সময় স্মৃতির বাক্স

 

গল্প

সময় স্মৃতির বাক্স

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

বাক্সটা কারুকার্যময়, অথচ বেশ হাল্কা। ওটার আয়ু কতটা? অন্তহীন? ওটা কি খুব টেকসই?

চারজনের কাঁধে লম্বাপানা সেই বাক্সটা। ওরা হাঁটছিলোবাক্সের চারপাশে সাঁটা কিছু  অতীতের ছবি বর্তমানের সুখদুঃখতাতে ধরা ছিল সময়ের আঁকিবুকি বাক্সটা আপাত দৃশ্যমান, কখনো অদৃশ্য! লম্বাপানা বাক্সটাকে মনে হচ্ছিলো কোন শবাধার বা কফিন।

চারবন্ধু পুকুর পারের বাঁধানো রাস্তাটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো, তখন বিকেলটা যাবো যাবোসময় জুড়ে বিষণ্নতা। ওদের সমবেত হাসির টুকরোগুলো পরিশ্রান্ত পায়ে পায়ে শরীরে নেমে আসছিল ক্লান্তি। হাঁটতে থাকা চারবন্ধুর টুকরো টুকরো কথা, ভারী মেঘের মতো উড়ছিলসেগুলো বিশ্রাম নিতে চাইছিল তাদের কাঁধে ধরা সেই লম্বাপানা বাক্সটায়

হঠাৎ এর মধ্যে একজনের কি হলো? সে বাক্সটার ওজন ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়লো। টালমাটাল বাক্সটাকে সামলে নিল বাকী তিনজনরাস্তায় ভূপাতিত প্রথম বন্ধু, তার পা দুটো খুলে বাক্সটার ভেতর জমা রাখলো। তার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব ছিলো না। এই দল থেকে সে চিরদিনের জন্যে বিদায় নিল। অগত্যা বাকী তিনজন চোখের জল মুছতে মুছতে প্রথম বন্ধুর স্মৃতি-সমাহিত সেই বাক্সটাকে কাঁধে নিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে

কিছুদূর এগোতেই দ্বিতীয় জন বললো, - ‘আর পারছি না! বয়সের ভারে আমিও ক্লান্ত। তোমরা এগিয়ে যাও!’ এই বলে সে তার কাঁধ আর হাত দুটোকে ওই বাক্সে জমা করে দিল। সেদিন থেকেই পার্কে তার রোজকার ইভিনিং-ওয়াকের কথা চিরতরে মুছে গেলো।

প্রিয় সাথীদের হারিয়ে বিষণ্ণ দুই বন্ধু বাক্সটাকে কাঁধে নিয়ে উপায়হীন এগিয়ে চললো সামনেওটাকে বইতে প্রথমে ছিল চার, হয়ে গেল দুই! এই দুজনে মিলে কফিনটাকে বইতে কষ্ট হচ্ছিল বৈকি। কাঁধে তাদের অনেকখানি স্মৃতির বোঝা।

হেঁটে চলা রাস্তার পাশে বাঁধানো পুকুরটায় ফুটেছিল পদ্মফুল মেঘলা আকাশ, উঁচু উঁচু হাউজিং কম্পলেক্সের আবছা ছায়া, পুকুরের জল পদ্মফুলগুলোর মেঘলা হাসিতে তৃতীয় মানুষটার মনে পড়ে গেলো তার গ্রাম বাড়ী, ফেলে আসা জন্মভিটের কথা। মানুষটার হৃৎপিন্ডটা এতোই তড়পাতে লাগলো, সে আর বাক্সটার ভার বইতে পারলো না। অবশিষ্ট একমাত্র বন্ধুটার হাতে এই বাক্সটার ভার কোন রকমে তুলে দিলো, তারপর সেও মাটিতে শুয়ে পড়লো। মরে যাবার আগে তার জীবিত বন্ধুটিকে সে আলগোছে সঁপে দিল নিজের হৃৎপিন্ডটালম্বাপানা স্মৃতির শবাধারে রাখা হলো সেটা সময় কি আশ্চর্যময়! অল্পটুকুন সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে গেল তিন তিনটে জীবন! কিছুক্ষণ আগেও মানুষগুলো বেঁচে বর্তে ছিল, চারজনে মিলে মিশে নিজেরাই বহন করছিল সেই আশ্চর্য বাক্সটা!

