গ্রামের জন্যে কয়েকটি ছত্র

 

গ্রামের জন্যে কয়েকটি ছত্র

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

আয়াসী হত্যার ষড়যন্ত্র , বিকট স্বপ্নে ঘুম ভাঙ্গে । মিটিং হয়ে গেছে ; বাজেয়াপ্ত হবে জমি । আজ ভোরে একটাও কাক ডাকে নি । একটাও ধানের শীষ হাওয়াতে দোলে নি । গ্রেপ্তারির পরোয়ানা নিয়ে এগিয়ে আসে সংবিধান ও শিল্প ; শিল্পের রঙ লাল, হলুদ বা সবুজ । শিল্পের রঙ   – পুঁজির পয়সার মতোই ধূসর - গোলক ধাঁধার মতো পেঁচানো । সকাল থেকেই গ্রাম জুড়ে নেমেছে ধুম জ্বর , উপবাস !

 


“ গ্রাম দিয়ে শহরকে ঘেরো ” – কথাগুলো মুছে গেছে ।দেয়ালে দেয়ালে কারা যেন বর্ণময় লিখে গেছে বিকেলের ব্রাশে – “ শহর দিয়ে গ্রামকে ঘিরুন ” ।

 


গ্রাম আর শহরের মধ্যে যে ভাঁজ ছিলো , সেটা খুলে দিতেই উড়ে গেল যতো প্রজাপতি । বর্শা কিম্বা বর্ষার মতো আকাশ থেকে নেমে এলো চকচকে মুদ্রা । সেই ধাতবখন্ডগুলো কুড়োনোর লোভে হোল মারামারি আর স্টাম্পেড । পয়সা কুঁড়াতে যারা মারা গেলো , যারা বিকলাঙ্গ হলো তারা এই ভাঁজখোলা গ্রামেরই লোক।

 

 


ধান দিয়ে লোক কেনা যায় না । টাকা দিয়ে লোক কেনা যায় । তাই টাকারা উড়তে উড়তে লুকিয়ে পড়ল শহরে , আর ধানের নাম মিশে গেল গ্রামের কাঁখে – যেমন জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি ।  তবুও ধান খাওয়া কবুতরের পাখায় এখন  টাকার রঙ !

 

 


আমাদের গ্রামের মাঝ দিয়ে শের শাহ আজও রাস্তা বানাচ্ছে । তার নৈশকালীন রাজধানী উঠে আসবে প্রত্যন্ত গ্রামে , নদীর হাওয়ায় , সবুজের আড়ালে । সেখানে গড়ে উঠবে সুরম্য হারেম আমাদের মেয়েরা সেখানে ক্রীতদাসীরাস্তায় টোলট্যাক্স দিয়ে যে কেউ সেখানে আসতে পারোশের শাহ আজও পালন করে চলেছেন তার রাজধর্ম !

 


গ্রামের মানুষটির শরীরে মাংস নেই , হাড়গুলো শুকনো ; তবুও সেখানে টানটান হাড় আর অনাবিল সবুজতা আছে । এই মানুষটি যখন রাজধানীর পথে পথে হাঁটবে, তার দেহ থেকে মিলিয়ে যাবে সবুজতাধীরে ধীরে সে হয়ে উঠবে পকেটয়ালা ধূসর এক  প্রাণহীন  শরীর – যার ভেতরে গোঁজা  থাকবে প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু হাড় !

 


গ্রামের উন্নতি হলে সকাল দশটায় খোঁপায় ফুল গুঁজে শহর থেকে দিদিমনিরা আসবে রিক্সায়  । স্কুলের পাশে বাগিচায় বাগিচায় ফুটবে ফুল ।  গ্রাম থেকে  মেয়েটি বিকেলের শহরে যাবে চামেলীর ফুল নিয়ে । ফুলগুলোকে বাসি হওয়া , নষ্ট হওয়া থেকে আটকানোর কোন কেমিক্যাল কিম্বা কর্পোরেট-প্লান আছে কি ?

 


শহর থেকে ভেসে আসবে সুগন্ধি হাওয়ার বিজ্ঞাপন আর ছটফটে সিনেমার জ্যান্ত সব গান । গ্রামের হাওয়ায় তারা ভাসবে ঘরে ঘরে, বাজারে কিম্বা মেলায় মেলায় তারা ঘুরবে , একদল  জ্যান্ত  পকেটমার  যেন হাওয়ায় ভাসছে আর হাসছে ।এসব দেখে  গ্রামের লোকেরা নাচবে , হাসবে , কাঁদবে ; আমাদের গ্রামসমাজ তাতেই খুশী।

 

 

 


যে আনন্দকে আমি গ্রামের হাওয়ায় ছড়িয়ে দিলাম , মেঘের ভেলায় তারা  গান হয়ে ভাসবে । তারপর গানগুলো প্লাটফর্মে নেমে আসবে, ট্রেনের  সওয়ারী হয়ে পৌঁছে যাবে শহরে । তারপর কি এক মেটামরফোসিসে আবিল গানগুলো ভিক্ষা চাইতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে রাজপথে । ততদিনে আনন্দময়ীরা কোমল শরীরে  পরে নিয়েছে দুঃখময়ী শাড়ী আর অবিশ্বাসের ব্লাউজ  । তুমি চাইলেও কোন গান আর ফেরত পাবে না ! সমস্ত আনন্দরাই তখন ধূসর ।

 


১০

সবুজ শাড়ী পরে সে থালা সাজিয়ে বসে থাকে , দুব্বা আর চন্দনেঅফুরন্ত ডালি নিয়ে নিজের ভাইয়ের মতো সে শহরকে   ভাইফোঁটায় ডাকে !  কিন্তু শহর বড় হিংস্র, সে ঝাপিয়ে পড়ে , কামড়ে ধরে গ্রামকে । তার বোন বড় অবাধ্য মেয়ে , শহর জেনে গেছে সহোদরাকে  শোধরানোর  গূঢ় তত্বকথা – তৈরী তার মাস্টার প্লান ।

 


১১

গ্রামের জন্যে ধান ক্ষেত চাই না । এখানে তৈরী হোক কারখানা । কারখানার চিমনীতে বেজে উঠুক জয় শঙ্খ ! কে  নিশ্চিত বলতে পারে , কবে ওই সাইরেন আর শঙ্খের শব্দে আমার ব্যাগে উঠে আসবে চাল ? চিমনীর থেকে ভাত নয় , আজও আমার থালায় ঝরে পড়ে অদৃষ্টের ছাই ! 

 


১২

গ্রাম ভেঙ্গে শহর বানানো মানে পৃথিবীর বুকে অসংখ্য ঘা আর ব্যান্ডেজের টুকরোযা সেরে উঠতে বহুকাল লাগবে ।  আদৌ সারবে কিনা , নিশ্চিত নই । পাখীর ঠোঁটে উড়িয়ে দিলাম গ্রামের জন্যে লেখা এই কয়েকটি ছত্র । এতে সই করবে গাছের পাতা আর জলের মাছ । তারপর পাখী চিঠি নিয়ে উড়ে যাবে সমস্ত মনীষার কাছে – নীরো নয় , যেখানে আইনস্টাইন আজও বসে বেহালা বাজায়

 

# # # # # # [ গ্রন্থঅনন্ত জলশব্দে আমি ]

Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

দয়াবতী, যাও, ফিরে যাও!