কেউ আসে না

 গল্প

কেউ আসে না  

 সমরেন্দ্র বিশ্বাস 

#

কাকেরা কি ডাকতে ভুলে গেছে, নাকি চলে গেছে অন্য কোন শহরে? শিবানী সকালে দরোজা খুলে দেখে রাস্তায় জনমুনিষ্যি নেই

রোববার জনতা কার্ফুর পর শঙ্কর দুদিন কাজে গেছিলো দুদিন বাদেই বুধবার থেকে লকডাউন কাজ নেই দিনে শুনসানরাতে ভূত নামে

শুক্রবার সকালে সামান্য কাশি, দুপুরের দিকে হালকা জ্বর এলো শঙ্করের ভয় পায়, এ জ্বর করোণার নয় তো? চারদিকে এখন করোনা ফরোনা কিসব ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওরা নাকি কাউকে পেলেই জ্যান্ত ধরে নেয় লোকের শরীরে ঢুকে পড়ে এজন্যে লোকেদের বাইরে বেরোনো বন্ধ দোকানপাট বাস ট্রেন সবই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ওদের দুজনের কাজে যাওয়াও বন্ধ শঙ্কর দূরে একটা রেল স্টেশনে মাল বওয়ার কাজ করে; ট্রেন বন্ধ , তাই কাজও নেই শিবানী সামনের বাজারে দুতিনটে চায়ের দোকানে বাসন-পত্র মাজে, ঠিকে সময়ের কাজ মার্চের বুধবার থেকে লকডাউনের জেরে সব ডকে উঠেছে!

এরই মধ্যে শঙ্কর শুক্রবার থেকে অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছে কি করে খবর পেয়েছে কে জানে! মিউনিসিপ্যালেটির গাড়ী ওকে ধরে নিয়ে গেছে, সিধা জেলা হাসপাতালে ভর্তি  টেস্টে করোণা পজিটিভ নিয়ম অনুযায়ী একই ঘরে থাকা তার স্ত্রী শিবানীকেও যেতে হয়েছে কোয়ারান্টাইনে কোয়ারান্টাইন সেন্টারে মানে প্রাইমারী স্কুল বাড়ী ওখানে মেঝেতে বিছানা একজন ঘুমন্ত আবাসিক মহিলাকে সাপে কেটেছে, বাঁচানো যায় নি দিন পনেরো কোনমতে জেলা হাসপাতালে কাটিয়ে শঙ্কর ফিরে এসেছে নিজের ঝোপড়িতে শিবানীও তার একদিন আগে ছুটি পেয়েছে খিচি বিচ্ছিরি  কোয়ারান্টাইন সেন্টারটা থেকে ফিরে এসে দেখে ওদের ঘরের দেয়ালে কেউ পোষ্টার লাগিয়ে গেছে  ‘COVID-19, করোণা আক্রান্ত ঘর

এই ঘর মানে টিনের শেড, প্লাস্টারহীন ইটের দেয়াল ওরা থাকে একটা খালের পাড়েহাইওয়ের সামনে ঘর থেকে কয়েক কদম হাঁটলেই ছোট্ট কংক্রীটের ব্রীজ পেরিয়ে ব্যস্ত হাইওয়ে, খালটার সমান্তরাল চলে গেছে হাইওয়েটা এখন নির্জন, যানবাহন শূণ্য

এই লকডাউনে ঘরের দরোজা খুলে ওরা কখনো সখনো একটু আধটু বাইরে বেরোয়, মনটা খারাপ হয়ে যায় শিবানীর মনে হয় এই শহরটাই উঠে অন্য কোথাও চলে গেছে সামনের হাইওয়েতে কোন লোকজন নেই কখনো এক আধটা গাড়ী, অ্যাম্বুলেন্স, প্যাদানি দেয়ার জন্যে পুলিশ রাস্তায় অতি উৎসাহী কেউ কিংবা নিতান্ত কাজের দায়ে বেরিয়ে পড়া দুএকজন মানুষ,- তাদের নাকে মাস্ক লাগানো

চোদ্দদিনের কোয়ারান্টাইন সেন্টার থেকে ফেরার পর সেদিন শিবানী চায়ের দোকানের মালিকের বাড়ী গেছিল, দানাপানির জোগাড়ে বাড়ীতে ঢুকতে দেয় নি কিলোদুয়েক চাল, কিছুটা ডাল আর একশোটা টাকা হাতে তুলে দিয়ে গেটের সামনে থেকেই ফেরৎ পাঠিয়েছে

এই সংক্রমন আর লকডাউনের দিনগুলোয় শঙ্কর আর শিবানী নিজেদের ঘরে অপেক্ষা করে  ভাবে, কেউ না কেউ দেখা করতে আসবে কে আসবেনাম জানে না মনে হয়, যে আসবে সে নিশ্চয়ই ওদের আপনজন সে বিক্রম হতে পারে, মানবও হতে পারে!