কি আর করা! তখন ঘোর সন্ধ্যা শেষ বন্ধুটার জিম্মায় এতদিনকার পুরাণো বাক্সটা। দুচোখ মেলে একান্ত প্রিয়জনের মতো সেও বাক্সটার দিকে তাকিয়ে রইলো। স্মৃতিভরা এই কফিনটাকে নিয়ে তার পক্ষে আর এক পাও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না সেও মনে মনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল

ভারী বাক্সটাকে নিয়ে এইবার সে মাটিতে রাখলো বিকেল গড়িয়ে ধীরে ধীরে রাত্রি নামছিলো। পুকুরের ধারে জনহীন পার্কটার এক কোনায় বসে লোকটা বাক্সটাকে পাহারা দিতে লাগলোসে রাতে এই প্রবীন মানুষটার আর ঘরে ফেরা হলো না। রাত গভীর হলে একসময়ে সেও বাক্সের ঢাকনাটা খুললো, নিজেই তার মধ্যে ঢুকে পড়লো কারুকার্যময় আয়তক্ষেত্রিক ঢাকনাটা তখনো একটা ফুলগাছে এলানো ছিলখোলা কফিনটায় শুয়ে শুয়ে সে দেখতে লাগল গাছপালা, জোনাকির ঝাঁক, খোলা আকাশ। বাক্সটার মধ্যে ছিল সময়ের জীবাশ্ম, ফিস্ ফাস আত্মার কথা, মৃত বন্ধুদের ছিন্ন পা, খুলে রাখা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া হৃৎপিন্ডের অস্ত্বিত্ব, আর ছিল অতীত দিনের গল্পকথা! সে নিজের অনুভবে ছুঁতে চাইলো ক্রমশঃ আচ্ছন্ন হয়ে আসা হাল্কা হাল্কা স্মৃতিগুলো ক্লান্ত লোকটা এক সময়ে বাক্সের মধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লোতার ফুসফুস ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলআর ঘুম ভাঙ্গলো না। ফুলগাছে এলানো বাক্সর ঢাকনাটা কাঁপছিল হঠাৎ একটা মাঝারি হাওয়াতে ধুরুম করে ঢাকনাটা পড়ে গেল, চিরকালের জন্যে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেলো বাক্সটার মুখপুকুর পাড়ে তখন ঝিঁঝিঁর ডাক, একটা ভূতূরে নির্জনতা!

চতুর্থজনের মৃত্যুর কিছু সময় পরের কথা সেই রাত্রেই আরেকটা দমকা হাওয়া এলো  বাক্সটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল কয়েকশো মাইল উড়তে উড়তে সেই বাক্সটা পৌঁছে গেল অনেক দূরে, অন্য দেশের কোন একটা সমুদ্রের কিনারে একটা বেইমান হাওয়া ধাক্কা দিতে দিতে ওটাকে লুকিয়ে ফেললো জনহীন বালিয়ারির পাশে, একটা ঝোপ জঙ্গলের আড়ালে।

সময়-অস্তিত্বের কারুকার্য করা চারবন্ধুর স্মৃতিমাখা এই পুরোণো বাক্সটা! সমুদ্রের নির্জন পারে। সবার আড়ালে দিনের পর দিন লুকিয়ে রইলো কফিনের মতো জিনিষটা

