জননী যন্ত্রণা
গল্প
জননী
যন্ত্রণা
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
আকাশ আর অন্ধকার মেঘ ভেঙ্গে এক সন্ধ্যাবেলা আমার মা হাজির। ঝুঁকে পড়া শরীর। হাতে লাঠি। বাঁ কনুইতে ব্যান্ডেজ। মনে পড়লো, কলতলায়
মা একবার পিছলে পড়ে গেছিল।
ফ্লাট আবাসনের ছাত। সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম। তখনই মায়ের আচমকা
এসে পড়া।
চমকে
উঠলাম। ‘তুমি এখানে, এতোদিন পরে?’
মা হেসে বললো, ‘ক্যান, নিজের বাড়িতে কি আসতে নেই? ছেলের সংসার তো নিজেরই সংসার। কত কষ্টে তোদের
পেলে পুষে মানুষ করেছি।’
এতদিন বাদে মায়ের আবির্ভাবে কি করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। শরীর ঝুকিয়ে প্রণাম
করতে গেলাম।
মা
মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
- ‘থাক্ বাবা থাক্, পেন্নাম
করতে হইবো না। তোমরা সব্বাই ভালো আছো তো?’
‘তুমি কিন্তু খুব বুড়ো হয়ে গেছো।’
‘আমি কি আর এজন্মের মানুষ রে, বাবা!’
‘চলো, ঘরে চলো।’
‘এ তোদের ক্যামন উচা উচা ঘর। আমাদের যে সেই ছোট্ট টিনে ছাওয়া ঘরটা ছিল? আম,
কাঠাল আর দুটো নারকোল গাছ ছিলো, সেগুলানও দ্যাখছি
না!’
‘ওঃ! সেসব তো এখানেই ছিল। আশপাসের অনেকগুলো
বাড়ী ভেঙ্গে এখন সব ফ্লাট হয়ে গেছে।’
লিফটে করে মা’র হাত ধরে নিয়ে এলাম আমার চারতালার
ফ্লাটে।
বললাম, - ‘বসো।’
মা এখন স্মৃতিবিস্মৃত একটা সত্ত্বা! কুঁচকে
যাওয়া চামড়ার ভাঁজে ডুবে থাকা চোখদুটো! সে দুটোকে বড় বড় করে আমার
মা সারা ঘরে কি যেন খুঁজতে লাগলো।
মা জিজ্ঞেস করলো নন্দিতার কথা। জানি, নন্দিতা
আমার মাকে একদমই পছন্দ করে না। এই সংসারে এককালে কথা-কাটাকাটি,
খুচখাচ ঝগড়া লেগেই থাকতো, মা আর নন্দিতার মধ্যে। সে সব অনেককাল
আগের কথা।
তখনো
আমাদের টিনের বাড়িগুলো ভেঙ্গে এই পাঁচতালা ফ্লাট তৈরী হয় নি।
ঘরের কোনে একটা পুরোণো কাঠের চেয়ার রাখা ছিল। লাঠিতে ভর দিয়ে
মা সেখানেই বসে পড়লো। সামনেই সাজানো গোছানো সোফা, আমার
মা সেগুলো দেখেও দেখলো না।
জিজ্ঞেস করলো তার বড় নাতির কথা। বললাম, ‘অনেক
দিন হয়ে গেছে মা, দেবদত্ত বিয়ে করে এখন আমেরিকাতেই থাকে। ওদের ছোট্ট একটা
মেয়ে।’
মাকে বললাম, আমার ছোট ছেলে রাহুলের জন্মানোর
কথা।
তাকে
দেখে যাবার সৌভাগ্য মায়ের হয় নি।
তখনই নন্দিতার ফোন এলো। রাহুলের ড্রামা
ক্লাশ আরো একঘন্টা চলবে। তাই ওদের ফিরতে দেরী হবে।
এই নতুন ফ্লাটে এতদিন বাদে হঠাৎ করে মায়ের আবির্ভাব হবার কথা
এখন ইচ্ছে করেই আমি নন্দিতাকে জানালাম না! ওকে বললাম, ‘রাহুলকে নিয়ে তাড়াতাড়ি এসো। আসার সময় স্টেশনের পাশের দোকানটা থেকে গরম গরম
জিলাপি এনো,
আর শোনো – তিন চার খিলি জর্দা পান।’
নন্দিতা আমার উপর খেঁচিয়ে উঠলো। - ‘জর্দা
পান দিয়ে কি হবে? আজকে আবার তোমার কোনো ইয়ার-দোস্তরা আসছে কি? আমি আর পারি না!’
