গ্রামের জন্যে কয়েকটি ছত্র
গ্রামের জন্যে কয়েকটি
ছত্র
সমরেন্দ্র
বিশ্বাস
১
আয়াসী হত্যার ষড়যন্ত্র , বিকট স্বপ্নে
ঘুম ভাঙ্গে । মিটিং হয়ে গেছে ; বাজেয়াপ্ত হবে জমি । আজ ভোরে একটাও কাক ডাকে নি ।
একটাও ধানের শীষ হাওয়াতে দোলে নি । গ্রেপ্তারির পরোয়ানা নিয়ে এগিয়ে আসে সংবিধান ও
শিল্প ; শিল্পের রঙ লাল, হলুদ বা সবুজ । শিল্পের রঙ – পুঁজির পয়সার মতোই ধূসর - গোলক ধাঁধার মতো
পেঁচানো । সকাল থেকেই গ্রাম জুড়ে নেমেছে ধুম জ্বর , উপবাস !
২
“ গ্রাম দিয়ে শহরকে ঘেরো ” – কথাগুলো
মুছে গেছে ।দেয়ালে দেয়ালে কারা যেন বর্ণময় লিখে গেছে বিকেলের ব্রাশে – “ শহর দিয়ে
গ্রামকে ঘিরুন ” ।
৩
গ্রাম আর শহরের মধ্যে যে ভাঁজ ছিলো ,
সেটা খুলে দিতেই উড়ে গেল যতো প্রজাপতি । বর্শা কিম্বা বর্ষার মতো আকাশ থেকে নেমে
এলো চকচকে মুদ্রা । সেই ধাতবখন্ডগুলো কুড়োনোর লোভে হোল মারামারি আর স্টাম্পেড ।
পয়সা কুঁড়াতে যারা মারা গেলো , যারা বিকলাঙ্গ হলো তারা এই ভাঁজখোলা গ্রামেরই লোক।
৪
ধান দিয়ে লোক কেনা যায় না । টাকা দিয়ে
লোক কেনা যায় । তাই টাকারা উড়তে উড়তে লুকিয়ে পড়ল শহরে , আর ধানের নাম মিশে গেল
গ্রামের কাঁখে – যেমন জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি ।
তবুও ধান খাওয়া কবুতরের পাখায় এখন
টাকার রঙ !
৫
আমাদের গ্রামের মাঝ দিয়ে শের শাহ আজও
রাস্তা বানাচ্ছে । তার নৈশকালীন রাজধানী উঠে আসবে প্রত্যন্ত গ্রামে , নদীর হাওয়ায়
, সবুজের আড়ালে । সেখানে গড়ে উঠবে সুরম্য হারেম । আমাদের মেয়েরা সেখানে
ক্রীতদাসী । রাস্তায় টোলট্যাক্স দিয়ে যে কেউ সেখানে আসতে
পারো । শের শাহ আজও পালন করে চলেছেন তার রাজধর্ম !
৬
গ্রামের মানুষটির শরীরে মাংস নেই ,
হাড়গুলো শুকনো ; তবুও সেখানে টানটান হাড় আর অনাবিল সবুজতা আছে । এই মানুষটি যখন রাজধানীর
পথে পথে হাঁটবে, তার দেহ থেকে মিলিয়ে যাবে সবুজতা । ধীরে ধীরে সে হয়ে
উঠবে পকেটয়ালা ধূসর এক প্রাণহীন শরীর – যার ভেতরে গোঁজা থাকবে প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু হাড় !
৭
গ্রামের উন্নতি হলে সকাল দশটায় খোঁপায়
ফুল গুঁজে শহর থেকে দিদিমনিরা আসবে রিক্সায়
। স্কুলের পাশে বাগিচায় বাগিচায় ফুটবে ফুল । গ্রাম থেকে
মেয়েটি বিকেলের শহরে যাবে চামেলীর ফুল নিয়ে । ফুলগুলোকে বাসি হওয়া , নষ্ট
হওয়া থেকে আটকানোর কোন কেমিক্যাল কিম্বা কর্পোরেট-প্লান আছে কি ?
৮
শহর থেকে ভেসে আসবে সুগন্ধি হাওয়ার বিজ্ঞাপন
আর ছটফটে সিনেমার জ্যান্ত সব গান । গ্রামের হাওয়ায় তারা ভাসবে । ঘরে ঘরে,
বাজারে কিম্বা মেলায় মেলায় তারা ঘুরবে , একদল
জ্যান্ত পকেটমার যেন হাওয়ায় ভাসছে আর হাসছে ।এসব দেখে গ্রামের লোকেরা নাচবে , হাসবে , কাঁদবে ;
আমাদের গ্রামসমাজ তাতেই খুশী।
৯
যে আনন্দকে আমি গ্রামের হাওয়ায় ছড়িয়ে
দিলাম , মেঘের ভেলায় তারা গান হয়ে ভাসবে ।
তারপর গানগুলো প্লাটফর্মে নেমে আসবে, ট্রেনের
সওয়ারী হয়ে পৌঁছে যাবে শহরে । তারপর কি এক মেটামরফোসিসে আবিল গানগুলো
ভিক্ষা চাইতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে রাজপথে । ততদিনে আনন্দময়ীরা কোমল শরীরে পরে নিয়েছে দুঃখময়ী শাড়ী আর অবিশ্বাসের
ব্লাউজ । তুমি চাইলেও কোন গান আর ফেরত
পাবে না ! সমস্ত আনন্দরাই তখন ধূসর ।
১০
সবুজ শাড়ী পরে সে থালা সাজিয়ে বসে থাকে
, দুব্বা আর চন্দনে । অফুরন্ত ডালি নিয়ে নিজের ভাইয়ের মতো সে
শহরকে ভাইফোঁটায় ডাকে ! কিন্তু শহর বড় হিংস্র, সে ঝাপিয়ে পড়ে , কামড়ে
ধরে গ্রামকে । তার বোন বড় অবাধ্য মেয়ে , শহর জেনে গেছে সহোদরাকে শোধরানোর
গূঢ় তত্বকথা – তৈরী তার মাস্টার প্লান ।
১১
গ্রামের জন্যে ধান ক্ষেত চাই না ।
এখানে তৈরী হোক কারখানা । কারখানার চিমনীতে বেজে উঠুক জয় শঙ্খ ! কে নিশ্চিত বলতে পারে , কবে ওই সাইরেন আর শঙ্খের
শব্দে আমার ব্যাগে উঠে আসবে চাল ? চিমনীর থেকে ভাত নয় , আজও আমার থালায় ঝরে পড়ে
অদৃষ্টের ছাই !
১২
গ্রাম ভেঙ্গে শহর বানানো মানে পৃথিবীর
বুকে অসংখ্য ঘা আর ব্যান্ডেজের টুকরো । যা সেরে উঠতে বহুকাল
লাগবে । আদৌ সারবে কিনা , নিশ্চিত নই । পাখীর ঠোঁটে উড়িয়ে দিলাম গ্রামের
জন্যে লেখা এই কয়েকটি ছত্র । এতে সই করবে গাছের পাতা আর জলের মাছ । তারপর পাখী
চিঠি নিয়ে উড়ে যাবে সমস্ত মনীষার কাছে – নীরো নয় , যেখানে আইনস্টাইন আজও বসে
বেহালা বাজায় ।
# # # # # # [ গ্রন্থ
– অনন্ত জলশব্দে আমি ]
Comments
Post a Comment