সাম্প্রতিক দুঃসময়ের ব্যক্তিগত কড়চা
সাম্প্রতিক
দুঃসময়ের ব্যক্তিগত কড়চা
সমরেন্দ্র
বিশ্বাস
বাড়ির
বারান্দা আর ছাদ থেকে আমরা উপভোগ করছি একদিনের জনতা কার্ফু। দিনটা
ছিল ২২শে মার্চ-২০২০ রোববার। গদ্য
পদ্য তখনো তেলে জলে মিশে দুঃসময়ের চচ্চরি তৈরী হয় নি।
রাস্তায়
কোন জনমুনিষ্যি নেই।
পার্টির ডাকা হরতালেও রাস্তা ঘাট এমন জনশূণ্য থাকে
না। জনগন
সবাই ভয়ে সন্ত্রস্ত – বাইরে বেরোলে, সরকারী কার্ফুর খেলাপ করলে কি জানি কি শাস্তি হবে! এই
জনতা কার্ফুর দিনটায় দেখলাম খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। রাত্তির
বেলা ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বললো, শাখ বাজলো,
ঘণ্টা বাজলো।
উৎসাহী মানুষ জন দেশের মঙ্গল কামনায় থালাবাটি বাজালো। সে এক
মনোমুগ্ধকর দেওয়ালী উৎসব।
কিছু উৎসাহী যুবক রাস্তাতে দাঁড়িয়ে পটাকা – বাজী ফাটালো! জনগন কেন যে এমনটা করছে তার মানে খুঁজে পাওয়া গেল না! তার কিছুদিন আগে থেকেই শুনছি
করোনা নামে কি একটা রোগ পৃথিবীর এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছুঁয়ে
দিলেই কেল্লা ফতে!
২৪শে
মার্চ-২০২০ আমরা টিভি খুলে বসে আছি। রাত
আটটায় দেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। ওই ভাষণের
মোদ্দা কথা, আর চার ঘন্টা পরের থেকেই
, মানে ২৪ তারিখের রাত বারোটা অর্থাৎ ২৫ তারিখের শূন্য সেকেন্ড থেকে
দেশে চালু হচ্ছে সমস্ত দেশ জুড়ে লকডাউন। ট্রেন
গাড়ী ঘোড়া কিছু চলবে না।
দোকানপাট বন্ধ। মানুষ
জন বাইরে বেরোতে পারবে না।
এই লকডাউন শব্দটার সাথে অধিকাংশ মানুষই পরিচিত
ছিলাম না। আমরা
জানি লকডাউন মানে ফ্যাক্টরী বা কলকারখানার লকডাউন। ওমা, এখন দেখছি এ অন্য ধরণের লকডাউন। যা টানা
চলবে ২৫শে মার্চ থেকে ১৪ই এপ্রিল২০২০ পর্যন্ত। সর্বসাকুল্যে
তিন সপ্তাহ মানে একুশদিন! করোনার সংক্রমন বাঁচাতে এ
এক স্মার্ট সিদ্ধান্ত!
মিঞা-বিবি দুজনে মিলে হিসেব করে দেখলাম, ঘরে চালডাল যা আছে
তাতে আমাদের চলে যাবে।
অগত্যা বাইরে বেরোনো নেই। টিভি
খুলে বসে থাকি। পরদিন
সকাল থেকেই টের পাওয়া গেলো হাজারে হাজারে মানুষজন দেশের এপ্রান্তে ওপ্রান্তে আটকে আছে!