আমি আর খোলসা করে কিছু বললাম না। ওপার থেকে নন্দিতা
ফোনটা কেটে দিল।
মা তখনো তার ছানি পরা দুচোখ মেলে এদিক ওদিক দেখছিল। অন্ধের যষ্টির
মতো লাঠিটা তার হাতে ধরা।
মাকে বললাম, ‘এক্ষুনি নন্দিতার ফোন এসেছিল। রাহুলকে নিয়ে
ওদের ফিরতে দেরী হবে,
মা। তুমি কি একটু জল খাবে? একটু
ইলেকট্রাল গুলে জল এনে দেই মা!’
ছোটবেলার মতো করে আমার মা বললো, - ‘রঞ্জু,
তুই আমার সামনে চুপচাপ বইস্যা থাক বাবা। কতদিন বাদে কি
খেয়াল হইলো,
তোর সংসারে তোকে দ্যাখতে আইলাম!’
কি জানি কতদূর থেকে এসেছে। পথ হাঁটায় পরিশ্রান্ত। এখন মা’র নিশ্চয়ই
কিছু খাবার চাই।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘তোমার জন্যে দুধ-চা বানাই। গরম গরম একটু খাও। আমরা আজকাল অবশ্য
লিকার চা খাই।’
ছোটবেলায় যেমন বকতো, তেমনি মা আমাকে ধমক দিলো!
বললো, ‘দাঁড়া রঞ্জু, তোরে আমিই চা কইরা খাওয়ামু!’
মা কাঠের চেয়ারটা ছেড়ে উঠে পড়লো। লাঠি হাতে একটু
ঝুঁকে ঝুঁকে খোলামেলা ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেলো। আমি মা’কে ফলো
করতে লাগলাম। ব্যালকনি দিয়ে দেখা যায় আরো অনেকগুলো ফ্লাট। অনেক দূরে স্ট্রীট
লাইটের আলোতে হালকা দু চারটে গাছের জলছবি! আধো অন্ধকারে লাঠিতে ভর করে মাথা
ঝুকিয়ে ব্যালকনির মেঝেতে আমার মা কি যেন খুঁজতে লাগলো।
‘কি দেখছো, মা?’
‘আমাদের উঠানে সেই যে কাঠের উনানটা ছিল? সেইটা কোথায় গ্যালো?
ডাই কইরা রাখতাম শুকনা কাঠ-কুঠো? উনানের পাশে রাখা সেই কাঠের পিড়িটা। উঠানে বইস্যা
বইস্যা কতো দুপুরে আমি তোগো জন্যে আগুন জ্বাইল্যা ভাত ফুটাইতাম। তোরা সগলে মিইল্যা
তেল নুন লঙ্কা মাইখ্যা হাপুস হুপুস কইরা ফেনা ভাত খাইতিস?’
‘মা, তুমি ভুলে গেছো! সেসব তো আমাদের
ছেলেবেলার কথা! বহুকাল হয়ে গেছে কাঠের উনোনে আমরা কেউ রান্না
করি না।’
‘ও, হাঁ হাঁ, বয়েস তো হইছে। সব কিছু আর মনে
কইরা উঠতে পারি না।
অ্যাখন
মনে পড়ছে,
কয়লার গোলা থিকা তোর বাপ বস্তা বাইন্ধ্যা কয়লার গুড়ি আনতো, আমি উঠানে বইস্যা গুল দিতাম। গুলে খুব ধোঁয়া হইতো, তাই না?’