কয়েকদিন হলো ওদের ঘরের সামনে কেউ খাবারের প্যাকেট রেখে যাচ্ছে চুপিচুপি কে রেখে যাচ্ছে বুঝতে পারে না কখনো দরজা খুললে দেখে দরজার চৌকাঠের পেরেকটায় ঝুলছে খাবার প্যাকেট কখনো বা কেউ দরজার আংটায় নিঃশব্দে ঝুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ যা খাবার, তা দুজনের জন্যে যথেষ্ট

কিন্তু কে রেখে যাচ্ছে খাবার? বিক্রম, না মানব? না কি অন্য কোন লোক, ওরা কি সরকারী দপ্তরের ভলান্টিয়ার?  এই ধন্ধ ওদের যায় না যেদিন দরোজা খুলে বাইরে বসে থাকে, সেদিন খাবার আসে না যখন দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে যায়, নিঃশব্দে টুক করে কেউ খাবার রেখে চলে যায়!

কোনমতে এভাবেই স্বামী স্ত্রীর দিন গুজরান চলছিল এরই মধ্যে শঙ্করের আবার দ্বিতীয় দফায় জ্বর আবার করোণার জ্বরটর হবে হয়তো! ওরা ঠিক করে এবার আর হাসপাতালে যাবে না কপালে যা থাকে থাক! একজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে অন্যজনকে যেতে হবে কোয়ারান্টাইনে বড় হাঙ্গামা!

ঘরে শঙ্কর শুয়ে থাকে, শিবানী শশ্রুষা করে ওরা অপেক্ষা করে নিশ্চয়ই কেউ আসবেসে বিক্রম হতে পারে, বা হতে পারে মানব কতদিন হয়ে গেল, ওদের ঘরে কেউ আসে না অথচ ভলান্টিয়ার, সমাজসেবী, পাড়ার লোক ওরা কেউ না কেউ - নিঃশব্দে দরজায় খাবার রেখে যায়, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেসও করে না, কেমন আছে!

কয়েকদিনের মধ্যে শঙ্করের থেকে শিবানীও ভাইরাসে ইনফেক্টেড হলো সামান্য জ্বর, আর কাশি দুজন একই বিছানায় শুয়ে থাকে একজন আরেক জনকে সাহায্য করে শুয়ে শুয়ে ওরা কত কিছু ভাবে জ্বরের ঘোরে কত রকম স্বপ্ন দেখে!

শুয়ে শুয়ে আধো ঘুমে শিবানী দেখে বিক্রম নেমে আসছে আকাশ থেকে যখন আকাশ ফেড়ে বিদ্যুতের আলো মাটিতে ঝলকায়, তখন একটা শক্তিমান যুবক নিজেকে বাঁচাবার জন্যে রেল লাইনের স্লিপার ধরে দৌড়ায় গভীর রাত্রে চারনম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য শঙ্কর একদিন নিজের চোখে দেখেছিল বিক্রম ছেলেটা খুব সৎ আর সাহসী মানবের চেহারাটা ঠিক কেমন তা মনে না করতে পারলেও, ওরা জানে ছেলেটা পৃথিবীর সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায় মানবের কব্জীতে পরানো আছে দানবীর রাজা হরিশ্চন্দ্রের পুরাণো বাজুবন্ধ মানব ঘুরে বেড়ায় কলেজ পাড়ায়, রেল স্টেশনে, নদীর পাড়ে, ইট ভাঁটায়, এমন কি পুরুলিয়ার পলাশবনে এই পুরুলিয়াই শিবানী-শঙ্করের বাপ দাদাদের এককালের দেশ ওরা শুনেছে মানব ছেলেটা খুব মিশুকে, পরোপকারী আর ভারী মিস্টি গল্পকথায় শোনা কিংবা কল্পনার পৃথিবীতে এক চিলতে দেখে ফেলাবিক্রমআরমানবএই চরিত্রগুলো ওদের নিঃসঙ্গ চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে শিবানী ও শঙ্কর ভেবেছিল ওদের ছেলে হলে প্রথম জনের নাম দেবে বিক্রম, তারপর যদি আরেকটা ছেলে হয়, তার নাম দেবে মানব মেয়ে হলে তার নাম হবে মানসী কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে ওরা এখনও নিঃসন্তান

এই একমাস ধরে ওরা আশায় আশায় থাকে কেউ না কেউ আসবে, সে বিক্রম হতে পারে, বা হতে পারে মানব দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে ওদের এই আশ্চর্য অপেক্ষা!  