আমি
থাকি ছত্তিশগড়ের শিল্প-শহর ভিলাইতে। কার্ফুর আগেই ছেলের কলেজ ছুটি হয়ে গেছে,
সে ঘরে ফিরে এসেছে। অন্যদিকে
আমার মেয়ে-জামাই গুরগাঁওতে গৃহবন্দী। ওখানে
বেড়াতে গিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্যে আটকে পড়েছে আমার মেয়ের শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, তারাও নিজের বাড়ি ফিরতে পারছে না।
ভিলাইতে
রাস্তা ঘাটে লোকজনের ভীড় নেই।
বিশাল রাষ্টায়ত্ব সংস্থা ভিলাই ষ্টীল কারখানা বিশেষ
কানুন অনুসারে বন্ধ হয় নি।
কারখানার লোকজন যথারীতি প্লান্টে যাচ্ছে। কিন্তু
এ অঞ্চলের সমস্ত ছোট ছোট কলকারখানাগুলো, দোকানপাট,
যানবাহন রাতারাতি বন্ধ – যেখানে প্রচুর লোকজন কাজ
করে। ২৫শে
মার্চ থেকে আর কোন যাত্রী ট্রেন ছাড়ে নি। রাস্তায়
বাস, টেম্পু, অটোরিক্সা এসবও
চলছে না।
কয়েকদিনের
মধ্যেই এই হঠাৎ-ঘোষিত লকডাউনের প্রতিক্রিয়া বোঝা
গেল। টিভিতে
দেখলাম ঘরে ফেরার জন্যে হাজার হাজার লোক রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। কাঁধে
লোটাকম্বল। বৌয়ের
কোলে, পুরুষের কাঁধে বাচ্চাকাচ্চা। শিশুরাও
হাঁটছে। জমানো
খাবার ফুরিয়ে গেছে।
কিনে খাবে যে দোকানপাট বন্ধ। অনির্দিষ্ট
রাস্তা, পায়ে হেঁটে ঘরের পথে পা বাড়িয়েছে হাজার হাজার
মানুষ। রোদ্দুর, বৃষ্টির ভ্রুক্ষেপ নেই, আলো-অন্ধকারের
মাপ নেই, পায়ে চপ্পল নেই, পেটে খাবার নেই,
রাতের ফুটপাথ বা গাছের তলাই তাদের আশ্রয়, মাটিই
তাদের বিছানা।
বিশেষতঃ অস্থায়ী বা ঠিকা শ্রমিক- যারা ভিন প্রদেশে বা দূরদূরান্তে কাজ করে, এরা সেই সব
শ্রমজীবি। এদের
কাজ কারবার বন্ধ, হাতে যথেষ্ট টাকা পয়সা নেই,
থাকবার মতো জায়গা নেই। এরই
মধ্যে পুলিশ প্রশাসন লকডাউনের সরকারী বিধি নিষেধ না মানার জন্যে খড়্গহস্ত। পায়ে
হেঁটে দূর-দূরান্ত থেকে যারা ফিরছে,
তারা কেউ কেউ পুলিসের লাঠির ঘা খাচ্ছে, কেই নীল
ডাউন হয়ে হাঁটছে! কাউকে শাস্তি হিসেবে সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে
যেতে বাধ্য করানো হচ্ছে।
এ কোন সময় এসেছে? একে কি দুঃসময় বলবো না?
মানুষের
ইতিহাসে দুঃসময় অনেক এসেছে।
ঝড়-বন্যা,
সুনামি, সাইক্লোন, যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ -এরকম অনেক দুঃসময় মানুষেরা
দেখেছে! কিন্তু করোনা রোগকে কেন্দ্র করে এ আরেক নিদারুণ অবস্থা;
রোগের মারে মৃত্যু তো আছেই, তাছাড়া এই দুঃসময় সাধারণ
মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে রোগ, ক্ষুধা, মৃত্যু।
এতে সবচাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দূর-দূরান্তে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকেরা, কম আয়ের নিম্নবর্গের
মানুষেরা! তড়িঘড়ি করে
যদি প্রধানমন্ত্রী দ্বারা চারঘন্টার মধ্যে লকডাউন ডেকে দেশের সমস্ত চাক্কা বসিয়ে না দেয়া হতো, যদি লোকদের যথেষ্ট পরিমানে সতর্ক করে আরো এক সপ্তাহ সময় দেয়া হতো, তাহলে হয়তো সাধারণ মানুষেরা এতো দুরবস্থায় পড়তো না। অব্যবস্থিত
পরিকল্পনাহীন এই লকডাউন নিরাপত্তার বদলে সাধারণ মানুষকে ছুঁড়ে দিলো দিল এক অসহায় দুঃসময়ের
মুখোমুখি।
সারাদিন
ঘরেই থাকি। টিভিতে খবর শুনি। উঠে
আসে করোনায় মৃত্যুর খবর – ইটালী, আমেরিকা, ফ্রান্স। ভারতবর্ষেও
সংক্রমণ শুরু হয়েছে – প্রথম দিকে শুনি সবচাইতে বেশী
রোগ ছড়িয়েছে মহারাষ্ট্রে। এসময়ের সংস্কৃতি নাকেমুখে একটুকরো কাপড় বা মাস্ক, আর স্যানিটাইজারের বিজ্ঞাপন!
