মুখ ও মুখোশ
গল্প
মুখ ও মুখোশ
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
#এক #
এয়ারপোর্টের গেট দিয়ে
দিয়ে ঢোকবার সময়ে সাইডব্যাগে আরেকবার দেখে নিচ্ছিলাম আমার দরকারী জিনিষগুলো -
মুখোশ, টুপি, পরচুলা, নকলি গোফ। একটু ভয় ভয় করছিল। তখনই নজরে পড়লো পুরোনো পরিচিত
মুখটা। লোকটা এদিকেই এগিয়ে আসছে! যাক গে, আমি যাবো বোম্বের ফ্লাইটে - মেয়ের কাছে। হনহন করে এগিয়ে গেলাম চেকিং পয়েন্টে। ফ্লাইটটা এসে গেছে।
হাত পাদুটো নাচাতে নাচাতে হ্যাণ্ড-লাগেজগুলো নিয়ে চেকিং টেকিং করিয়ে টিকিট দেখিয়ে
উঠে গেলাম প্লেনে। আমার জানালার পাশেই সীট।
সীটে বসেই ছিলাম। তখন
ভিমরি খেয়ে দেখলাম সেই মুখটাই এদিকে এগিয়ে আসছে! লোকটা আমার পাশের খালি সিটটায়
বসলেন। বসবার পর সীট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে উনি আমার দিকে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে
লাগলেন। উনি কি এতোদিন বাদেও আমাকে চিনতে পেরেছেন? না, আমি ওনাকে
চিনি না! সীটে বসে বসেই স্যুটেড বুটেড
মানুষটা আমার সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলেন - ‘আর ইউ ফ্রম নয়ডা? আই রিকগনাইজ ইউ,
মিষ্টার ব্যানার্জী? ফ্রম মেন্সি লিমিটেড?’
কি ঝকমারি! এই লোকটাকে আমি
আমার পুরোনো এক্সিকিউটিভ মুখখানা দেখাতে চাই না।
‘সরি! ইউ আর ডুইং সাম
মিসটেক!’- আমার মুখ থেকে স্বচ্ছন্দেই কথাগুলো বেরিয়ে এলো। লোকটার থেকে আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। উড়ন্ত এরোপ্লেনের জানালা দিয়ে আকাশ আর মেঘ দেখতে লাগলাম।
লোকটার নাম মিষ্টার ধনঞ্জয়। আমি ওনার কাছে এখন আমার নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে চাই। প্লেনের মধ্যে বসে তো
আর আমার খেলনা মুখোশটা পরে নিতে পারি না। লোকেরা হাইজ্যাকার ভাববে। অন্য একটা
বুদ্ধি খেলে গেল, পকেটে রাখা মুসলমানি টুপিটা চটজলদি মাথায় পরে নিলাম, যেন এখন
আমার নামাজ পড়ার সময় হয়েছে। প্লেনে সফরের এই ঘন্টা তিনেক সময়ে ওই লোকটার কাছে আমি
ব্যানার্জীর বদলে বদরুদ্দীন হয়ে গেলাম। তখনই আমার মাথার মধ্যে দাপাদাপি করে উঠে
এলো পুরোণো কিছু রক্তমাখা শরীর! আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। ব্রীজের নীচে চাপা পড়া
সেইসব মৃতদেহগুলো চিৎকার করে আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলতে লাগলো – ‘তোর, তোর, তোর
জন্যেই আমরা লাশ হয়ে গেলাম ...’! সত্যিই কি ঘটনাটার জন্যে আমিই দায়ী ছিলাম?
ফ্লাইটের বাকী সময়টুকু মাথায়
সাদা টুপি, দুচোখ বন্ধ করে ঝিমকি মেরে পড়েছিলাম, ঘুমোই নি। মনে তোলপাড় করছিলো
প্রায় বছর দশেক আগেকার মেন্সি লিমিটেডের একটা দিন। অথচ সেসব পুরোনো দিনগুলোকে এখন
একদম মনে করতে চাই না। আর কতক্ষণেএ ফ্লাইটটা
বোম্বে পৌঁছাবে?
আমার পাশের সীটে বসা এই লোকটা,
মানে ধনঞ্জয়, খুব ইমপর্টেন্ট লোক। প্রায় বছর দশেক আগেকার কথা, কোম্পানীর কাজে তখন বাধ্য
হয়ে এনার সঙ্গে আলাপ জমাতে হয়েছিলো। তখন লোকটা দিল্লীর একটা হোটেলে উঠেছিলো। কোম্পানির থেকে
আমাকে কাজটা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিলো। আমার মতো এক্সিকিউটিভদের তক্কে তক্কে থাকতে হয়, লোকেদের
নাড়িনক্ষত্রের খবর নিতে হয়, জানতে হয় কে কখন কোথায় থাকছে, কে কেমন লোক, তাদের
ফেমিলি টেমিলির খবরটবর! নইলে এ চাকুরীতে টিকে থাকা মুস্কিল!
