একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া রঞ্জন রায়
সমরেন্দ্র বিশ্বাসের
নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘অনন্ত জলশব্দে আমি’
একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া
রঞ্জন রায়
প্রস্তাবনা
কবিতা
কেন পড়ব বা আমি কবিতা কেন পড়ি? ভাল লাগে বলে । সব কবিতাই ভাল লাগে? যে কোন কবিতা? না,
তা কেন হবে। সব কবিতা বুঝতে পারি না যে । বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের বাঙলা
কবিতা।
অ , সেই রবীন্দ্রনাথ
জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, সমর সেন, সুভাষ মুখুজ্জে হয়ে দম নেয়া । সেই থোড় বড়ি খাড়া আর
খাড়া বড়ি থোড়। তাহলে আজকালকার কবিতা তুমি বুঝতে পার না , তবু পড়। ঠিক তা নয় , আসলে
কবিতা তো ঠিক বুঝবার জন্যে নয় , বাজবার জন্যে । যে কবির কাব্য বা কোন একটি কবিতা আমাকে
নাড়া দেয় , আমার মনে একটা অনুরণন তোলে সেটাই আমার কবিতা। তাকে মানে বইয়ের মত বা অভিধানের
মত গোদা ভাবে বুঝতে হবে কেন ? কবির শব্দচয়ন বা বাকপ্রতিমা আমার মনে যে প্রতিধ্বনি তুলবে
সেটাই আমার কাব্যপাঠ।
এ তো ভারি জ্বালা! কবিতাকে কি ‘অ্যাম্বিগুয়াস’ বা ‘দেখা -না -দেখায় -মেশা’ হতেই হবে?
আমার ব্যক্তিগত মত
হল সেটাই কবিতার শক্তি।
এটা কি কথা হল? দুর্বোধ্যতাই
কবিতার শক্তি? যার কবিতা যত দুর্বোধ্য সে তত শক্তিশালী কবি?
ধেৎ , ‘অ্যাম্বিগুয়াস’
আর দুর্বোধ্য হওয়া কি এক হল? বলতে চাইছি যে
কবিতা যত বিভিন্ন মনে অনুরণন তুলবে , যত বেশি পাঠক তার নিজের মত করে ইন্টারপ্রিটেশন
করতে পারবে সে কবিতা তত বেশি সার্থক।
কবিতা পড়ে পাঠকের দল
যে যার মতন মানে করে নেবে? একটা কবিতার এত গুলো পাঠ? এ তো রামায়ণ-মহাভারতকেও ছাড়িয়ে
যাবে ?
যেতেই পারে ।
তাহলে এই n সংখ্যক
পাঠের সঙ্গে যদি কবির উদ্দিষ্ট পাঠ, মানে যা ভেবে উনি লিখেছেন তা যদি না মেলে?
তাহলে কবির পাঠটি
হবে n+1 তম পাঠ।
এত সব এলোমেলো ভাবনা
যে মাথায় চর্কিপাক খাচ্ছিল তার কারণ আমার সদ্যসমাপ্ত একটি কবিতার বই--- “অনন্ত জলশব্দে আমি”।ইস্পাতনগরী ভিলাইয়ের কবি সমরেন্দ্র বিশ্বাসের এই
কাব্যগ্রন্থটি চার বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে। এটি তাঁর ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। আমার সুযোগ
হয়েছিল এঁর “হাওয়া
শিকার” (২০০৫)
এবং “
হাফিজের ফেয়ারওয়েল”
(২০১৫) পড়বার।
আমার পাঠ-প্রতিক্রিয়াঃ
প্রাথমিক
আলোচ্য বইটিতে দুটি ভাগ—প্রথমটি নামকবিতার অন্তর্গত অন্ততঃ নব্বইটি
কবিতার সংগ্রহ যাদের রচনাকাল ২০০৫ এর পরে। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে’দৃষ্টিপাত, ম্লানছায়া’ শীর্ষকের অন্তর্গতঃ এমন ছাপ্পান্নটি কবিতা যা
আগে তাঁর কোন-না-কোন কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। আমার আলোচনা প্রথমভাগের কবিতাবলীর
মধ্যেই সীমিত রাখব।