আমি মা’কে মনে করতে সাহায্য করলাম, ‘হ্যাঁ মা! খুব ধোঁয়া হতো বলে হাত-চুলাটা উঠোনেই রাখা থাকতো, সেও অনেক পুরোণো কথা। তারপরে কিন্তু
গুল নয়,
তুমি কি ভুলে গেছো? অনন্ত দাসের গোলা থেকে কয়লা
আসতো, সেগুলো হাতুড়ীতে ভেঙ্গে ছোট ছোট টুকরো করতে। লোহার শিকের জালি
দেয়া বালতির মতো উনোনে কয়লা জ্বলাতে। আগুনটা একটু ধরে গেলে ধোঁয়া কমে যেত। তুমি একটা সাঁড়াশি, নয়তো
একটা কাপড়ে ওর হাতলটাকে ধরে উনোনটাকে মাটির রান্নাঘরে নিয়ে আসতে!’
মা ঘরের একোনে ওকোনে কি যেন খুঁজছিল।- ‘তা আমাগো
সেই কয়লার উনানটা অ্যাখন নাই?’
‘তুমি আজকাল কেন সব ভুলে যাচ্ছো? কয়লায় রান্নার দিন বহুকাল
আগেই শেষ হয়ে গেছে! আমাদের বাড়িতেও অনেককাল থেকেই গ্যাসে রান্না
হতো।
গ্যাস-ওভেন জ্বালাতে
তোমার ভয় ভয় করতো। তুমি তাই গ্যাস জ্বালাতে তোমার বউমা নন্দিতাকে, না হয়
টুনিকে ডাকতে! টুনি তোমার আদরের ছোট্ট মেয়েটা!’
‘টুনি, হ্যাঁ, আমার মাইয়্যা টুনি। টুনিরা এখন শ্বশুরবাড়ীতে
কেমন আছে?’
এই প্রশ্নের উত্তরে আমি চুপ করে রইলাম। টুনি, মানে
নিবেদিতা, আমার একমাত্র বোনটা। মা-বাবা বেঁচে
থাকতে টুনিকে দেখেশুনেই বিয়ে দেয়া হয়েছিল টালিগঞ্জে। ওর বর মনতোষ প্রাইভেট
কোম্পানীর এক ব্যস্ত অফিসার। বিয়ের পর টুনি একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াতো।
‘মা, তোমার মনে পড়ছে না? টুনির সেই
দুঃসংবাদের বিকেলটার কথা? খবরটা পেয়ে তুমি উঠোনে আর রাস্তায় ছুটাছুটি
করছিলে।
স্কুল
থেকে ফেরার সময় একটা লরীর সাথে ওর রিক্সাটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলো। টুনির
মাথায় খুব চোট লেগেছিলো। আমরা সবাই হাসপাতালে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছিলাম। তোমার আদরের একমাত্র
মেয়েটাকে আমরা বাঁচাতে পারি নি! মা, তুমি এত সহজে কেন
এসব ভুলে যাও?’
দেখলাম, মার কুঁচকানো চামড়ার নীচে ঘোলা দুটো চোখ,
তাতে কোন জল নেই!
‘মা, নন্দিতার
আসতে দেরী আছে। চলো, আমার ফ্লাটের মডুলার কিচেনে তোমাকে
নিয়ে যাই।’
মা’র ডান হাতে লাঠি। অন্য হাতটা আমার হাতে ধরা, কনুইতে
ব্যান্ডেজ।
মা এতো দিনে অনেক বুড়িয়ে গেছে। আগে আমরা যেমন
বাচ্চা ছিলাম,
আজকাল মা নিজেই কেমন বাচ্চা হয়ে গেছে। তিনি এই দুনিয়ার
অনেক কিছুই জানেন না,
অনেক কিছুরই খোঁজখবর রাখেন না!
মা’র হাত ধরে রান্না ঘরে নিয়ে গেলাম। গ্যাস ওভেন, তার উপর
চিমনি।
পাশে
রাখা মাইক্রো-ওভেনের বাক্সটা। ঘরে বনবন করে ঘোরা একজষ্ট ফ্যান, আধুনিক
সেলফ, ইউটেনসিলস, জিনিষপত্র রাখার সুদৃশ্য
সব জার, মশলা ভরা কৌটো।
মা চোখ বড়ো বড়ো করে কিচেনটা দেখতে লাগলো। লাঠি হাতে
ঝুঁকে থাকা মা,
তার গলায় প্রাচীন রুদ্রাক্ষের মালাটা দুলছিল। এককালে অভাবের
সংসারে মায়ের গুরুদেব এটাকে ধারণ করতে বলেছিলেন, তাতে আমাদের সংসারের উন্নতি
হবে, ঘরে সুখ শান্তি সব বজায় থাকবে! সেটা
কি আদপে হয়েছিলো? তাহ’লে আমার বৌ নন্দিতা সাথে মায়ের প্রহরে প্রহরে ঝগড়া কেন লেগে থাকতো?