এরপর
দ্বিতীয় দফা লক ডাউন, ১৫ই এপ্রিল থেকে ৩রা মে পর্যন্ত। এ সময়ে
ছত্তিশগড় বা আমাদের অঞ্চলে এ রোগের হার খুব নগন্য – অথচ এখানেও করোনার নামে এদিক সেদিকে স্বাস্থ্য পরিসেবা বেহাল হয়ে পড়ে আছে। এখানকার
মধ্যবলয়- পত্রিকার সম্পাদক শিবব্রত দেওয়ানজী’দা অসুস্থ।
তাকে এক-দেড় দিন
আইসিইউ, তারপরে আরো এক-দেড় দিন জেনারেল ওয়ার্ডে রেখে হাসপাতাল থেকে ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। কারণ
দেখানো হলো হাসপাতালে করোনা।
উনি কয়েক মাস বাদে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে ঘরে
ভুগে ভুগেই মারা গেলেন – তবে করোনাতে নয়,
অন্যান্য রোগে।
দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার জন্যে তার হাসপাতালে ভর্তি
থাকাটা জরুরী ছিল!
এমন
দুঃসময়েরই একটা দিন।
মুম্বাইএর কাছে বান্দ্রা রেল স্টেশন থেকে ট্রেন
ছাড়বে। কয়েক
হাজার লোক স্টেশনে জড় হয়েছে।
কিন্তু খবরটা নিতান্তই গুজব ছিল। স্টেশনে
জমা হওয়া উত্তেজিত জনতা ফালতু পুলিশের লাঠিগুঁতো খেয়ে এদিক ওদিক ফিরে গেল। কিছু
লোক খালি ট্রাকে, কিছু লোক মিক্সার মেশিনের ড্রামে
গুটিসুটি মেরে রওয়না দিল।
আম-জনতার হিসেবটা
সোজা, ভিন-প্রদেশে রোজগারবিহীন থাকলে না
খেয়ে মরতে হবে, রাস্তায় অনাহারে দুর্ঘটনায় মরলেও মরতে হবে!