কবিতাগুলি পড়ার পর আমি যেন সমরেন্দ্রের
ব্যক্তিস্বভাবকেই অনুভব করি । এক সুভদ্র, নম্র, মিতভাষী বাঙালি যিনি কথা বলেন নিচু
গলায় আন্তরিকতা মেখে, কখনই উচ্চকিত ন’ন। তাঁর কবিতা ভিড়ের মাঝে মঞ্চ থেকে পড়ার নয় , বরং কাব্যভাষা একা
একা একজন পাঠকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বিনিময়।
কাঁচরাপাড়া থেকে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর ইস্পাতনগরীতে কয়েকদশকের আধিকারিক পদমর্যাদায় চাকরি
সমরেন্দ্রকে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করেছে, জীবনকে দেখার রোমান্টিক পূর্বাগ্রহের
কাঁচামালকে বাস্তবের স্টিল মেল্টিং শপে গলিয়ে তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী আলোয় দেখতে শিখিয়েছে।
কিন্তু এই বিশাল অথচ যান্ত্রিক কর্মযজ্ঞ সমরেন্দ্রের কবিমনকে পিষে ফেলতে পারেনি। ইস্পাতনগরীর
গতানুগতিক জীবনেও ফেলে আসা যৌবনের স্বপ্নদেখা দিনগুলি হটাৎ হটাৎ তাঁর অবচেতনে হানা
দেয় । বিপন্ন কবি ভাবেন এ কোথায় এলাম!
“
একদিন জলস্রোতে গান ছিল ,
জনস্রোতে গতি ছিল
আজকাল নাকি কিছু নেই
“ ( আমরা কেউ তত ভালো নেই )।
এই অবস্থায় কবিকে কে
রক্ষা করবে? স্মৃতি। এই উপলব্ধি থেকে কবির আকুল প্রার্থনাঃ
“
স্মৃতি তুমি জেগে ওঠো,
স্মৃতি তুমি ছুটিদিদি হয়ে
আমাকে জাগাও”। (স্মৃতিনগরের স্মৃতি)
কিন্তু কি সেই স্মৃতি?
সেকি সত্তরের দশকের শেষের ‘আন্দোলিত যাদবপুর’?
“
রাজপথে বৃষ্টি ঝরে
রাজপথ ভেসে যায় ক্ষোভে,
শ্লোগানে শ্লোগানে ধাক্কা
খেয়ে
লাঠি বেঁকে হয়ে যায়
বেহালার ছড়”।
খেয়াল করুন শেষ পংক্তিটি,--
লাঠি বেঁকে হয়ে যায় বেহালার ছড়!
এই একটি তুলির নিপুণ
টান কবিতাটিকে অসংখ্য স্লোগানধর্মী কবিতার ভিড় থেকে আলাদা করে দাঁড় করিয়েছে। এখানেই
সমরেন্দ্রের মুনশিয়ানা।
কিছু কবিতায় রয়েছে
কয়েকদশক আগের বামপন্থী কবিতার ঐতিহ্যবহনের ছাপ, তা হোক। প্রত্যেক মানুষ তার নিজস্ব
সময়েই বাঁচে। সমরেন্দ্র নির্বিকল্প মুখে সেই দায়ভার বহন করেছেন, কিন্তু সেখানেও স্বাতন্ত্র্যে
উজ্জ্বল।
“বোবা
যুদ্ধ”
কবিতাটির কথা বিশেষ করে বলতে চাইছি।
“এখানে
বল্লম নিয়ে কেউ কোনদিন মিছিল করেনি,
এখানে অনেকদিন চেঁচিয়ে কোন কথা বলেনি,
এখানে কেউ কোন শ্লোগান
দিচ্ছে না ,
এখানে কেউ কারওকে অ্যারেস্ট
করছে না------“।
আমরা থমকে যাই। তারপরে
শেষ চারটি পঙক্তি আমাদের চেতনায় আছড়ে পড়ে এক চিত্রকল্প গড়ে তোলে।
“
পরনে বন্দীর পোষাক,
শরীরে গারদের গন্ধ,
প্ল্যাকার্ডে লেখা তাদের
কথাগুলো স্থির,
‘সমস্ত
রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি চাই “।
আবার “আমাকে সশস্ত্র ভাবো” কবিতা যেন আজকের সময়ের ইঙ্গিতঃ
“আমাকে
তালাশ করো,
আমাকে সন্দেহ করো, শুধু
জীবনের চলন্ত এক্সপ্রেসে
কিছু অসহায় প্রশ্নচিহ্ন
আমার টিকিটে—
হিজিবিজি এই অপরাধ”।
এই মিতবাক নম্রকন্ঠ
কবি বর্তমান অবস্থায় চুপ করে না থেকে প্রশ্ন তোলেনঃ
“কেন
আমাকেই ছাঁটো?
