একটা উলঙ্গ সকাল
গল্প
একটা
উলঙ্গ সকাল
সমরেন্দ্র
বিশ্বাস
তখনো ভালো করে ভোর হয়
নি। পাখিরা ঘর ছেড়ে আবছা আলোর
পৃথিবীতে পাক খায় নি। শহরের
বাড়িগুলো অন্ধকারে ল্যাপটানো ছবির মতো। দূর
রাস্তায় ফুটপাথে এই মাত্রই মাতালটা পাশ ফিরে শুলো। অন্ধকার মাতৃগর্ভে আগামী দিনটা
প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাকে
পৃথিবীর মাটিতে আছড়ে পড়তেই হবে, এমন একটা জেহাদ। রাত্রির শেষ প্রহর। তখনই এখানে জুটে গেছে আল্লার
করুণাধন্য জীবগুলো।
একটা নয়, দুটো নয়, দল বেঁধে তিন তিনটে কঙ্কালসার কুকুর জড়ো হয়েছে
ইট-ঘেরা ডাস্টবিনটার কাছে। ওগুলো ছেলেটার দিকে এক একবার
তেড়ে আসছে। একটু
ভয় পেয়ে ছেলেটা পেছিয়ে আসছে। একটা
শুকনো গাছের ডাল দিয়ে সে তাড়া দিচ্ছে কুকুরগুলোকে। কুকুরগুলো ভয়ে দূরে সরে গিয়ে
ঘেউ ঘেউ করছে।
কিন্তু অতটুকুন ছেলে আর
কতক্ষণ পাল্লা দেবে তিন তিনটে কুকুরের সঙ্গে। অতএব, দেশী সহাবস্থানের নীতিতে তাকেও আসতেই হলো। কুত্তা, তোরাও থাক, আমিও থাকি, কেন মিছিমিছি
ঝগড়াঝাটি! কিন্তু অপোগন্ডো কুকুরগুলো কি আর এতসব বোঝে। সুযোগ পেলেই ব্যাটারা মুখ হাঁ
করে এগিয়ে আসছিল ছেলেটার দিকে।
রাস্তার পাশে স্তুপীকৃত
পাতা ঘেটে ঘেটে লুচি, পাঁপড়, আলু,
মাছের টুকরো যা পাচ্ছে তাই তাড়াতাড়ি প্লাস্টিকের ঠোঙ্গায় ভরছে। ওমা, একটা গোটা সাদা গোল্লা! টুপ করে গালে পোরে ছেলেটা;
ভীষণ মিষ্টি – মুখে নিয়ে বেশ মোলায়েম করে চিবোতে
থাকে। গোটা
রসগোল্লাটাকে কখন যে তার ক্ষুধার্ত পেট চুম্বকের মতো চো করে টেনে নিয়ে যায়, তা সে টেরও পায় না।
গতকাল ছেলেটা অনেক রাত
অব্দি বসেছিল ওই প্যান্ডাল বাড়ির গেটটার সামনে, উল্টো ফুটপাথে। এখন
ভোরের নিষ্প্রভ আলোয় স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে জায়গাটা। মচ্ছব বাড়ির গেটটা সুন্দর করে
সাজানো। ঐ বাড়ির রঙ্গীন টুনি বাল্বগুলো
পান্ডুর চোখে আলো বিকোচ্ছে। তার
আলোগুলো এখন ক্ষয়ে যাওয়া অন্ধকারের কারসাজিতে ম্লান।
অনেক রাত অব্দি বসে থেকে
থেকে ছেলেটার ঘুম পেয়ে গেছিল। সে
একা নয়,
আরো অনেকে ওই বাড়ির গেটটার সামনে বসে ছিল। সবাইকে সে চেনে না। ওদের মধ্যে ভোটকা ছিল, ময়না ছিল। কিন্তু
টুপি পোষাক পরা ওই উৎসব বাড়ির পাহারাদার দুটো মাঝে মাঝেই এমন জোরে জোরে তাড়া করেছিল
ওদের দলটাকে! বেচারা হাঁটুর ছড়ে যাওয়া ক্ষতে এখন হাত বোলাতে
লাগলো। বিগত
রাতের কথা মনে করে এই মুহূর্তে ক্রোধে ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো –
