তে কাজ করি। তাতে
ক্ষতি নেই। তবুও নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্য, কথাবার্তা, মত বিনিময় ও মেলামেশা যেন বজায় থাকে। জাতি
ধর্ম নির্বিশেষে আমরা যেন একটা সমন্বয় মূলক পরিবেশ তৈরী করতে পারি। গোকুলপুর-কাঁটাগঞ্জ ও সন্নিহিত এলাকাগুলোর মধ্যেও এমন পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরী হোক। এই
প্রসঙ্গে একটা বহুল পরিচিত উক্তি মনে পড়ে - ‘শত
চিন্তার দ্বন্দ্ব হোক, শত ফুল বিকশিত হোক’। অবশ্য মানুষের অর্থনৈতিক সুস্থিতি ও সাম্য সমস্ত সমাজ ব্যবস্থায় একটা বড়ো প্রশ্ন। এ প্রশ্নটা এখানেও প্রাসঙ্গিক।
==============
==============
[লেখাটা ‘অন্বেষা’-
শারদীয়া ১৪১৪ সংখ্যায় প্রথমে প্রকাশিত হবার পরে কিছুটা সংশোধিত করা হয়।]
Comments
Post a Comment