যেমন করেই হোক, নতুন
ফ্লাই ওভারের কন্ট্রাক্টটা পেতে হবে। আমার কোম্পানী আমাকে এ দায়িত্বটা দিয়েছিল। মিষ্টার
ধনঞ্জয় চাইলেই পারে এ কাজটা করিয়ে দিতে। উনি কর্পোরেশনের অ্যাডভাইসার, তাছাড়া তখন
মিনিষ্টারির কিছু দায়িত্বেও ছিলেন।
সিধা হোটেলেই চলে গেলাম।
দিল্লীর নামী হোটেলটার এয়ারকন্ডিশন রিসেপশন। আমার পাশে বসা এই লোকটার সঙ্গেই সেদিন
দেখা করতে গেছিলাম। ওরাই আমার ভিজিটিং কার্ডটা ভেতরে পাঠিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে জবাব এলো, মিষ্টার ধনঞ্জয় ভিডিও কফারেন্সিং
করছেন, সময় লাগবে।
হোটেলএর ওয়েটিং লাউঞ্জে
অনেকক্ষন বসে থাকার পরে আমার ডাক এলো। লোকটার স্পেশাল কামরা। পরণে একটা ট্রাউজার
আর নীল শার্ট, হাতে আমারই পাঠানো ভিজিটিং কার্ডটা, উনি আমাকে ভেতরে ডেকে নিলেন।
- ‘ইউ মিষ্টার বি সি ব্যানার্জী?
মেন্সি লিমিটেড? হোয়াটস দি ম্যাটার?’
কিছুক্ষন ইনিয়ে বিনিয়ে
একথা সেকথা বলার পর আমি দাবার গুটি চাললাম। বললাম,- ‘স্যার, নতুন ফ্লাই ওভারের
কন্ট্রাক্টটা আমরা পেতে চাই। মেন্সি লিমিটেড এসব কাজে খুব এফিসিয়েন্ট, এর থেকে বড়
বড় কাজ ... ।’ লোকটা আমাকে জরিপ করছিল।
- ‘এরকম অনেকগুলো ফ্লাই ওভার আমরা আগেও বানিয়েছি, স্যার!’
ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথার জাল বুনছিলাম সেদিন। এই লোকটাও কম ধুরন্ধর না! শেষ পর্যন্ত
সু্যোগ বুঝে মাছের টোপের মতো এগিয়ে দিয়েছিলাম কথাটা - ‘স্যার, এ গিফট ফ্রম আওয়ার
কোম্পানী। আমাদের চেয়ারম্যান মিষ্টার শুক্লা, ব্যস্ততার জন্যে উনি নিজে আপনার
সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেন নি।’
হোটেলের ওই রুমে সেদিন ছেড়ে এসেছিলাম কালো ব্রিফকেসটা। টাকা
ভর্তি। প্রথমে মৃদু আপত্তি ছিলো। তবুও তিনি গ্রহন করেছিলেন। বুঝলাম
আমাদের কাজটা হয়ে যাবে। বিজয়ীর মতো বেরিয়ে এসেছিলাম আমি। টেন্ডারের দফা রফা করে কিছুদিন বাদে আমাদের কোম্পানী ফ্লাইওভারের অর্ডারটা
পেয়েছিলো।
তারপরে একদিন সেই ভয়ংকর কান্ডটা! কন্সট্রাকশন হয়ে যাবার
ছ’বছরের মাথায় ব্রীজের একশো মিটারের লম্বা একটা অংশ হঠাৎ ভেঙ্গে পড়লো, তাতে মারা গেলো
ছজন লোক, কিছু মানুষ আহতও হলো। জানি না আমার কোম্পানীর
লোকেরা ঠিকঠাক সিমেন্ট বালি রড দিয়েছিলো কিনা? তারপর থেকেই সেই দোমড়ানো রক্তমাখা
শরীরগুলো মাঝে মধ্যেই আমার স্বপ্নে ভেসে আসতো। কোম্পানি আমাকে এমন একটা
ফ্লাইওভারের কন্ট্রাক্ট বাগানোর কাজে লাগিয়েছিলো, যেটা কিনা ছ’বছরের মধ্যেই ভেঙ্গে
পড়বে? ঘুষ দিয়েছিলাম এই লোকটাকেই? মিষ্টার ধনঞ্জয়! যিনি এখন ফ্লাইটে আমার পাশের
সীটে বসে আছেন। উনি এতদিন বাদেও আমাকে কি
সত্যিই চিনতে পেরেছেন? হয়তো তাই। নাঃ, এই লোকটাকে দ্বিতীয়বার আমার পরিচয় দিতে চাই
না। সে তো কত বছর আগেকার কথা। ‘সরি! ইউ আর ডুইং সাম মিসটেক!’ – আমার এই সোজা
সাপ্টা উত্তরে মিষ্টার ধনঞ্জয়ও হয়তো ভেবেছিলেন, ওনারই কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে।
মিনিট সেকেন্ড গুনছিলাম।
দুচোখ বন্ধ, মাথায় টুপি, অস্বস্তিতে আমার সময় কাটছিল। ঘন্টা তিনেক বাদে ফ্লাইট বোম্বে ল্যান্ড করলো। মিষ্টার ধনঞ্জয় তার
হ্যান্ডলাগেজ নিয়ে নেমে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে আমি চোখ খুললাম, সাদা মুসলমানী টুপিটা
মাথা থেকে খুলে নিলাম, প্লেন থেকে আমার হাতব্যাগটা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে
এলাম, একেবারে সবার শেষে।
#
আমার কথা যখন বলতেই
বসেছি, আমার পরিচয়টা আপনাদেরকে দিতে হচ্ছে। আমি ছিলাম মেন্সি লিমিটেডের লায়াসন অফিসার। লায়াসন মানে দুই পক্ষের মধ্যে
যোগাযোগকারী এজেন্ট! আমার পুরো নাম বদন চন্দ্র ব্যানার্জী। চাকরী জীবনে আমি সত্যিই