কেন আমাকেই এতো ভয়?”
অভিজ্ঞতায় কবিকে সংশয়
দীর্ণ করেছে। সভ্যতার সামনে এগিয়ে চলার গালগল্পে তাঁকে আর ভোলানো যাচ্ছে না । মানুষের
লোভ প্রকৃতিকে রিক্ত করেছে। তাই ভবিতব্য হলঃ
“ভৌতিক
কাহিনীর অবসানে
মহাশ্মশানের গন্ধ মেখে
উঠে আসে মৃত পরিবেশ।
ব্রাণ্ডেড পোষাকপরা সভ্যতার
মৃত মানুষেরা
কাঁধে কাঁধে বয়ে নিয়ে
চলে নিজেদেরই লাশ,
অন্তিম শ্মশান অগ্নিহীন,
নদী হয়ে আছে কাঠ ।“
আর একটি কবিতা “শান্তিরক্ষার দপ্তর থেকে”। এটির অন্তর্লীন ব্যঙ্গ, এর আপাত তিক্ততা এক আশ্চর্য
সংযমে বাঁধা হয়েছে।
“একটা
ব্যবস্থার মধ্যে
যুদ্ধটা আগে থেকেই সাজানো
ছিল,
ঠিক ছিল কোথায় কতগুলো
ট্যাঙ্কার থাকবে
কোন কোন মানুষগুলো বিদ্ধ
হবে
কোন কোন গোলন্দাজ বিমান
উড়ে এসে ধ্বংস করবে
কার অট্টালিকা”।
কবিতাটি এক দশক আগে
লেখা, কিন্তু আজ এটি পড়ার পর যদি পাঠকের চোখে সাম্প্রতিক দিল্লি দাঙ্গার ছবিগুলো ভেসে
ওঠে তাহলে দোষ দেব কাকে? কবিতার পুনর্নির্মাণের সম্ভাবনাকে।
ছন্দের
পক্ষপাতিত্ব
এতসব কবিতা পাঠের পর
যদি কারও মনে হয় যে কবি বোধহয় পদ্যছন্দে কাঁচা; হয়তো অন্ত্যমিল তাঁর তেমন আসে না ,
তাই হয়তো বেশিরভাগ কবিতাই গদ্যশৈলীর? তাহলে তাঁকে বলব এই দুটো কবিতা দেখতে।
প্রথমটিতে ধরা পড়েছে
পাঁচমারীর ঝর্ণা দেখার মুগ্ধতা।
“ঝর্ণা
তুমি মাঝ দুপুরে, ছেনালি নয় , ভিজে ছোঁয়ায় যদি আমায় ডাকো
এদিক ওদিক জলের ছিটে,
তোমার সাথে দেখব আমি রামধনুকের সাঁকো।
দিনানুদিন বিষের হুল
ভুলেই যাবো, ফিরবো নাকো রুটি রুজির দেশে
চলৎশক্তি আমার খুব, ঝরণা
তুমি আমায় ছুঁয়ো ঘাঘরা নাচা বেশে”।(পাঁচমারী বী-ফলস)
ছন্দটিতে বেজে উঠছে পাথরে পাথরে ধাক্কা খেতে
খেতে জলধারার নেমে আসার নূপুরনিক্কণ।
ট্রেনে করে রোজ চালপাচারকারী
নারীদের নির্মম জীবনের ছবি লেখক এঁকেছেন বাঙলা ছড়ার সাবেকী ছন্দে।
“
চারটে শিশু সামনে পিছে, প্রশ্নবিহীন কাল,
পাচার হচ্ছে জীবনযাত্রা,
পাচার হচ্ছে চাল।
চারটে শিশু সঙ্গী
মায়ের, পঞ্চমটি কই ?
বেজন্মাটার ছোট্ট শরীর
দিচ্ছে পেটে মই।
চাল পাচারে ভাত এসেছে,
ভাত ফুরোলে কি ?