রুদ্রাক্ষদেবের আশীর্বাদে পরিবারে সুখ-শান্তি বজায়
থাকা কি একেই বলে?
রান্নাঘরের গ্যাস-ওভেনটায় চোখ পড়তেই অতীতের কর্মময়
দিনগুলোর চঞ্চলতা মা’কে অস্থির করে তুললো। মনে হলো মা’র স্মৃতিশক্তি
তার বুড়ো কুচকানো মস্তিস্কে ফিরে এলো। বার্ধক্যের ভারে
অবনত শরীরটাও যেন একটু সিধা হয়ে দাঁড়ালো। লাঠি হাতে গ্যাস-ওভেনের
দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মা বলে উঠলো,-‘হাঁ, এইটার নামই তো গ্যাসের চুলা। আমি এই চুলাতে চা বানাইতে
পারমু।
তুই
এট্টু বস,
রঞ্জু। তোর জন্যে ঘন দুধ দিয়া চা বানাইয়্যা আনি।’
বহু বছর আগেকার কথা। আমি যখন লোহা ঢালাই কোম্পানীতে নতুন চাকুরীটা পেলাম, তখন টিনের
বাড়ীতে এসেছিল নতুন গ্যাসের ওভেন আর সিলিন্ডার! নন্দিতা বা টুনি
ঘরে না থাকলে কখনো সখনো আমার মা চা বানাতো। শুধু দেশলাই দিয়ে
গ্যাস জ্বালাতে ভক্
করে আগুনটা জ্বলে উঠতো, তাতেই মায়ের ভয়,
যেন তক্ষুনি আঙ্গুলগুলো জ্বলে যাবে!
বহুকাল আগের আমার শয্যাশায়ী মা, বিছানার
সাথে লেপ্টে যাওয়া আমার মা কি ভাবে যে ম্যাজিকের মতো আজ এতো অ্যাকটিভ হয়ে উঠলো? মা আমাকে গ্যাস ওভেনে চা বানিয়ে খাওয়াতে চাইছে। দুঃখ দিতে চাই
না, মা’কে তাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে বললাম, ‘তুমি বসো, মা। চা দুধ কাপ প্লেট
ছাকনি এসব যে নন্দিতা কোথায় রাখে তা তুমি খুঁজে পাবে না!’
মা ফোস্ করে উঠলো। - ‘ওইটাই
তোর বউটার দোষ, সংসার করা এখনো
শেখলো না! পড়াশুনা করছে ঠিকই, কিন্তু
সংসারের কাজকম্মে একদম নিকম্মা! এট্টুও শুধরায় নাই!’
আসলে মা’কে আমি বলতে পারলাম না, আজকাল নন্দিতা মাইক্রোওভেনে চায়ের জল গরম করে। চায়ের পাতা, ছাকুনির
ন্যাকড়া কাপড় চেয়ে বসলে মাকে আমি দিতে পারবো না। আজকাল আমরা লিফ-টি খাই। দুধ? না,
ঘরে তাও নেই, তার বদলে আছে কন্ডেসড মিল্কের টিন,
বোর্নভিটা, হরলিকস।
আমি নিজের হাতে ঘন দুধের চা বানিয়ে মায়ের জন্যে ডাইনিং টেবিলে
রাখলাম।
মা কিন্তু ডাইনিং টেবিলে বসলো না। খোলা ব্যালকনির
বারান্দার নিজের কাপড়ের আঁচলা বিছিয়ে কোনমতে দু’পা ছড়িয়ে আমার মা মেঝেতে
গিয়ে বসলো।
বলল, ‘চায়ের
গেলাসটা আমারে এইখানে আইন্যা দে। মাটিতে বইস্যা বইস্যা রাত্তিরের আকাশটা দেখমু আর
চায়ে চুমুক দিমু।’
পুরোণো কথা মনে করতে করতে মা বলে উঠলো, - ‘তুই
একবার চিনির বদলে ভুল কইরা চায়ের জলে লবন ঢালছিলি! সেইবার বাটি
শুদ্ধু পুরা লবন লবন চা-গুলান নাইরকেল গাছের গোড়ায় ঢাইল্যা দিলাম। মনে আছে? টুনি,
আমার মাইয়্যাটা অনেক কম্মের ছিল রে! ঘরের অনেক
কাজ কম্ম ওই মাইয়্যাটাই কইরা দিতো। বিয়া দেওনের পর বাসের ধাক্কায় এই টুনিটার মরণ হইলো! কি পোড়া
রে কপাল আমার!’