ছিলাম বদন – মানে কোম্পানীর মুখ, যে মুখটাকে কাজের জন্যে হতে হয়েছিল ভীষণ সক্রিয়,
অত্যন্ত চতুর, কখনো কখনো গোপন নিঃশব্দ! নিজের কোম্পানীকে অর্ডার পাইয়ে দেয়ার জন্যে
এদিক সেদিক যোগাযোগ রাখা, বিভিন্ন ভি আই পি-দের সামলানো, তাদের খিদমতগারী করা, ঝামেলার
কাজগুলো নিপটানো – চাকুরীতে এসবই ছিল আমার
ডিউটি। এজন্যে আমি আড়ালে আবডালে ধান্ধাবাজের মতো এদিক ওদিক ঘুরে
বেড়াতাম।
বছর চারেক হলো, চাকরি
থেকে রিটায়ার করেছি। সে সময়কার কিছু কিছু অনৈতিক কাজ- তার অনুশোচনা কিংবা লজ্জা, যাই বলুন না কেন,
এসব থেকে এখনো আমি মুক্তি পাই নি। কিছু কিছু ঘটনা সন্ত্রাসের মতো আমাকে তাড়া করে,
কিছু কিছু মানুষকে আমি ভয় পাই, কিছু কিছু মানুষকে পুনর্বার আমার এ শ্রীমুখখানা
দেখাতে লজ্জা হয়! আপনারা নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করবেন।
এই তো সেদিনই মিস্টার
পোদ্দার কণ্ণট-প্লেসে আরো কারোর সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বুঝলেন না? আমি যখন
চাকুরীতে ছিলাম, তখনকার আমাদের ফ্যাক্ট্ররি-ম্যানেজার মেন্সি লিমিটেডের মিস্টার পোদ্দারের
কথা বলছি। যেই দেখলাম লোকটা আসছে, টুক করে একটা সাবওয়ে দিয়ে নেমে অন্য ফুটপাথে চলে
এলাম। যতদিন চাকুরী ছিল আলাদা কথা, এখন এসব লোকজনদের মুখ দেখতেও ঘেন্না করে।
#দুই #
সেও কয়েক মাস আগের কথা। গেছিলাম
এখানকার বোটানিক্যাল গার্ডেনে। একা একা সাইড ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ দেখি, গাড়ি থেকে নামলো এক
পুলিশ অফিসার, সঙ্গে তার পরিবার, বউ, ছেলে মেয়ে হবে আর কি! আরে এই তো সেই লোকটাই -সালভাদোর
ডালির মতো ইয়া লম্বা ছুঁচালো গোঁফ। এতোদিন বাদে দেখেও আমি মানুষটাকে ঠিক চিনে
নিয়েছি। না, কোন রিস্ক নেয়া নেই।
একটা গাছের আড়ালে গিয়ে
সাইড ব্যাগ থেকে বের করে নিলাম খেলনা মুখোশ আর পরচুলাটা, চুপিচুপি সেগুলো পরে
নিলাম। এই পুলিশের বড়কর্তাকে আমার চেহারা দেখাতে চাই না, ওরা যেদিক দিয়ে আসছিল আমি
তার উলটো দিকে হাঁটা লাগালাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনে এলোপাথারি অনেকগুলো রাস্তা।
আমি একটা ভবঘুরের মতো মুখোশ পরে ঘুরছি তো ঘুরছিই। মিনিট পনেরো বাদে, ওমা! দেখি ঘোরা পথে সেই পুলিশ অফিসার আমার সামনেই এসে
হাজির! একদম মুখোমুখি, আমার সটকে পড়ার অন্য কোন রাস্তা নেই!
পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে
যেতে উর্দি পরা লোকটা আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,- ‘রাস্কেল,
কাহাকা! এ পাগলা উজবুক মাস্ক পহিনকে ইধার কিউ ঘুম রহা!’
এই সেই পুলিস অফিসার, জি
কে মহাজন! আবার ফ্লাশব্যাকে মনে পড়ে গেলো এক্সিকিউটিভ সময়ের পুরোনো দিনটা!
প্রায় আট বছর আগেকার
কথা! রাত তখন দুটো। আমার কোম্পানীর চিফ একজিকিউটিভ মিষ্টার হাজারির ফোন।
-‘ব্যানার্জী , জলদি আমার বাংলোতে আসো, আই অ্যাম ইন ট্রাবল। কাম, ইমিডিয়েটলি!’
চিফ একজিকিউটিভের ফোন
মানে আমার কাছে কোর্টের আদেশ। মাঝ রাত পেরোনো বিছানায় নরম ওম আর শিথিল আবেস্টনী;
কি আর করা! তড়িঘড়ি অফিসের ড্রেস পরে ছুটলাম চিফ একজিকিউটিভের বাংলোয়।
দেখলাম, উঠানে কোম্পানীর
গাড়ীটা দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টার হাজারি বারান্দায় পায়চারি করছেন; আমাকে দেখে পুরোপুরি সারেন্ডার করে
দিলেন -‘মিষ্টার ব্যানার্জী, আপনার হেল্প চাই। রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্টাল রানওভার
কেস! মনে হচ্ছে, ফুটপাথে যারা শুয়েছিলো সব কটাই শেষ।’
-‘স্যার, কি যে বলছেন,
বুঝতে পারছি না! আপনার গাড়িতে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? আপনার তো কিছু হয় নি?’