ঘরে ফিরে যাওয়াটাই তাদের একান্ত ইচ্ছে। এমনি
ভাবে পরিবহনবিহীন অবস্থায় ঘরে ফিরতে গিয়ে কত লোক যে রোগে, দুর্ঘটনায় বা অনাহারে মরেছে , তার পরিসংখ্যান আমার জানা
নেই। তবে
লরী উলটে বা ধাক্কা খেয়ে কিছু ঘর-ফেরতা লোক মারা
গেছে, - একথা আমরা খবর কাগজে দেখেছি।
আমার
অঞ্চলের স্থানীয় যারা গৃহভৃত্য বা টুকিটাকি কাজ করে, তারা দ্বিতীয় লকডাউনের পর্বে লুকিয়ে চুরিয়ে লোকের বাড়ী কাজে যাচ্ছে, বাসনকোসন মাঝছে, গৃহভৃত্যের কাজ করছে। বাগানের মালী রূপলাল পুলিশের চোখ এড়িয়ে আমার বাড়ী কাজ করতে আর মাসোহারা নিতে হাজির। ওদের মহল্লা জুনয়ানীতে শুনলাম মিউনিসিপ্যালিটি থেকে দুপুরের জন্যে একবেলার খাবার দিয়ে যাচ্ছে। যার সঞ্চয় আছে সে রাতে খাচ্ছে; যার নেই তাকে রাতে উপাস দিতে হচ্ছে। ওখানে আটকে পড়েছে নতুন তৈরী হচ্ছে যেসব বিল্ডিং তার রাজমিস্ত্রী ও মজদুরেরা – ওরা বিহার বা অন্য কোন দূর অঞ্চল থেকে এসেছে। আমি রূপলালের হাতে ওদের খরচের জন্যে কিছু টাকা পাঠালাম। এটা শুনে ভালো লাগলো রূপলাল আর জুনয়ানী গ্রামের মানুষজন নিজেরা কম খেয়েও ওইসব আটকে পড়া মজদুরদের জন্যে সম্ভবমতো খাবার বা টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য দিচ্ছে। কে বলেছে, নিম্নবর্গের মানুষদের মানবিকতা মরে যায়?
এর পরে
শুরু হলো তৃতীয় দফার লকডাউন – ৪ইমে থেকে ১৭ই
মে পর্যন্ত।
লকডাউনের কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল হয়েছে। প্রথম
লকডাউনের সময় আমার পাশের বাড়ির দুরন্ত ছেলেটি রাস্তায় পুলিশের হাতে ধরা পরেছিল, তাকে স্কুটারটি বাজেয়াপ্ত হবার হাত থেকে বাঁচাতে পুলিশের লোকটিকে এক হাজার
টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল।
কিন্তু তৃতীয় লকডাউনের সময় কিছুটা অলিখিত ছাড় আছে! সেই ছেলেটি নাকে মাস্ক বেঁধে পকেটে স্যানিটাইজারের বোতল রেখে
স্কুটারে করে এখন এদিক
ওদিক দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সীমিত সময়ের জন্যে দোকান খুলছে। সব্জী
ও দুধের দোকান অল্প সময়ের জন্যে খোলে। যে সমস্ত
লোক কাজ হারিয়েছে তারা সকাল সন্ধ্যায় সাইকেল, ভ্যান
রিক্সা বা অটোরিক্সায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে- ‘সব্জী
চাই, সব্জী!’
দেশেরে চারদিক থেকে করোনা জনিত মৃত্যুর খবর আসছেই!
এই তৃতীয়
লকডাউনের মধ্যেই ৭ই মে২০২০, বিশাখাপট্টনম
জেলার একটা করাখানায় গ্যাস লিকেজ। লোকজন
ঘরের মধ্যে, নয়তো রাস্তায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে
আছে। ভাগ্যিস
লিক করা স্টিরিন গ্যাস ভূপালের মিক গ্যাসের মতো অতো প্রাণঘাতী নয়! খবরে শুনলাম, ৮ই মে মহারাস্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ স্টেশনের কাছে রেল লাইনে কাটা পড়লো ১৬ জন পরিযায়ী
শ্রমিক। ট্রেন
বন্ধ, ওরা ঘরে ফেরার তাগাদায় রেললাইন ধরে হাঁটছিল। রাতে
ওরা ট্রেন লাইনের উপরেই শুয়ে বিশ্রাম করছিল। ওরা
কি জানতো, ঘাতকের মতো একটা বিশেষ রেলগাড়ী
ঘুমন্ত রাতে ওদেরই দিকে ছুটে আসছে! রেল লাইনের উপর ছিন্নভিন্ন
হয়ে পড়েছিল ওদের মৃত শরীর, সাংসারিক জিনিষপত্তর, জামা-কাপড়। ছড়িয়ে
ছিটিয়ে পড়ে ছিল কিছু গোল গোল রুটি! করোনা মৃত্যুর পাশাপাশি এই সব মৃত্যুগুলো
আমাদের দুঃসময়টাকে আরো কঠিন করে তুলেছে!