‘পুঙগীর পুত!’ সামনে জড়ো হওয়া কুকুরগুলো সমানেই
ঘেউ ঘেউ করছে।
কালকে রাতের ক্ষত পা’টা টানতে টানতে ছেলেটা আস্তানায় ফিরে গেছিল। সারা রাত ঘুম হয় নি। খাবারের সুযোগ ফেলে আসার পর খিদে
পেটে ঘুমোতে পারে কার বাপের সাধ্যি। রাত
পোহানোর আগেই ছেলেটা চলে এসেছে এখানে।
কুকুরগুলো ভীষণ জ্বালাচ্ছে! ছেলেটা আবার হ্যাট্ হ্যাট্ করে আওয়াজ করলো। এমন বদমাস কুকুরগুলো, পেছোয় তো হটে না। গায়ের উপর লাফিয়ে পড়তে চায়।
এরই মধ্যে শীর্ণ চেহারার একটা বাচ্চা মেয়ে। কোথা থেকে পা টিপ টিপ করে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘হেই ছেলেডা! মোরে নিতে দিবি না?’ পেছন থেকে মেয়েটার গলা শুনে ছেলেটা হঠাৎ থমকে ওঠে!
পেছনে ফিরে অবিশ্বাসের চোখে তাকায়। এই ভোর সকালে এ আবার কোন দাবীদার এলো রে! বিরক্তি মেশানো সুরে ছেলেটা গম্ভীর হয়ে বলে – ‘না, নিবি না কিন্তু!’
এই পরিত্যক্ত উচ্ছিষ্ট আর স্তূপীকৃত এঠোকাঁটা ভরা শালপাতার থালার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটি যেন আজকের রাজা কিং সালোমন! তার চার পাশে জমায়েত হওয়া তিন তিনটে রাস্তার কুকুর আর একটা শীর্ণকায় মেয়ে – সবাই তার দরবারে অনুগ্রহ প্রার্থী।
মেয়েটার গলার স্বর করুণ। মিনতি ভরা আওয়াজ। ও বলে – ‘দে না নিতে, তুই তো অনেকগুলান পাইছিস। মুই বেশী নিমু না – দেহিস।’
ছেলেটা তাকায় মেয়েটার দিকে – তারপর নিজের
প্রায় ভর্তি হওয়া প্লাস্টিকের থলেটা একবার দেখে নেয়। এর ফাঁকে কুকুরগুলো আবার নিঃশব্দে পাতা চাটতে শুরু করেছে। ছেলেটা হাকে – ‘হ্যাট- হ্যাট।’ পিছিয়ে আসে কুকুর তিনটে।
ছেলেটার মাথায় হঠাৎ একটা আইডিয়া আসে। বলে, - ‘এই মাইয়াডা। এট্টা কাম কর।’ সত্যিই তিনটে কুত্তা ওকে নাজেহাল করে ছাড়ছে।
‘শোন মাইয়া। তুই তাড়াতাড়ি কইরা
তোর থইল্যাডারে ভরতে লাগ দেহি। আমি কুত্তাগুলানরে খেদাই, তার পরে কিন্তুন তুই যা পাবি তার থেইক্যা মোরে আদ্দেক দিতে হইবো।’
যেই বলা সেই কাজ। মেয়েটা হাতড়াতে থাকে ডাস্টবিনের ধারে পড়ে থাকা এঁটোকাটা, পরিত্যক্ত থালাগুলো! খুঁজে খুঁজে তার ব্যাগে তুলতে থাকে যা পায় তাই। মাছ মাংসের কাঁটা, কামড়ানো লুচি, আদ্ধেক খাওয়া চপ, অবশিষ্ট ভাত – কোন কিছুই বাদ যায় না। মেয়েটার পাশেই ছেলেটা। শুকনো
গাছের ডাল দিয়ে শাসন করছে হাড় জিরজিরে তিনটে চতুস্পদকে। কুকুরগুলোও কম যায় না, খেঁকিয়ে তেড়ে আসে। ওগুলোই বা এত সহজে কেন মেনে নেবে এই দশ-বারো বছরের ছেলেটার শাসন? কুত্তাগুলো
সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করে চেঁচায় আর মাঝে
মাঝে তেড়ে আসে।
ও মা! এগুলির ঘর কোথায়? আরো দু’দুটো কুকুর এসে জোটে ওদের দলে। পাঁচটা কুকুর মিলে একসাথে তাড়া করে ছেলেটা আর মেয়েটাকে। ওগুলোও নিজস্ব জন্মভূমিতে বেঁচে থাকার অধিকার চায়।
পাঁচটা কুকুরের রণমূর্তি একসঙ্গে! একটা কুকুর মেয়েটার পায়ে নখের আঁচড় বসিয়ে দেয়। ভয়ে মেয়েটা জড়িয়ে ধরে ছেলেটাকে। না! এবার রণে ভঙ্গ দিতে হয়। ছেলেটা বলে – ‘চ যাই, আর লাগবো না। অনেক গুলান হইয়্যা গেছে -।’
ছেলেটা পায়ে করে একরাশ এঁটো পাতা জড়িয়ে মাঝ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে। কি জানি কিসের উল্লাস লেগেছে ওর মনে। তারপর হাঁটা লাগায়। বড় রাস্তা থেকে ওরা একটা গলির মুখে বাঁক নেয়। সেখানে দেয়ালে একটা সাইনবোর্ড লটকানো! তাতে লেখা – ‘এই শহরটা আপনারই। শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখুন।’ সাইনবোর্ডে কি লেখা? তা ওরা পড়তে পারে না।
ভোরের জন-বিরল গফুর শা লেন ধরে ওরা হাঁটতে থাকে। পেছনে পড়ে থাকে একটা উৎসব বাড়ির ম্লান আলো, পরিত্যক্ত ডাস্টবিন। আর পড়ে থাকে রাস্তাটা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এঁটো পাতা
আর আবর্জনা। তারই মধ্যে পাঁচ পাঁচটা কুকুরের
খাদ্য অন্বেষণ।
গফুর শা লেনের ছোট বড় বাড়িগুলো ভোরের নির্জনতায় নির্জন, কিছুটা দাম্ভিক! ওরা দুই বালক বালিকা এগিয়ে চলে, সঙ্গে কিছু সঞ্চিত খাবার – যা দিয়ে আরো কিছু সময় এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকা যায়।
মেয়েটা জিজ্ঞেস করে, ‘এই তোর নাম কি রে?’
ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, উত্তর দেয় – ‘ছোডো পোলা।’
‘ওমা, তুই মায়ের ছোডো ছেইল্যা বুঝি!’ ফিক করে হেসে দেয় মেয়েটা। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় এই আট বছরের বালিকার মুখ। বলে, ‘জানিস, মোর না মা নাই!’
‘মইইরা গেছে বুঝি?’ ছেলেটা জিজ্ঞেস করে।
‘কি জানি!’ মেয়েটা আস্তে আস্তে বলে – ‘আগে মুই মায়ের লগেই থাকতাম। মোর ঠাম্মা কইছে মোর বাপটা কলেরায় মইইরা গ্যাছে – তহন মুই এত্তোটুহুন ছিলাম।’ মেয়েটার স্মৃতিতে আবছা আবছা অনেক কিছু ভেসে আসে – ‘তারপর মোগো বস্তীতে এট্টা মানুষ আইলো। একদিন
আমার মা ওই মানুষটার লগে চইল্যা গ্যালো। আর ফেরৎ আইলো না। এহন মুই ঠাম্মার লগেই থাহি।’
ছেলেটা কোন কথা বলে না। মেয়েটা জিজ্ঞাসা করে, ‘তুই কোথায় থাহিস?’