-‘এই কিছুক্ষণ আগে, রাত
দেড়টা, ড্রাইভ করে আসছিলাম। একটা পার্টি ছিলো। খালি রাস্তা। স্পীড কার।
ক্যাম্প-টু’র কাছে একটা গরুকে বাঁচাতে গেলাম! স্টীয়ারিংটা ঘুরে গিয়ে আমার গাড়িটা
ফুটপাথে উঠে গেল। ব্রেক লাগালাম। আর্তনাদ। মনে হলো, কিছু
লোক ফুটপাথে শুয়েছিলো, তারাই- মনে হচ্ছে...... !’ চিফ একজিকিউটিভকে ভীষণ উদ্বিগ্ন
লাগছিল।
-‘তারপর!’
-‘না , গাড়িটা বন্ধ হয়
নি। বুঝলাম একটা লাফরা হয়ে গেছে। আমি আর দাঁড়ালাম না।
স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে সিধা রাস্তায়। শুনলাম, আমার পেছন পেছন ছুটে আসছে কয়েকটা চীৎকার! জানি না, কেউ গাড়ির
নাম্বারটা নোট করেছে কিনা!’
আমি হা করে ওনার মুখের
দিকে তাকিয়ে। চিফ একজিকিউটিভ অনুরোধ করলেন, -‘ব্যানার্জী, গো ইমিডিয়েটলি টু দি
স্পট, বড় রাস্তায়, ক্যাম্প-টু এর মোড়টার কাছেই, দুশো মিটারের মধ্যেই হবে। তোমাকে
পুরো ম্যানেজ করতে হবে।’
মাঝ রাত্তির পেরিয়ে এ কি
আপদ! কি মুস্কিলেই না পড়া গেছে। চিফ একজিকিউটিভের আদেশ। বুক আমার টিপটিপ করছিলো। কি জঞ্ঝাটের এ চাকুরী। তবুও মুখে বললাম –‘এক্ষুনি
যাচ্ছি স্যার! দেখছি। কি করা যায়!’
বুঝলাম, হাজারি সাহেব
খুব টেনশনে আছেন। আমি গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবো, উনি ডাকলেন – ‘শোনো, এই টাকাটা
নিয়ে যাও। পঞ্চাশ হাজার আছে। থানা পুলিশ যা করতে হয়
সব করবে। তোমাকে ম্যানেজ করতে হবে। দেখো, আমার নামে যেন মার্ডার কেস-টেস না লাগে! আমি
জানি, তুমি পারবে!’ এই বলে টাকার একটা থলে, তৈরী করাই ছিলো, আমার হাতে তুলে দিলেন।
আধো অন্ধকারে আমি গাড়ি
ছোটাচ্ছি, ক্যাম্প-টু এর দিকে। বুঝলাম, সাহেবের ঘরে ফেমিলি আউট অফ স্টেশন। তাই
কোথাও মালটাল টেনে, মস্তি টস্তি সেরে সাহেব ঘরে ফিরছিলো। অন্য সময় তো চিফ
একজিকিউটিভের গাড়ি চালানোর জন্যে কোম্পানীর ড্রাইভার থাকে। আসলে মস্তি টস্তির ব্যাপার তো, তাই হয়তো সাহেব নিজেই গাড়ি চালিয়ে বেপাড়ায়
গেছিলেন।
অকুস্থলে পৌছে দেখি
প্রচুর লোকজন। তিনটে পুলিশের গাড়ি। ফুটপাথে তিন তিনটে পিষে যাওয়া রক্তাক্ত
শরীর।
সালভাদোর ডালির মতো ইয়া
লম্বা ছুঁচালো গোঁফয়ালা এই পুলিশ অফিসারটি, বোটানিক্যাল গার্ডেনে এইমাত্র দেখা
লোকটিই সেদিন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সঙ্গে সাঙ্গপাঙ্গ পুলিশের দল, তারা তদন্ত করছে !
আমিও লোকজনদের মধ্যে
ভীড়ে গেলাম। সামান্য দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখতে লাগলাম। পুলিশগুলো জড়ো হওয়া
ভীড়কে জিজ্ঞেস করছিল, ঘটনাটা কেউ নিজের
চোখে দেখেছে কি না? কখন? ঠিক কটার সময় এটা হয়েছে- ইত্যাদি নানা প্রশ্ন!
একটু কাছে যখন গেলাম, দেখলাম জায়গাটা আর জমিতে পাতা চাদরগুলো লাল টাটকা রক্তে
ভিজে আছে। ধ্বংসাত্মক চেহারা! শিউরে উঠলাম, গাড়ির চাক্কায় একটা লোক পুরো পিষে
গেছে, অন্য একজনের পেটের নাড়ি ভূড়ি বেরিয়ে এসেছে; তৃতীয় মানুষটার দেহটা আবিকৃত
আছে, মাথাটা চেনা যাচ্ছে না! কাছাকাছি এই ফুটপাথে আরো অনেকেই শুয়ে ছিলো, চাপা
পড়েছে তিনজন। ঘটনাটা ঘটে যাবার পর ওদেরই একজন সামনের দোকানের গার্ডকে ঘুম থেকে
উঠিয়ে পুলিশকে খবর দিয়েছে।
ছুঁচালো গোঁফয়ালা পুলিশ
অফিসারটা হম্বি তম্বি করছে। কি ছিলো গাড়ীটার নাম্বার? কে কে ঘটনাটা দেখেছে? কি রঙের
ছিলো গাড়িটা?