দিন দশেক বাদে বিনা চিকিৎসা, বিনা ওষুধেই ওরা দুজনেই সুস্থ হয়ে ওঠে দরোজা খুলে মাঝে মাঝে বাইরে বেরোয় দেখে ওদের সামনের দেয়ালে তখনো লাগানো পোষ্টারটা - ‘COVID-19, করোণা আক্রান্ত ঘর কেউ যেন একটা অচ্ছুতের স্ট্যাম্প ওদের শরীরে লাগিয়ে গেছে

  সামনের হাইওয়ে ঝেড়ে ফেলেছে তার অতীত দিনের ব্যস্ততা রাস্তায় চলাচল নেই শুধু কিছু কিছু মানুষ পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরছে, সঙ্গে বৌ-বাচ্চা, মাথায় কাঁধে লটবহর ওদের কি পরিযায়ী শ্রমিক বলা যায় শঙ্কর নিজেই একজন কুলি মজুর নিজের জায়গার বা খেপ মিলবার ঠিক ঠিকানা নেই একদিন শুনছিল, টিভিতে বিতর্ক চলছে- পরিযায়ী শ্রমিক নামটা অপমানকর  কে জানে কত দূর দূর জায়গা থেকে লোকগুলো হেঁটে হেঁটে ফিরছে মজুরগুলোর এমনিতে কাজ নেই, রাস্তায় গাড়ীঘোড়া নেই, পয়সা ফুরিয়ে আসছে, পেটে উচকানো ক্ষিধেএমন অবস্থায় হেঁটে হেঁটে ঘর ফেরা ছাড়া আর উপায়ই বা কি?

কিছুদিন আগে কেউ শঙ্করকেও বলেছিল, স্টেশনে স্টেশনে মাল বইছো, নয়ডাতে চলো, ওখানে কাজ মিলবে নয়ডা এখান থেকে কতদূর, ১৩০০ কিলোমিটার হবে হয়তো? ভাগ্যিস শঙ্কর যায় নি গেলে আজকে এমনি করেই পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরতে হতো তার চাইতে ভালো শহরটার বাইপাসের পাশে নিজের ঘরে, এই টিনের ছাউনির নীচে ওরা একরকম বেচে বর্তে আছে

আশে পাশে এমনি আরো কতগুলো ঘর আছে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না এই মহল্লা, হাইওয়ের সামনে আরো কতগুলো ঘর, সেখানেও চলেছে সরীসৃপদের শীতকাল যাপন সবাই ঘরে ঢুকে আছে তবে মানুষ তো আর তেমন সরীসৃপ নয়; তাদের দুবেলা হলে ভালো, না হলে নিদেন পক্ষে একবেলা খাবারের প্রয়োজন সেটাও মহামারীর নামে কোন না কোন ভাবে জুটে যাচ্ছে

ওদেরও দুজনেরই তো দুসরা বার করোণার  অ্যাটাক হয়েছিল! কি বাঁচোয়া!  করোনা টেষ্ট, করোনা কিট বা কোন হাসপাতাল ছাড়াই সব ঠিক হয়ে গেছে! এই লকডাউনের সময় ঘরে বসে শিবানী আর শঙ্করের সময় কাটতে চায় না টিভি দেখে, মোবাইল হাতরায় ওরা কখনো দরজা খুলে বসে থাকে ভাবে, কেউ না কেউ কখনো নিশ্চয়ই দেখা করতে আসবে সে বিক্রম হতে পারে, হতে পারে মানব!

সামনের হাইওয়েতে আজকাল লোকজনের চলাচল আগের থেকে একটু বেড়েছে ঘরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দেয় একটু বেলা বাড়লেই ত্রাণের খাবার প্যাকেট কেউ না ওদের দরোজায় চুপিচুপি ঝুলিয়ে যাবে, কিন্তু ওদের মুখ দেখা যাবে না!

শিবানী গল্প শুনেছিল, ওর বাবার কাছে তখন প্লেগ অসুখের মহামারী সেটাও খুব সংক্রামক রোগ গ্রামের পর গ্রাম মানুষ মরে যাচ্ছে শিবানী গল্প গুনেছে, তখন মানুষেরা রাস্তা খালি করে এমন ভাবে নিজেদেরকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখে নি একজন অন্যজনের সঙ্গে দেখা করতে গেছে মানুষ মানুষের সেবা করে গেছে

দিনের পর দিন কেটে যায় দেশ জুড়ে দুমাস হতে চললো লকডাউনের দাঁতে নখ-কাটার মতো আত্মীয়তাবিহীন নিঃসঙ্গ সময়কে ওরা দাঁতে কাটে তবু অপেক্ষা করে নিশ্চয়ই বিক্রম, নয়তো মানব আসবে, কিংবা পারুল ওদের সঙ্গে দেখা করতে

আস্তানাতে চুপিচুপি নিঃশব্দ খাবার প্যাকেট আসে; কিন্তু দুটো কথা বলা বা হাহুতাশ করার জন্যে ওদের কাছে কেউ আসে না

[ Published ]


 

Comments

Popular posts from this blog

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

কামিনের জন্যে কবিতা

অন্ধকার, টানিয়ে রেখেছি অন্ধকার