মা, আমার মৃত
বোন, নিবেদিতার জন্যে হু হু করে কাঁদতে লাগলো – ‘টুনি, আমার মাইয়্যা টুনি!’
অতীতের ভাঙ্গাচোরা সংসারের ছবি, ঢেউয়ের
মধ্যে একটা ডুবন্ত জাহাজের আলোড়ন, কিংবা সমুদ্রের জলপৃষ্ঠে ফেটে
ফেটে যাওয়া অসংখ্য বুদবুদের মতো আমার মায়ের চারপাশে বিলি কাটতে লাগলো।
মা বললো, ‘অনেক অনেক দূর থিকা যোজন যোজন রাস্তা হাইট্যা
হাইট্যা আমি আইছি; আমাগো পুরোনো বসত-বাড়িটায়। আইস্যা দেহি, এই দুনিয়াটা
ক্যামোন পাল্টাইয়া গ্যাছে! আমাগো টিনের ছোট ছোট বাড়ীগুলান আর
নাই।
তার
বদলে উচা উচা সব পাকা পাকা বাড়ি। ইট পাথরের জঙ্গল আর জঙ্গল – এহানে
অ্যাহন আর গাছপালা নাই!’
চা খেতে খেতে আমার বুড়ো মা বললো, ‘ছোটো
খোকা, ঘরে কিছু খাওনের আছে?’
মা’র ছোট-খোকা সম্বোধনে আমি চমকে গেলাম। মায়ের একটা বড়
ছেলেও ছিল।
সে
কিছুটা মানসিক রোগগ্রস্থ ছিল। বাবা মারা যাবার পরে একদিন সকালে সে হাঁটতে বেরিয়ে
ট্রেনে কাটা পরে।
জানি
না, আত্মহত্যা করেছিলো কিনা? সেসব কথাও কি এখন মা ভুলে গেছে।
আমার মা আজকাল অন্ধকার নক্ষত্রের দেশে থাকে। কিছুক্ষণ আগেই
আমি যখন ছাতে একলা দাঁড়িয়ে ছিলাম, মা আকাশ থেকে নেমে এসেছিলো। এতো দূরের রাস্তা
কিভাবে যে হেঁটে এলো,
তা হয়তো সে নিজেই জানে না! আসলে এসব প্রাণের টান। জগৎ সংসারে এ
এক আশ্চর্য্য মায়া!
পথের ক্লান্তিতে আমার মা’র নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে
পেয়েছিল।
মা বললো, ‘ঘরে এট্টু পান্তাভাত, নাইলে বাসিরুটি, এট্টু গুড় মাখাইয়া দিলেই হবে
– সামান্য এট্টু! বুড়া মাইনষের খোরাক আর কতই বা?’
পান্তাভাত, বাসিরুটি – এসব আমাদের অভিধান থেকে অনেককাল
আগেই মুছে গেছে। গুড়ের বদলে চিনি আছে। ফ্রীজে ব্রেড, এগ,
চিকেন, কেক, পেষ্ট্রি
– এসবও আছে।
মা আমার অসহায় অবস্থাটা বোধ হয় বুঝতে পারলো। বলল, - ‘ঠিক
আছে, তোর চিন্তা করণের লাগবে না। এট্টা হাড়ি আর
একমুঠা চাউল আর এট্টু লবণ আর মরিচ আইন্যা দে। উঠানের উনানটায়
ওগুলি জ্বাল দিয়া নি। অনেক কাল হইয়্যা গেছে, গরম গরম
ফ্যানা ভাত খাই না।’ দেখলাম মা আবার স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে কাঠের উনোনের
কথা বলছে!