ফুটপাথে যারা শুয়ে থাকে
তারা বেশীর ভাগই দূর কোন অঞ্চলের। শহর কিংবা
ভিন প্রদেশ থেকে কাজ খুঁজতে আসা গ্রাম গঞ্জের লোক। ওরা সারাদিন এদিক সেদিক কাজ
করে, রাতের বেলায় ছোট ছোট দল বেঁধে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এমনি ফুটপাথে শুয়ে থাকে। সকালে কাছাকাছি
নর্দমার ড্রেনে বা মিউনিসিপ্যালিটির টয়লেটে প্রাতঃকৃত্য সারে, রাস্তার নলে চান
করে। তারপর আবার বেরোয় দৈনন্দিন কাজের খোঁজে।
ওদেরই একজন জবানবন্দী
দিলো- ‘গাড়িটার পেছোনে ল্যাখা ছিলো মানসি লিমিটেট ...।’
গাড়ির নাম্বার? ওই
লোকটাই প্রচন্ড ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে বলতে লাগলো, ‘প্রচন্ড শব্দ, ঘুম ভাঙা চোখদুটা
ডইল্যা নিয়া দ্যাখলাম শরীরগুলানের ছটফটানি, ক্যাতরাণির আওয়াজ। একটা কালো রঙ্গের
গাড়ি পাইলে যাচ্ছে। পেছনের নম্বর কিছু পড়া গেল নি।’
পুলিশ অফিসার সব কিছু
নোট করে নিচ্ছে, ব্যস্ত - কারণ লাশগুলো হসপিটাল হয়ে মর্গে যাবে। কেসটার একটা তদন্ত
হবে।
সবকিছু দেখে শুনে একটু
পরে আমিও পাক্কা একনম্বর শয়তানের মতো ওই জায়গা থেকে কেটে পড়লাম। ভাগ্যিস কেউ গাড়ি
নাম্বারটা নোট করে রাখেনি। চিফ একজিকিউটিভ মিষ্টার হাজারি সাহেবকে ফোনে সে কথা জানিয়ে নিজের ঘরে ফিরে
এলাম।
ব্যাড লাক! পরদিন সকালে
পুলিশ স্টেশন থেকে আমাদের কোম্পানীর সেক্রেটারির কাছে ফোন এলো। কিছুক্ষণ পরে সেক্রেটারি
আমাকে ফোন করলো। শালা, আমিই আবার ফাসলাম! ঝাটের লায়াসন অফিসার! অগত্যা আমাকেই
পুলিশ স্টেশনে যেতে হলো। দেখলাম, গোঁফয়ালা সেই পুলিশ অফিসারটি, বুকে নাম লেখা - জি
কে মহাজন।
আমাকে সামনের চেয়ারে
বসিয়ে হেড়ে গলা অফিসারটা বলছে ‘গতকাল রাতে ক্যাম্প-টু এর মোড়টার কাছে একটা
অ্যাক্সিডেণ্ট হয়েছে। এই কেসে মেন্সি লিমিটেডের নাম শোনা যাচ্ছে; বুঝলেন মিস্টার ব্যানার্জী,
আপনাদের কোম্পানির নামে এফ আই আর হচ্ছে।’
আমি ডিফেন্সিভ হলাম।
‘স্যার, থানা থেকে খবর আসার পর আমি অফিসের রেকর্ড চেক করেছি, কাল রাত বারোটার পর
আমাদের কোম্পানির কোন গাড়ী কোম্পানীর ঘেরা বাউন্ডারির বাইরেই বেরোয় নি। ঘটনাটাতো শহরের মেইন রাস্তায়
হয়েছে, রাত দেড়টা-দুটো নাগাদ!’
-‘কিন্তু উইটনেস আপনাদের
কোম্পানীর নামই বলছে। আমাকে কেসটার রিপোর্ট জমা দিতে হবে।’
জি কে মহাজন আমার কাছে অনেক
কিছু রিপোর্ট চাইলো। আমাদের কোম্পানীর সবকটা গাড়ীর নম্বর, তাদের রেজিশট্রেশন
বিবরণ, কতগুলো গাড়ী আছে, কি তাদের রঙ, সমস্ত ড্রাইভারদের নাম ধাম, ইত্যাদি
ইত্যাদি! কথায় বলে না, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। বুঝতে পারছি না, কি করতে হবে!
সন্ধ্যার পর খুঁজে খুঁজে
আমি মিষ্টার মহাজন, মানে সেই পুলিস অফিসারের বাড়িতে হাজির হলাম।
যেহেতু আমি এই কোম্পানীতে চাকুরী করি, আমাদের
চিফ একজিকিউটিভ মিষ্টার হাজারিকে হাজতবাস থেকে বাঁচানোর মহান দায়িত্ব আমারই!