ছেলেটা দূরে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে, ‘ওই উধারে, ইস্টিশানে।’
কিছুটা দূরে হেঁটে যাওয়ার পরে মেয়েটা একবার নিজের প্লাস্টিকের ব্যাগটার দিকে তাকায়। বলে ‘হেই ছোডো পোলা, খিদা পাইছে!’
ওরা দুজনে আরো একটা এদো গলিতে ঢুকে পড়ে। এ পাড়াটা একটা নিষিদ্ধ পল্লী। একটা চুন-খসা বাড়ির সামনে ওরা বসে পড়ে। ভাগ করে খেতে থাকে নিজেদের কুড়িয়ে আনা খাবারগুলো। খেতে খেতে মেয়েটা বলতে থাকে, ‘তুই না খুউব ভালো!’
ওদের চোখে পড়ে সামনে, একটা বাড়ির দরজা ফাঁক হয়। একটা লোক টলতে টলতে বেরিয়ে আসে। ছেলেটা আর মেয়েটা এক কিস্তি খাওয়া শেষ করে। সামনের কলটায় জল আসে নি। নিজের নোংরা
জামায় ওরা হাতগুলো মুছে ফেলে। সামনে এগোতে থাকে। ছেলেটার একটা হাত মেয়েটার কাঁধে। দুজনেরই বুকে আটকানো প্লাস্টিকের প্যাকেটে ওদের অবশিষ্ট খাবারগুলো – ওদের আরো কিছু
সময়ের জীবন!
দেয়ালে লটকানো সিনেমার একটা বিরাট পোষ্টারের সামনে ওরা থেমে যায়। ছেলেটা পোষ্টারের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায়, ‘দ্যাক, ক্যামোন নংটো বইস্যা আছে
দুই জনায়!’
মেয়েটা ফিক করে হাসে।
এমন সময় এ গলির নামকরা আর একটা বেশ্যা বাড়ির দরজা ফাঁক হয়। একটা মোটাসোটা বেতো বুড়ি শকুনের দৃষ্টিতে তিনদিকে তাকায়। যদি ভোরের খেপে কিছু মেলে। চোখে পড়ে, ন্যাংটা সিনেমার পোষ্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চা ছেলে আর মেয়েটাকে! ওদের কাঁধ ধরাধরি করে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুড়ীটা ওদের ধমক লাগায় – ‘এই পেয়ারের ছোঁড়াছুঁড়ি, এখানে কি চাই – ভাগ্, এখান থেকে ভাগ্ এক্ষুনিই, যত্তোসব বেজন্মার দল!’
ছেলেটা আর মেয়েটা ভয় পেয়ে একজন আরেকজনের কাঁধ থেকে হাতটা নামিয়ে নেয়।
কোথা থেকে ষন্ডা মার্কা চেহারার একটা লোক এসে দাঁড়ায় বাড়িটার সামনে। বুড়িটা মোলায়েম সুরে খদ্দেরকে বোঝাতে থাকে –‘আসুন বাবু, এদিক দিয়ে – ভেতরে আসুন - ’
অবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট খাবারের
টুকরো টাকরা ওদের হাতের পোটলায়। ছেলেটা আর মেয়েটা। ওরা আবার সামনে হাঁটা শুরু করে।
মেয়েটা ছেলেটাকে বলে, ‘দ্যাখ, বুড্ডিটা বড্ডো বজ্জাত ! আমাগো ভাগাইয়া দিলো। মোর ঠাম্মা কিন্তু এমনতরো না!’
কিছুক্ষণ একসঙ্গে হাঁটার পর ছেলেটা বলে ওঠে- ‘অ্যাহন আমি যাই।’
অবশেষে এই সকালের নরম আলোয় ছেলেটা আর মেয়েটা দুজন দু’রাস্তা ধরে হারিয়ে যায় – দুদিকে। কাউকেই আর দেখা যায় না।
[ প্রকাশিত : মধ্যবলয় – অক্টোবর – ১৯৮৩ ]
[ 1270 words ]
R-1 / 29.04.2021
Comments
Post a Comment