এরপর
চতুর্থ পর্বের লকডাউন ১৮ই মে থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত। এই পর্বেই
১৯-২০মে নাগাদ তেড়ে এলো সুপার-সাইক্লোন ‘আম্ফান’, ঘূর্ণিঝড়,
জলোচ্ছ্বাস আর সাথে তুমুল বৃষ্টি। ভারতবর্ষের
ইতিহাসে এমন ধ্বংসাত্মক ঘটনা বহু বছর ঘটে নি। অবশ্য ছত্তিশগড়ে এর প্রাদুর্ভাব তেমন কিছু ছিল না। আমরা
ঘরে বসে টিভিতে দেখলাম পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চল ও কিছু জেলা দারুণ ভাবে ক্ষতি
গ্রস্থ। করোনা-আক্রান্ত কোলকাতা এই আম্ফানের প্রকোপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে নি। একেই বলে মরার পরে খাঁড়ার ঘা! দুঃসময়ের শেষ কবে হবে?
সকালে
বিকেলের মর্ণিং আর ইভিনিং-ওয়াক করতে আমি ঘরের ছাদে হাটি। দেখি
আকাশটা কি পরিষ্কার।
আমার ঘর থেকে ভিলাই স্টীল প্লান্টের কারখানা প্রায়
১২ কিলোমিটার দূরে।
আগে বায়ুদূষণের জন্যে বাড়ীর ছাত থেকে প্লান্টটা
ভালো দেখা যেতো না।
এখন কারখানাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে! গাড়ী চলাচল কম, অনেক ছোট কলকারখানা বন্ধ। বায়ুমন্ডল
খুব সাফ। সবাইকে
দেখাই , ওই দেখো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্টীল প্লান্টের
শেড আর চিমনীগুলো! আকাশটা আগের থেকে স্বচ্ছ্ব, তাই রাতের নক্ষত্রমন্ডল পরিস্কার দেখা যায়। এসময়ে চুল-দাড়ি ভয়ানক বেড়ে গেছে। নিস্কৃতির জন্যে বন্ধ-সেলুনের রামকুমারকে ডেকে আনি ঘরের উঠোনে।
এর পরে
৫ম পর্বের লকডাউন, ১লা জুন থেকে ৩০শে জুন। কিছু
বিমান ও দূর পাল্লার কয়েকটা ট্রেন তখন চলছে। যারা
এদিক ওদিক আটকে ছিল, যাদের পয়সার সামর্থ্য আছে,
তারা ধীরে ধীরে ঘরে ফিরছে। আরো
অনেকের মতো ৫ইজুন আমার আত্মীয় দে-মশাই গুরগাঁও
থেকে দিল্লী হয়ে ঘরে ফিরলো, ভিলাইতে ফিরে তারপর তাদের বিধিবদ্ধ
কোয়ারেন্টাইনের ১৪দিন কাটানো!
মাঝে
মাঝে ফোন আসে। দূরবর্তী
বন্ধুরা ফোন করে। আগে
তিন-চার মিনিটেই কথা শেষ হয়ে যেতো, কারণ দিনভর সবার ব্যস্ততা। এখন
সবাই ঘরে বসে। সবার
হাতে অঢেল সময়ে। তাই
বন্ধু-বান্ধব কারোর ফোন এলে আধাঘন্টাতেও কথা ফুরোয়
না।
এইসময়ে অন-লাইন নানা অনুষ্ঠান, কনফারেন্স দাপিয়ে চলছে। ল্যাপটপ বা মোবাইল খুলে পছন্দমতো যে কোন একটা অনুষ্ঠান বা আলোচনার দর্শক হয়ে ঢুকে পড়ি। এবং সইকথা, দূরের খেয়া – তে লাইভ কবিতা পড়ি, ফেসবুকে লাইক পাই, আনন্দে থাকি। সত্যি বলতে কি, এই দুঃসময়টা সবার জন্যে সমানভাবে ভয়াবহ নয়!