থলেতে পঞ্চাশ হাজার টাকার
কড়কড়ে নোট ছিলো। একথা সেকথা বলার ফাঁকে পুরো টাকার থলেটা ছেড়ে এলাম মিষ্টার
মহাজনের ঘরের সোফায়। লোকটা একটা ধূর্ত চোখ মেলে আমাকে চিনে রাখলো। যেন আমি
কোম্পানীর হয়ে ভীষণ একটা অন্যায় কাজ করতে চলেছি! আমিও জানি, ঘুষ দেয়া কাজটা তো খুব
অন্যায়ের, কিন্তু আমার হাত পা বাঁধা, আমি কোম্পানীর একজন অনুগত চাকুরে।
এমনি ভাবেই সেবার এই মহাজনের
আধা আধুরা রিপোর্টের জোরে বেঁচে গেছিলো আমাদের কোম্পানি। তেমন কোন কেস তৈরী হয় নি আমাদের চিফ একজিকিউটিভের বিরুদ্ধে! শুধু কয়েকবার মিথ্যা
সাক্ষী দিতে আমাদের কোম্পানির কয়েকজনকে কোর্টে যেতে হয়েছিলো।
এতো দিন বাদে সেই জি কে
মহাজন, যাকে আমি ঘুষ দিয়েছিলাম - হায় ভগবান। সেই লোকটাই এখন বোটানিক্যাল
গার্ডেনে! আমি তার মুখোমুখি! এই মাত্রলোকটা রাস্তায় আমার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে
বললো-‘রাস্কেল, কাহাকা! পাগলা উজবুক ......!’ ওরা ভাবলো আমি একটা পাগল! ভাবুক না?
এই বয়স্ক মানুষটার তাতে কিই বা আসে যায়? ভাগ্যিস আমি গাছের আড়ালে গিয়ে আমার মুখোশ আর
পরচুলাটা লাগিয়ে নিয়েছিলাম। ওই গার্ডেনের এক কোনে কতগুলো বাচ্চারা চোর পুলিশ
খেলছিলো, আমি ওদের সামনে মুখোশ পরে মজাদার সব অঙ্গভঙ্গি করছিলাম। ওরা আমাকে দেখে খুব মজা কুড়াচ্ছিলো।
এবার আপনারা বুঝতেই
পারছেন এই বুড়ো বয়সে আমার পকেটে আর সাইডব্যাগে কেন ছদ্মবেশের জিনিষপত্র মজুত থাকে। আসলে কিছু কিছু মানুষের সামনে এখন এই মুখ দেখাতে আমার বিবেকে
বাঁধে। নিজেকে আড়াল করে রাখার মতো নানা কিসিমের টুপি, দুএকটা
মুখোশ, নীল রঙ্গের সানগ্লাস, পরচুলা, এসব আমি সঙ্গে নিয়েই ঘরের বাইরে বেরোই। বলা তো যায় না, কখন কোন মহামান্যের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে,
কখন কি পরিস্থিতিতে পড়তে হবে?
#তিন #
রিটায়ার্ড লাইফে এখন আর
অফিসটফিস যাওয়া নেই। কিন্তু ওই যে একটা রোগ আমাকে ধরেছে। মঝে মাঝে হাটতে চলতে দেখি নির্মীয়মান ফ্লাইওভার ভেঙ্গে কতগুলো লোক মরে পড়ে
আছে। স্বপ্নে দেখি, চিফ একজিকিউটিভের গাড়ির নীচে চাপা পড়া ফুটপাথেরমৃত লাশ। একটা উঁচু চিমনির থেকে গুল্লি-বেঁধাপাখির মতো জমিনে ঝরে
পড়ছে কয়েকটা মানুষ, মর্গের সামনে শোয়ানো মজদুরদের মৃতদেহ। ওদের পরিজনদের গলা ফাটানো চীৎকার।
এ ঘটনাটা ছ’বছর আগেকার
কথা!
চাকরি থেকে রিটায়ার করার
আর কয়েক মাস মাত্র বাকী, মেন্সি লিমিটেড-এ আরেকটা বড় অঘটন ঘটলো! একটা বড় চিমনী
তৈরী হচ্ছিলো। কয়েকজন লোক চারতলা বাড়ির সমান উঁচু চিমনীটার গায়ে প্লাটফর্ম বানিয়ে কাজ
করছিলো। ওদের দুজন মজদুর হঠাৎই উপর থেকে নীচে পড়ে গেলো। স্পট ডেড। অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, শ্রমিকেরা হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দিল। কারখানার মধ্যে যে কোন
মৃত্যুর আইনগত দায় কারখানার ম্যানেজারের।
পুলিশ এলো। মৃত মজদুরদের
পোষ্টমর্টেম হলো।ওদের বাড়িতে তাৎক্ষণিক অনুদান নিয়ে আমি আর কোম্পানীর কয়েকজন লোক গেলাম। মৃতদেহ দুটো দাহ করার জন্যে টাকার ব্যবস্থা করা হলো। সেদিনই ওদের পরিবারের লোকেদের চাকুরীর প্রতিশ্রুতিও দিয়ে আসা হয়েছিলো। এই অঞ্চলের ফ্যাক্টরি
ইন্সপেক্টর দুর্ঘটনার দিনই সরজমিনে দেখতে এলেন, সব কিছু তদন্ত করে গেলেন। চারপাশে
একটা চাপা উত্তেজনা!
সে সময়ে কোম্পানীর জেনারেল
ম্যানেজার ছিলেন পোদ্দার সাহেবে। রাত্রে আমার কাছে তার ফোন, - ‘ব্যানার্জী, ইমিডিয়েটলি আপনি কেসটা টেক আপ করুন। আপনার যা যা হেল্প লাগবে তা সবই পেয়ে যাবেন। কালকেই আপনি ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টরের বাড়ি যাবেন। ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে হবে, এই অ্যাকসিডেন্টে
আমাদের নামে যেন কেস-টেস না লাগে। খুব আর্জেন্ট!’