সোনাগাছির কূপীর আলো,
ইস্টিশনের ঝি।“
(ক্ষিধে)
বাঙলা ছড়ার ছন্দে আরও একটি ছোট কবিতা ‘তোমার জন্যে ‘।
“রাত্রে
যখন ডাকছে কেউ—দিচ্ছে
হাওয়ায় শীষ,
কী করেছি, কী করেছি,
নিজের হাতেই ধরেছি
যে তীব্রতম বিষ।
বিষ ধরেছি---বিষ ধরেছি?
লোকের তাতে কি,
বিষের জাড়ে রাত্রি
পাগল স্বপ্ন দেখেছি”।
পাতা ওল্টাই, থমকে
যাই একজায়গায়—“কবিজন্ম”। কৌতুহল বাড়ে, কবি কি নিজেকে নিয়ে কিছু বলবেন?
কিন্তু এ’কবিতা
তো অন্য আরও বড় কিন্তু সমসাময়িক প্রেক্ষিতের কথা বলছে।
“স্বর্গের
স্টেশনের মুখে কতগুলো পোস্টার
দেয়াল জুড়ে সাঁটা। তাতে কবিদের মুখ,
বুকের কাছে অপরাধীদের
মতো তারা আঁকড়ে রেখেছে
কিছু পরিশ্রান্ত
কবিতার লাইন ও প্ল্যাকার্ড”। ( এখানে কবিতার অভিধা হিসেবে ‘পরিশ্রান্ত’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়; আমি এগিয়ে চলি।)
“ফটোগুলোর
উপরে লেখা—‘সাবধান!
নীচের মানুষগুলো
ড্রাগ—ক্রিমিনাল’।
মন্তব্যে লেখা –‘গান গেয়ে , কলম ও
কাগজের গন্ধ শুঁকিয়ে,
চায়ের মধ্যে
কিছু মাদক দৃষ্টিশক্তি
মিশিয়ে এরা আপনার
মূল্যবান সবকিছু কেড়ে
নিতে পারে”।
‘আফিম
পাহাড়’
কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব ছন্দ এবং রূপকল্পের নির্বাচনে চোখে পড়ে , কিন্তু এগোলেই
বুঝতে পারি এই প্রভাব নিতান্ত আপতিক। গোটা কবিতাটি তুলে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না
।
“
এইখানে যতসব ঘড়ি থেমে যায়,
এইখানে পৃথিবীর কত শত স্নেহলতা রায়
পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে
শুয়ে থাকে—মুখে
মরা রোদ;
কফিন পাথর ঘিরে কাঁদে
মমি, কাঁপে মৃত বোধ।
এইখানে মরদ জেনানা সারি
সারি পাড়ে পাত,
জঙ্গলের ভয় গায়ে মেখে
উঠে আসে মধ্যরাত
জাড় নয় , মাংগে তারা
রুটি; গায় অসম্ভব গান---
ভাত গম আফিমেতে ভাল থাক
সবার সন্তান”।
শেষ পংক্তির বিষণ্ণতা
কি করে কাটাই? কবি যে ইস্পাত কারখানার চারপাশের জীবনকে আধিকারিকের পদমর্যাদার উচ্চতা ঝেড়ে ফেলে পাশে
গিয়ে হাঁটু গেড়ে খুঁটিয়ে দেখছেন।
“ঘামে
ঘামে আর কত নিজেকে ভেজাবি?
ক্ষারের কর্কশ বাকলে
আর কত মেজে যাবে দেহখানি তোর?