ভয় হচ্ছিল, রাহুলকে নিয়ে নন্দিতা ঘরে ফিরে
এসে যদি দেখে এই বুড়িটা লাঠি হাতে তার সাজানো গোছানো ফ্লাটে বসে আছে; তাহলেই কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিলাম, রাহুলের
আজকের নাটকের ক্লাসের রিহার্সালটা আরো দু’ঘন্টা লেট হোক। ততক্ষনে মায়ের
জন্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে। প্রবাসী আমার বড়ছেলে। তার রুমটা তো
ফ্লাটে খালিই পড়ে আছে। তথাগতর ঘরে মেঝেতে বিছানা পেতে আজকে রাত্রের মতো
মা’কে শুইয়ে দেবো। কাল সকালে আমার বন্ধুর অ্যাম্বুলেন্স ডেকে সিধা
মা’কে নরেন্দ্রপুরের বৃদ্ধাশ্রমে!
মায়ের মাথাটা পুরোটাই গ্যাছে! এখন
খেয়াল চেপেছে,
আমার ফ্লাট বাড়ীতে আজ নিজের হাতে নিজের ফ্যানাভাত ফোটাবে। উঠোনের উনোনটা
খুঁজতে গিয়ে আমার মা লাঠি হাতে ঠুক ঠুক করে এগোচ্ছে। আমাদের
ঘরের মডুলার কিচেনের দিকে!
কোন মতে হাতটা ধরে মা’কে আবার ড্রয়িং-রুমের মেঝেতে বসালাম। বললাম, ‘বলো কি খাবে? ডাল, ভাত, মাছের ঝোল , লাউএর নরম কোপ্তা – যা চিবাতে তোমার কষ্ট হবে না। অর্ডার দেবো, খাবার
এক্ষুনি এসে যাবে।’
মোবাইল নাম্বার। ফুড সেন্টার। হোম ডেলিভারি। ওরা অর্ডার লিখে
নিলো।
‘আইজকাল তোমরা বাইরের হোটেলের রান্না খাও? ওতে কি কি মেশানো
থাকে, কে জানে? কোন জাতের মাইনষ্যে রান্না
করে? ঐসব দোকানের খাবার আমি খামু না!’
বড়ো মুস্কিলে পড়া গেলো। মাকে বোঝাতে চেষ্টা
করলাম,
‘আজকাল আমাদের খুব ফাষ্ট লাইফ। নন্দিতার হাতে
এসব করার মতো সময় নেই।’
দরজায় কলিং বেল বাজলো। রাহুল আর নন্দিতা
ফিরে এসেছে কি?
এতো তাড়াতাড়ি?
মুহূর্তেই দেখলাম, ঝুঁকে পড়া বৃদ্ধা মা’র শরীরে অদ্ভুত একটা শক্তি ভর করলো। আমার
মা লাঠি হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমার সামনে কেউ নেই, কিছু
নেই।
মেঝেতে
কেউ বসা নেই।
মা
যেখানে বসে ছিল,
সেখানে পড়ে আছে মায়ের গলার অতিপ্রাচীন রুদ্রাক্ষের মালাটা। ওটা ছিঁড়ে পড়েছে
মেঝেতে।
মালাটাকে
আমি পকেটে ভরলাম।
আমি দরজা খুলবার আগেই কোন এক অলৌকিক শক্তিতে মা কোথাও অদৃশ্য
হয়ে গেল।
রাহুল আর নন্দিতা ঘরে ঢুকলো। নন্দিতার হাতে
পান আর জিলাপির প্যাকেট। মা যে এখানে এসেছিল, তা নন্দিতাকে
জানাতে চাই না।
আমি কি আমার মোবাইল ফোনটা ছাদে ফেলে এসেছি? এক্ষুনি
আসছি।
বলে
আচমকাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। লিফট বেয়ে দ্রুত উঠে গেলাম ছাদে। দেখলাম, রাত্তিরের
অন্ধকারে সেই বিল্ডিংএর ছাদে মা তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। আমার পায়ের শব্দ
পেতেই লাঠির ঠকাঠক আওয়াজটা শুনলাম। মা আমাকে একবার দেখে নিয়েই উড়াল দিলো আকাশে!