সে রাতে আমার ভালো ঘুম
হলো না। পরদিন ছিলো রোববার, ছুটির দিন। জানতাম এদিন ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর দাসগুপ্ত
সাহেব ঘরেই থাকবেন। আমি কোম্পানির একজন সংযোগ রক্ষাকারী লায়াসন অফিসার, এসব জানাই তখন
ছিল আমার কাজ। তাছাড়া এর আগেও কোম্পানীর কাজ নিয়ে বেশ কয়েকবার দাসগুপ্ত সাহেবের অফিসে
বা ঘরেও এসেছি। ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর দাসগুপ্ত সাহেব মানুষটা খুব ভালো, খুব ন্যায়
নীতি নিষ্ঠ মানুষ। বলে না, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। আসলে এরকম মানুষদের নিয়েই সবার বেশী
সমস্যা!
ফ্যাক্ট্ররি-ম্যানেজার
পোদ্দার সাহেব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল সবকিছু। আমাদের কোম্পানীর নামে যাতে বড় সড়ো
অভিযোগ না আসে, এটা দেখাই তখন আমার বড় কর্তব্য। ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টরের রিপোর্টে কোম্পানীর গাফিলতির অভিযোগ এলেই লম্বা কোর্ট
কাছারি, ম্যানেজার বা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত অনুসারে শাস্তি! সমস্ত ব্যাপারটাই
ভীষণ ঝামেলার!
পোদ্দার সাহেবের
পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি সঙ্গে নিলাম বেশ কিছু টাকা, কোম্পানীর তরফে জোগাড় করে দেয়া ফ্যাক্টরি
ইন্সপেক্টরের পরিবারের জন্যে দামী গয়নার সেট, নামী দোকান থেকে নেয়া ড্রাই ফ্রুট আর
মিষ্টির সুদৃশ্য প্যাকেট। আসার আগে ইন্সপেক্টর দাসগুপ্ত সাহেবের সঙ্গে ফোনে কথা
হয়েছিলো। উনি আমাকে সময় দিতে চান নি। আমি ওনার পুরোণো চেনা লোক! তাই শেষ পর্যন্ত
আমার অনুরোধ ফেলতে পারেন নি।
এই অ্যাক্সিডেন্ট,
দু’দুটো মানুষের মৃত্যু এনিয়ে খুব ঝামেলা চলছে। সেই রোববারে কোম্পানী ম্যানেজার পোদ্দার
আর অন্য কিছু অফিসার মিলে থানা পুলিশ, প্রেস, পাবলিক আর অন্যান্য দিকগুলো
সামলাচ্ছে। আমার ডিউটি ছিল এই ইন্সপেক্টর সাহেবকে ম্যানেজ করা।
মিষ্টার দাসগুপ্ত এ
অঞ্চলের পুরোনো বাসিন্দা, বেশ বড়ো বাড়ি। কোম্পানীর পাঠানো গাড়ি থেকে নামলাম। পৌঁছতেই
বাড়ির গার্ড আমাকে ওনাদের ড্রইং রুমে নিয়ে গিয়ে বসালো।
একটু পরে ট্রাউজার আর
শার্ট পরে দাসগুপ্ত সাহেব এলেন। এই ঘরোয়া পরিবেশে ওনাকে দেখে বুঝলাম, প্রবীন ও
প্রাজ্ঞ এই মানুষটার বয়েস হয়েছে, শরীরের তেজও কমে আসছে, মাথার চুলে পাক ধরেছে।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে নমষ্কার
করলাম।
-‘কি ব্যাপার
ব্যানার্জী? এই সকালে সকালে আমার কাছে? আমি কালকেই তো তোমাদের ফ্যাক্টরিতে
গেছিলাম। দু’দুটো লোক স্পট ডেড। মেন্সি লিমিটেডের এই খবরটা আজকে খবরের কাগজেও
এসেছে।’
-‘স্যার, যে লোকদুটো উঁচুতে
কাজ করছিলো, তাদের সঙ্গে সেফটি বেল্ট ছিলো। বলা সত্বেও, স্যার, ওরা
সেগুলো স্ট্রাকচারের সঙ্গে বেঁধে রাখে নি! যদি রাখতো তাহলে উপর থেকে এমনি পড়ে যেত
না, অন্ততঃ প্রাণে বেঁচে যেতো! কি আর বলবো স্যার, সবই দুর্ভাগ্য।’
-‘ওরা কিভাবে কাজ করছে
না করছে এসব দেখার দায়িত্ব ফ্যাক্টরির সুপারভাইজারের। ওদের ডেড বডি দুটো দেখে তোমাদের
কষ্ট হয় নি। ওদের পরিবারের কথা তোমরা একবারো ভেবেছো?’
-‘স্যার, তাও একটু
দেখবেন। গতকালই আমরা মৃত লোকদুটোর গ্রামের বাড়ীতে গেছিলাম। পরিবারদুটোর জন্যে পুরো
কমপেন্সেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবুও, এটাকে যদি...... ;
সত্যি বলছি স্যার, আমাদের কোম্পানীর তরফে কোন গাফিলতিই ছিল না। সুরক্ষার পুরো
ব্যবস্থাই মজুত ছিল। আপনার অফিসের রিপোর্টে যদি এই ঘটনাগুলোকে একটু ঠিকঠাক
প্রোজেক্ট করেন, তা’হলে আমরা বেঁচে যাই স্যার ।’
উনি একটু হাসলেন।
আমি আমার ব্যাগ থেকে
প্রথমে কাজু মিষ্টির প্যাকেটটা ওনার টেবিলে রাখতে রাখতে বললাম, - ‘স্যার, অনেকদিন
বাদে বিজয়ার পর আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম; তাই আপনার জন্যে আমার এই সামান্য পাবিবারিক
উপহার, আমি নিজে সিটি সেন্টার থেকে কিনে এনেছি, খুব ভালো কাজুবাদামের মিষ্টি।’
এরপর আমি বুকে অনেকটা
সাহস জড়ো করলাম। ঘুষ দিতে গেলেও যথেষ্ট সাহস থাকার দরকার। আমার ব্যাগ থেকে অন্য
দামী গয়নার বাক্স আর প্যাকেটে মোড়া টাকার বান্ডিলটা ওনার টেবিলে তুলে রাখলাম। মুখে
বললাম- ‘স্যার, সামনেই দেয়ালিপর্ব, কম্পানীর তরফ থেকে এগুলো আপনার গিফট।’
-‘কি আছে এতে?’