সময় বড় বেইমান! ওই মৃত লোকগুলোর প্রতিবেশীরা তখনো জীবিত অথচ তারা শীঘ্রই সব কিছুই ভুলে গেল তাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেল কতগুলো দৃশ্য যেমন- সেই পুরোণো পার্কটা; পুকুর পারে একসময়ে বেড়াতে আসতো এ পাড়ারই চারজন লোক যারা রোজ লম্বাপানা একটা অদৃশ্য বাক্স কাঁধে নিয়ে নিজেরাই গপ্পো করতো, ওই পুকুরের কিনারায় ইভিনিং ওয়াক সারতো। জীবিত মানুষেরা খুব তাড়াতাড়ি সব কিছুই ভুলে যায় পুরোণো স্মৃতিকে ফেলে রাখে নির্জন ঝোপঝাড়ে, দিগন্তহীন সমুদ্রের কিনারে!

 অনেককাল পরের কথা। কোথাকার কোন চারটে যুবক বেড়াতে এসেছিল এক বিকেলে অল্প বয়েসী ছেলেগুলো সমুদ্রের পারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঝোপ জঙ্গলের কাছে হাঁটতে হাঁটতে তাদের নজরে পড়লো বাক্সের মতো জিনিষটাঝোপের আড়াল থেকে তারা টেনে বের করে নিয়ে এলো লম্বাটে, নক্সা কাটা পরিত্যক্ত কফিনটা আমরা যেমন ধ্বংসাবশেষ থেকে কৌতূহলে বের করে আনি পুঁথি ভরা পুরোণো প্রত্নতাত্মিক কোন তোরঙ্গ অথচ এই কফিনটার মধ্যে কোন কিছুই ছিল না বাক্সটার ভেতরে রাখা প্রাচীন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর মানুষের দেহাবশেষকে গিলে ফেলেছিল বিস্মৃতির উইপোকা, বান্ধবহীন ঘড়ির সময় ট্যুরিস্ট ছেলেগুলো ঝোপ ঝাড়ের থেকে কফিনটাকে টেনে বের করে নিয়ে এলো তটপ্রান্তের বালিয়াড়িতে, দিগন্তহীন নীল নীল জলের কাছেসমুদ্রের ঢেউএ সাফ সুতরো হয়ে গেল বাক্সটির ভেতরে জমানো পুরানো কথা, সমুদ্রের নীলচে জলে সাফ হয়ে গেল তার খোল নলচে। মৃত চারবন্ধুর স্মৃতি-স্বত্বার কোন চিহ্ণই ওই বাক্সটার মধ্যে আর অবশিষ্ট রইলো না!

সেই চারটে তরুণ যুবক, আজকাল তারা পাশাপাশি হাঁটেতারা চারজন মিলেমিশে কাঁধে তুলে নিয়েছে কুড়িয়ে পাওয়া পরিত্যক্ত বাক্সটাতারা হাসতে হাসতে এরই মধ্যে জমা করে রাখছে তাদের একান্ত সময়, এখনকার গালগল্প আর জমানো স্মৃতিগুলো! চারবন্ধু এখন কথা বলে চলেছে, নতুন নতুন গান গাইছে, হাঁটতে হাঁটতে বাক্সটায় জড়ো করছে তাদের দৈনন্দিন কথা, সময় স্মৃতি

 এমনি ভাবেই পৃথিবীর নবীন যুবকেরা পাশাপাশি হাঁটে! ওদের সমবেত কাঁধে থাকে সময় স্মৃতির বাক্সটা নিজেদের যাপিত সময় আর স্মৃতিগুলোকে বাক্সে বয়ে নিয়ে যাবার এ এক অনিবার্য পরম্পরা

অথচ সবাই জানে, বয়ে নিয়ে যাওয়া সময়-স্মৃতির এই ভারবাহী কফিনটা জীবিত অবস্থায় বড়ই কারুকার্যময়, অথচ মৃত্যুর পরে তা ধূসর, পরিত্যক্ত আর পালকের চাইতেও হাল্কা!

 Published - মৈত্রীদূত / Puja 2020.

Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

দয়াবতী, যাও, ফিরে যাও!