এই পর্বটা নতুন করে আলাপ-পরিচয়েরও সময়! একদিন ফোন পেলাম সন্দীপন বেরার; ও জানালো ২৮শে জুন-২০২০ ‘ছকভাঙা কবিতা কনফারেন্স’ হবে; তাতে আমিও আছি। ওদিন কবিতা নিয়ে নানা আলোচনা হলো। আমরা কেউ কাউকে চোখে দেখি নি , অথচ ২৮শে জুন ভার্চুয়াল মঞ্চ তোলপাড় হলো আলোচনা সভায় – সেদিন ছত্তিশগড়ের আমি সবিশেষ পরিচিত হলাম শ্যামল শীল(ঝাড়খন্ড), মনোতোষ আচার্য (প.ব.), দীপককুমার মাহাতো(ওড়িশা), দীপ্সি দে(ত্রিপুরা), শম্পা ঘোষ (মহারাষ্ট্র), বিপ্লব গোস্বামী(আসাম) আর সন্দীপন বেরা(প.ব.)- সবার সাথে! যদিও একদিকে মৃত্যু ও হাসপাতালে দৌড়ঝাপ চলছে, তবুও এমন সার্বিক অবসরে আমাদের পারস্পরিক আলাপ পরিচয়ের সুযোগ অনেকটাই থেকে যায়!
এই দিনগুলোতে
ঘরে বসে নতুন নতুন বই পড়ি।
বড় গল্প লেখার চেষ্টা করি – কারণ হাতে অনেক সময়।
অথচ ভালো কিছু লেখা হয় না। কারণটা
বলেছিল আমার এক সাহিত্যিক বন্ধু – ভালো লিখতে
গেলে বাইরে বেরোনোটা জরুরী, আড্ডা মারাটাও জরুরী। নইলে
লকডাউনের বন্দীশালায় পেটে গুঁতো মারলেও ভালো লেখা বেরোবে না।
ঘরে বসে বসে আর কতদিন লকডাউনকে সহ্য
করা যায়। আমিও স্কুটার বা চার-চাক্কা নিয়ে এদিক ওদিকে বেরিয়ে পড়ি। কারো
বাড়ীতে বসে নাক-মুখ মুখোশে ঢেকে কয়েকজন মিলে মিশে
আড্ডা মারি।
লকডাউনের মধ্যেই বন্ধু শুভায়ুর সাথে শিবনাথ নদীর
কিনারায় যাই। দেখি
জেলে ভাইদের মাছধরার কাজ থেমে নেই – পেট চালাতে
হলে রোজ তাদের নদীতে নামতেই হবে! ঘরে ফিরে নদীকে নিয়ে গল্প লিখি।
এদিকে
ছত্তিশগড়, আমার আশ পাশের অঞ্চল গুলোতে করোনার
প্রাদুর্ভাব বাড়তেই থাকে।
কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, কবে ভ্যাকসিন বেরোবে? উত্তরটা আমারো জানা নেই,
তাই ছোট্ট করে বলি – ‘কে জানে?’
আমার
মেয়ে - জামাতা চাকুরীসূত্রে গুরগাঁও থাকে। ওখানে
করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।
রান্না বা বাসনপত্র মাজা ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজের
লোককে ওদের হাউজিং কমপ্লেক্সে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কাজের
লোক নেই। ওয়ার্ক-ফ্রম হোম করা, সেই সঙ্গে ঘরের কাজ করা ইত্যাদিতে বিরক্ত
হয়ে ওরাও দেখি ২১শে জুন ভিলাইতে এসে হাজির! অন্ততঃ কোয়ারান্টাইন
পর্ব কাটানোর পরে পারিবারিক সাহচর্য তো পাওয়া যাবে! আমরাও খুব খুশী!