যমুনাবতী,
তোর মুখে কালো ছোপ,
এটা কোন পাপ নয় –
পার্থিব শরীর নিয়ে আগুন
আগুন খেলিস এই ভাদ্র মাসে।
------------
--------
তেত্রিশের ছুঁই- ছুঁই
গালে ঠিকাদার আবডালে চুমু চেয়েছিলো,
সেদিন
বিদ্যুৎ রেখায় তুই ডেকেছিলি মেঘ”। ( কামিনের জন্যে কবিতা)
রোম্যান্টিক কবিতারা
আমি
বাঙলা ছন্দের ‘অক্ষরবৃত্ত—মাত্রাবৃত্ত—স্বরবৃত্ত’ এসব কচকচি বা কবিতাগুলোর পঙক্তি ধরে পর্বভাগ
করে কাটাছেঁড়ায় উৎসাহী নই , তাতে কাব্যের ম্যাজিক উপে যায় বলেই আমার বিশ্বাস। তবে অক্ষরবৃত্তই কবির প্রিয় বলে মনে হয়।
যেমন
ধরুন, “রানিকে
চিনি না আমি’
কবিতাটি।
“ রানিকে চিনি না আমি আজও ততোখানি ,
ধাবমান
ঘোড়াদের রানি যতো চেনে।
রানি
কি স্বপ্নের দেশে রাজার প্রহরী
দেশহীন
রাজ্যহীন আমি শুধু ভয়ে ভয়ে মরি’।
(কীসের
এত ভয় কবির? ভালবাসা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হবার? নাকি অন্য কোন কুয়াশা?)
‘আমি যদি মাটি হই, রানি তবে সৌর-হাহাকার
কাপড়ের
ভাঁজ থেকে ঝুরু ঝুরু লোহা ঝরে—সেও চমৎকার
শরীরে
মায়াবী গন্ধ কান্না ভরা দগ্ধ জোছনার’।
(
এবার কি মনে হচ্ছে না কবির ঘরানাটি জীবনানন্দীয়? শরীর এসেছে যেন কুয়াশার মতো, দেখা
যাক ।)
‘ আমি যদি ছই হই, রানি তবে নদীভাসা গ্রাম
শীতকালে
খেজুরের রস, খুব লাভা, ঝরেছিলো ঘাম।
আমার
রাত্রির বুক টলোমলো, তার জোনাকির আলো—
রানিকে
চিনি না আমি, তবু বলি , রানিকেই লেগেছিলো ভালো’।
এই
রানি আমাদের সবার জীবনেই আছে ; খানিকটা চেনা খানিক অচেনা।
বা,
‘বিচ্ছেদ’ নামের এই ছোট কবিতাটি, এত বিষ, দহনে এত
জ্বালা!
‘কচি রোদ্দুরের বুকে ফলিডল ছড়িয়ে তুমি হেঁটে গেলে।
অপেক্ষার সবুজ ঘাসে আমি বসে রইলাম। আমাকে গ্রাস করলো সায়নাইড-রোদ্দুর, আমার বেবশ শরীরে
বাজতে থাকলো স্মৃতিময় তোমার মূর্ছনা’।
(
আমায় চমকে দিল ‘সায়নাইড-রোদ্দুর’ চিত্রকল্পটি।)
শেষ
লাইনটির কান্না যেন জোয়ারের ঢেউ হয়ে তীরে আছড়ে পড়লোঃ
“ ও হলুদ বসন্তের মেয়ে, তোলপাড় সমুদ্র মন্থনের শেষে
আমায় কেন তুলে দিলে হলাহল? তীব্র বিষ”। এই শেষ দুটো শব্দে তৈরি পংক্তিটি আমার কানে গ্যর- জরুরি হয়ে বাজছে।
দীর্ঘ কবিতাগুলো
এই
সংকলনে রয়েছে কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা; যেমন ‘গ্রামের জন্যে কয়েকটি ছত্র’(১২টি স্তবক), ‘স্বাধীনতা তুমি’(১২টি স্তবক) , ‘ প্রযুক্তি যাপন’(১২টি বড়সড় স্তবক), ‘দেশহীনতার মানচিত্র’ ( ২০টি স্তবক) এবং ‘চাঁদ চর্চা, চর্যার চাঁদ’(১২টি স্তবক)। স্থানাভাবে এই কবিতাগুলো নিয়ে চর্চা
করা সম্ভব না হলেও চেষ্টা করছি কিছু উদাহরণ তুলে এদের সৌন্দর্যের কিছুটা আন্দাজ দিতে
।
