অনাত্মীয় শহরকথা
অনাত্মীয় শহরকথা
#
সমরেন্দ্র
বিশ্বাস
#
ভালো
না লাগা শহরের মধ্যে অবাঞ্ছিত জঙ্গলের রাস্তা শুরু হতেই আমি গতিমান শকট থেকে নেমে
পড়ি। পায়ের নীচে উত্তপ্ত পাথর, নক্ষত্রের চোখ উধাও। ফ্লাটবাড়িতে কাঁচের পিরিচে রাখা কসমেটিক;
শ্বেতপাথর চেরাই করা লাস্যময়ী মহিলারা জলের বদলে হাতে তুলে দেয় বিতর্কিত বর্ণময়
পানীয়। তাদের বাষ্পীভূত সম্ভাষণ উদ্দেশ্যহীন লটকে থাকে দেয়ালের ফার্নিচারে। একদিন
তোমার চোখের থেকে ছুটে এসেছিল যে প্রজাপতি, ইলেকট্রিক তারে আটকে যায় তার পরাগরেণু
গন্ধ, ছিঁড়ে যায় উড়ান ডানার দিগন্ত-রঙ্গীনবিস্তার। হারিয়ে যায় সাদাপর্দায়
স্কুলমাঠের সম্মিলিত বায়স্কোপের রিলছেঁড়া সময়। এখন ডিজিটাল
ছায়াছবিতে স্নেহহীন সময়, অসহিষ্ণু জীবন, বলিউডি হিংসা। শহরের এই
অনাত্মীয়তায় আমি হাফিয়ে উঠি!
বাস্তবের
এই বসবাসের শহর, তার অবরুদ্ধতা আমাকে দাঁড়া করিয়ে রাখে এক অথর্ব শ্মশাণভূমির
সামনে। ড্রেনের ফাটলে চুইয়ে পড়ে পার্থিব সময়। শহরের ক্লান্তির বিপরীতে বেজে ওঠে আম
আঁটির ভেঁপু, আঁকা হয় উন্মুক্ত দিগন্তের ডানা মেলা রামধনু। নদীর
ভাঙ্গনে ডুবে যাওয়া আমার গ্রামটাকে জালে বেঁধে দুরন্ত ডিঙ্গিতে তুলে আনছে যেসব
পরাণকথা, তাদের শব্দে শব্দে কান রেখে আমি বেরিয়ে পড়ি মাটি আর মোরামের রাস্তায়।
ভালো লাগে যখন শহরশব্দের ওপারে জেগে ওঠে মচমচে পাতার সারিবদ্ধ হেমন্ত কথা, ভালো
লাগে যখন শ্রাবণের হাওয়ায় উড়ে আসে সবুজ জন্মদাগ।
শকুণের
সম্ভ্রান্ত চোখ নিয়ে আকাশে উড়তে থাকে গোয়েন্দা ক্যামেরা। অনবরত বেজে
ওঠে অ্যাম্বুলেন্সের আর্তস্বর, পাগলা ঘন্টা। আমার মতো এক অনাত্মীয় শহরবাসীর ভয়ে
রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে দমকল। রাত্রি নামতে থাকলে চোখের থেকে অ্যান্টেনার লালবাতিকে
সরিয়ে ফেলি, সৌরমন্ডলের চুঁইয়ে পড়া ম্লান
রশ্মিধারাকে তুলে রাখি ফতুয়ার পকেটে। শহরের জঙ্গল আর হাই ম্যনসনের ভীড় থেকে পালিয়ে
কোন এক নিষিদ্ধ বৃক্ষের কোটরে আমি আত্মগোপন করি। বোরখায় ভরা অন্ধকারের পাতায় পাতায়
লিখে রাখি উপড়ে যাওয়া চারাগাছের বিবর্ণ দুঃখ ; লিখি স্নেহহীন সময় আর বিকৃত জীবনের
অনাত্মীয় শহরকথা!
[ Published – ‘মউল’ / নববর্ষ-২০১৯ ]
Comments
Post a Comment