জুনের
প্রথম সপ্তাহ থেকে লকডাউন ঢিলা হচ্ছিলো। সেই
সুযোগে এদিক ওদিক ভিন প্রদেশে আটকে থাকা মানুষজন নিজের নিজের ঘরে ফিরতে লাগলো। পুলিশ
নয়তো মিউনিস্যিপ্যালেটির লোকেরা ঘর-ফেরৎ মানষজনের
দরজায় দরজায় ‘কোভিড-১৯’ আর ‘কোয়ারাণ্টাইন’-এর নোটিশ লাগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের
সমাজ বা বেশীর ভাগ লোকজনই এই সব ‘কোয়ারাণ্টাইন’-ঘর গুলো এড়িয়ে চলে।
হোক না তারা যতই পরিচিত। যেন
এই পৃথিবীর কোনে কোনে অস্পৃশ্যতা রোগ আবার নতুন করে মাথা চারা দিয়ে উঠেছে! মানুষ মানুষকে এড়িয়ে চলছে- এর চাইতেও বড় দুঃসময় আর কি
হতে পারে?
চার
দিক থেকে নানা মৃত্যু সংবাদ ভেসে আসে। কিছু
করোনার মৃত্যু, কিছু বার্ধক্যজনিত মৃত্যু। এখানেই
আমাদের কয়েকজন প্রিয় পরিচিত তরতাজা মানুষ করোনাতে প্রাণ হারালো ।
এর মধ্যে আমার একপ্রস্ত জ্বর হলো। নিজেই প্যারাসিটেমল আর ওষুধ খেলাম। করোনা-টেষ্ট করানোর হিম্মত হয় নি। চারদিকে
হাসপাতাল আর টেষ্টের যে অব্যবস্থা চলছে, তারই কারণে। ভাগ্যি ভালো, তিনদিনের মাথায় আমার জ্বর সেরে গেল!
এর পরবর্তী
লকডাউনগুলো চললো ৬ই আগষ্ট পর্যন্ত। আগের
মতো আটোসাটো নয়। অনেকটা
শিথিল! অথচ
করোনার সংক্রমণ বেড়েই চলছিল।
এই কারণে আবার নতুন করে খুব কড়া লকডাউন - ২৪ থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ! আমার পাড়ার রাস্তায়
তখন পুলিশ নিয়ম করে রাউন্ড দিচ্ছে!
এমনি
করেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলাম।
জানিনা
এই দুঃসময় কবে কাটবে? কবে আমরা করোনা-মুক্ত হবো, কবে এর প্রতিষেধক আর নিরাময়ের ওষুধপত্র বেরোবে
!
তবে
নানা দুঃখজনক অবস্থার মধ্যে এই দুঃসময়ের একটাই পাওনা – আমার পরিবারে স্বামী, স্ত্রী, ভিন
প্রদেশে থাকা আমার পুত্র, কন্যা-জামাতা
সবাই লকডাউনের কারণে একই বাড়ীতে একসঙ্গে আছি; নইলে সবাই নিজের
নিজের কাজে ব্যস্ত - ছুটি অমিল।
এই করোনাকালের
মধ্যে পরিবারগুলো একত্রিত হয়ে ক্যলেন্ডারের পাতা গুনছে – কবে এই দুঃসময় থেকে রেহাই পাওয়া যাবে? কবে আবার আমাদের
জীবনযাত্রা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে? এমনি ভাবেই পেরিয়ে এলাম
এবারের দুর্গা পূজা – না, তেমন কোথাও যাই
নি। ঘরে
বসে বই পড়েছি। মন
আকুপাকু করছে কবে আবার কোলকাতা বেড়াতে যাবো? এবারের
কোলকাতা বইমেলা হবে কি হবে না? জানি না, এই দুঃসময় আমাদের আরো কতদূর টেনে নিয়ে যাবে!
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার প্রকৃতি ও পরিবেশকে দারুণভাবে
অবহেলা করছি! তার জন্যে প্রকৃতি আমাদের উপর প্রতিশোধ তুলছে না
তো ?
Date
– 28.10.2020. R-2
প্রকাশিত – কবিতা পাঠচক্র-৩
/ ১৫ই নভেম্বর-২০২০
Comments
Post a Comment