প্রথমে
‘দেশহীনতার মানচিত্র’।
‘পরিযায়ী পাখিদের চোখে দেশের সীমানা নেই ।
আমার
মানুষ চোখ দুটোকে খুলে
স্বপ্ন
তাতে বসিয়েছিল পরিযায়ী পাখিদের চোখ’।
ফলটা
কবির পক্ষে ভাল হয়নি।
“ আর কিছুক্ষণের মধ্যে মানুষের মাথার খুলিটা
ঊড়ে
যাবে কি যাবেনা জানি না,
যতক্ষণ
প্রিয় মুন্ডুটা এই গ্রহের মাটিতে খসে না পড়ে
আমি
একটা দেশহীনতার মানচিত্র এঁকে ফেলতে চাই,
যে
মানচিত্রে সমস্ত সমুদ্রের রঙ হবে পূর্ণিমার চাঁদ
যে
মানচিত্রে সমস্ত দেশের রঙ হবে সবুজ শস্য
আর
মানুষের রঙ হবে প্রাণবন্ত হাওয়া”।
বা,
‘চাঁদ চর্চা, চর্যার চাঁদ’
থেকেঃ
“চাঁদ তুমি কি জানো ছেলেরা কলংক ভালোবাসে।
নগ্নতা
নিয়ে কখন তুমি জল ছেড়ে উঠে আসবে
আর
ঠিক তখনই আমি রক্তমাংসে লিখে ফেলবো একটি কবিতা’।
এবার
দেখুন ‘প্রযুক্তি
যাপন’
কবিতাটির কিছু চিত্রকল্পঃ
“কারখানার মেশিনেরা ঠপ হলে পূর্ণিমার ডানা কাটা
পড়ে , লগ্ন কেঁদে যায় ।
সুন্দর
চাঁদনী রাত ফ্যাক্টরির ভেতরে খুন হলে
লোডশেডিং
অন্ধকার জেনারেটরের সাথে সঙ্গম পাতায়”।
অথবা,
“ মেশিনের মেয়ে বন্ধু নেই ,
পাল্লা
দেবার জন্যে আছে যমজ ভাইয়েরা
আর
আছে বাবা কিংবা কর্পোরেট জ্যাঠা,
মেশিনেরা
প্যারেডে শিখেছে ইউনিফর্ম পরা ,
শিখেছে
লোহার-চপ্পলে একঘেয়ে শব্দ তোলা”।
বেলাশেষের গানঃ
বইয়ের
প্রথম কবিতা “কিছু দৃষ্টি যেতে যেতে” এবং শেষ কবিতা ‘অনন্ত জলশব্দে আমি’ সবর্ত্রই ছড়িয়ে আছে মৃত্যুচেতনা; হাহাকার নয়,
বরং এক শান্ত সমাহিত অনুভব। আদ্দেক জীবন পেরিয়ে এসে কবি যেন বুঝতে পারছেন কোন
মডেল, কোন ইডিওলজি বা মতাদর্শই চলমান জীবনকে বাঁধতে পারে না, স্থির আলোকবর্তিকা হয়ে
পথ দেখাতে পারে না । কিন্তু সভ্যতার গতিপথে সবারই অবদান আছে , নিজস্ব ভূমিকা আছে। সেটা
পালন করাই আসল জীবনপযাপন। খানিকটা বৌদ্ধদর্শনের ছোঁয়া পাই এই পর্বের কবিতাগুলোয়।
তাই
প্রথম কবিতায় উনি বলেনঃ
“ বাকি দৃষ্টি তুলে দিও নৈরঞ্জনা নদীতীরে বসে থাকা
মৌন ভিক্ষুদের,
যদি
তারা শ্রমণের পথে পথে ফসল ফলায়, সামগান গায়”।
তারপর
শুনি এক অমোঘ উচ্চারণঃ
‘তারপরে তুমি ক্লান্ত যীশু সর্বস্বান্ত চলে যেও
যেদিকে দুচোখ চায়’।
কিন্তু
জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ কবি লেখেন তাঁর ফিরে পাওয়া বিশ্বাস এবং আস্থার কথা ঃ
“চাবি ছিল,
চাবি
আছে আজও
অনন্ত
গুহায়’।
( চাবি আছে অনন্ত গুহায়)
আমরাও
অনেক যন্ত্রণা দ্বিধা দ্বন্দ্বের শেষে কবির মত বিশ্বাস করতে চাইঃ
“সমস্ত জীবন জুড়ে রক্ত আর ঘাম
ঝরে
ঝরে যায়,
অবিরাম
সন্ধানের মেধাময় আবিল মায়ায়।
চাবি
ছিল ,
চাবি
আছে আজও অলৌকিক অনন্ত গুহায়”।
Comments
Post a Comment