আমি পকেট থেকে বের করলাম জিনিষটা। অন্ধকারকে উদেশ্য করে বিড়
বিড় করে বললাম,
‘মা, মা, তোমার গলার রুদ্রাক্ষের
মালাটা আমার ঘরে ছিঁড়ে পড়েছে। নিয়ে যাও। তুমি তো জানো
তোমার বউমা,
নন্দিতা, এসব জিনিষ পছন্দ করে না!’
আকাশে উড়ে যেতে যেতে অতিশয় বৃদ্ধা আমার মা তখন যেন আবার তরুণী
হয়ে গেছে।
ঠিক
ততটাই তরুণী-
যখন আমার বয়েস পাঁচ! যখন আমাদের ছিল আম-কাঁঠাল গাছে ছাওয়া একটা টিনের বাড়ী!
মা তো এই মুহূর্তে যুবতী হয়ে গেছে। বয়সকালে ধারণ
করা কণ্ঠির এই রুদ্রাক্ষের মালাটা নিয়ে সে এখন কি করবে? তবুও
রুদ্রাক্ষের মালাটা আকাশে ছুঁড়ে দিলাম। আমার ছুঁড়ে দেয়া
রুদ্রাক্ষের মালাটা অন্ধকার আকাশে মিলিয়ে গেলো।
‘টুনি, আমার
মরা মাইয়্যাটা! আমার পাগলপন বড় পোলাটা! সক্কলের সাথে দেখা করণের লইগ্যা মনটা আজ বড় দুখাইছে! আমার মাইয়্যা! টুনির সাথে দেখা করবার লইগ্যা আমি এখন
স্বর্গের দিকেই ফিইরা যাইতেছি! ছোটখোকা - আশিব্বাদ করি- তোরা সক্কলে
ভালো থাকিস!’
মায়ের বলা কথাগুলো আবছায়ার মতো শুনতে পেলাম। যেন মহাকাশ থেকে
ভেসে আসছে জননী-যন্ত্রণার এক অনন্ত অনাদি কন্ঠস্বর!
শতানীক - April-2021.
অসাধারণ গল্প, শক্ত বাঁধুনি। চলমান দিনের বাস্তব উপস্থাপনা। হে সাহিত্যিক ও কবি, তোমার কর্মজীবনের থেকে অবসরের পর শুরু করেছো এক নতুন অধ্যয়ের। এটাই তোমার নব জন্ম , নব সূচনা। তুমি শতায়ু হও। সমাজে কবি, সাহিত্যিকদের কোন বিকল্প নেই। এরাই আজ পারে নিরপেক্ষ ভাবে হয়ে উঠতে সমাজের প্রতিফলক আয়না। চারিদিকে ব্যাপক কনজিইমারিজম ও বিশ্বায়ণের গ্ড্ডালিকা প্রবাহের মধ্যে অর্থ উপার্জনের হাতছানিতে মত্ত প্রাতিষ্ঠানিক সুধীজন। তাই চতুর্দিকে অর্ডারী সাহিত্য-সংস্কৃতির ছড়াছড়ি। হে নীলকন্ঠ কবি, সমাজের সব গরলকে কন্ঠে ধারণ না করে ঢেলে দাও তোমার যন্ত্রণা কাগজে কলমে। স্বয়ং দেবী সরস্বতী তোমার সহায় হয়েছেন। তোমার কলমে এখন শত-সহস্র হস্তীর বল ভর করেছে। চালাও তোমার কলম। এক ব্যতিক্রমী সাহিত্যের হোক শুভ সূচনা।ভাবিকাল এর প্রতীক্ষায় আছে। অনিরুদ্ধ
ReplyDeleteঅনুপ্রাণিত হলাম!
Deleteখুব ভাল লাগল ! নির্মম বাস্তব আর ছেলেবেলার ভালোবাসার গল্প!
ReplyDeleteকয়লার উনুন আর ফ্যানা ভাত, ভুলে যাওয়া মায়াময় যাপন কথা! অপূর্ব!!!!