-‘স্যার, - পোদ্দার
সাহেবে পাঠিয়েছেন। কোম্পানীর তরফ থেকে দেওয়ালির কিছু উপহার!’ - বলতে বলতে আমি মাথা নীচু করলাম।
-‘দু’টো মৃতদেহকে
ধামাচাপা দিতে এইসব গিফট আর নগদ টাকা দিয়ে মেন্সি লিমিটেডের মিষ্টার পোদ্দার
তোমাকে পাঠিয়েছে! বাঃ ! বাঃ !’
একটু চুপ থেকে আমার দিকে
তাকিয়ে উনি বললেন- ‘তোমাদের একটুও অনুশোচনা হয় না? ওই দুটো মরা মানুষের লাশ তুমি
নিজের চোখে দেখেছিলে? আচ্ছা ব্যানার্জী, বলো দেখি, তোমার এই মুখখানা নিয়ে ভবিষ্যতে
তুমি কখনো ওই মরে যাওয়া মজদুর ফেমিলিগুলোর সামনে দাঁড়াতে পারবে?’
আমি মাথা নীচু করে
বললাম, ‘স্যার, আমি একজন এক্সিকিউতিভ। মেন্সি লিমিটেডের লায়াসন অফিসার। আমাকে
এভাবেই সবার সামনে দাঁড়াতে হায়, সবার মুখোমুখি হতে হয়।’
-‘তুমি আমার পুরোনো
পরিচিত লোক। তুমি বলছো, এই মিষ্টির প্যাকেটটা
তোমার পার্সোনাল গিফট, এটাকে আমি রেখে দিচ্ছি। কিন্তু তোমার কোম্পানীর দেয়া এই উপহারের মোড়ক, টাকার বান্ডিল- এসব কিছু এক্ষুনিই
ফেরৎ নিয়ে যাও। এসব নিয়ে তুমি ফিউচারে আর কখনো আমার কাছে আসবে না!’
আমি ওনাকে বোঝানোর শেষ
চেষ্টা করি। এক কথায় উনি বললেল- ‘সরি, মিস্টার ব্যানার্জী! অন্য লোক হলে এক্ষুনিই ঘর
থেকে বেড়িয়ে যেতে বলতাম; নেহাতই তুমি আমার পুরোণো পরিচিত লোক ......’
একটু থেমে, কি একটা ভেবে
উনি বললেন, ‘হ্যাঁ। আর শোনো। তুমি আমাকে কিছু পার্সোনাল
গিফট দিয়েছো। তোমাকেও আমার একটা কিছু একটা গিফট দিতে হচ্ছে। একটু অপেক্ষা করো।’
উনি ঘরের ভেতর গেলেন। বেশ
কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এলেন। তারপর একটা বন্ধ সুদৃশ্য প্যাকেট আমার হাতে তুলেদিতে
দিতে বললেন – ‘এটা তোমার জন্যে গিফট। ঘরে নিয়ে যাও। ...।’
অগত্যা দাসগুপ্ত সাহেবকে
নমষ্কার জানালাম। ওনার দেয়া রিটার্ণ গিফটটা বুকে চেপে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। প্রত্যাখ্যাত অন্যান্য ঘুষসামগ্রী ও কোম্পানীর
গাড়ীতেই ফেরৎ এলো।
ফিরে এসে আমার একলা কামরায় দাসগুপ্ত সাহেবের দেয়া উপহারের
বন্ধ প্যাকেটটা খুললাম। খুলতেই বেরিয়ে এলো রঙচঙে একটা মুখোশ, মুখ ঢাকবার। মনে পড়লো রিটার্ণ গিফটটা আমার হাতে তুলে দিতে দিতেই মানুষটা বলেছিলেন –
‘কিছুদিন বাদে যখন তুমি চাকুরী থেকে রিটায়ার করবে, তখন এ জিনিষটা তোমার ভাবমূর্তি
রক্ষার কাজে লাগবে।’
মুখে হাত দিয়ে হতভম্ভ হয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম আমি। ওই খেলনা মুখোশটার
সামনে দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো আমার এতোদিনকার অফিসিয়াল আইডেন্টিটি!
[বিঃ দ্রঃ - এই গল্পে বর্ণিত নাম, সংস্থা,স্থান, কাল, চরিত্র - সব কিছুই কাল্পনিক।]
‘দেশ’-
পত্রিকার 2nd June-2020 সংখ্যায় “মুখ ও মুখোশ” প্রকাশিত হয়েছে। ‘দেশ’-
এই সংখ্যাটি করোনা লকডাউনের পরে একটি
সংযুক্ত মুদ্রিত সংষ্করণ< নিভৃত বাসের দেশ > হিসেবে
ছাপা হয়।
Comments
Post a Comment