আমার হেমন্ত যাপন

 আমার হেমন্ত যাপন

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

বাংলায় কার্তিক অগ্রহায়ন এই দুই মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু। সেটা ইংরেজী ক্যালেন্ডারের অক্টোবর- নভেম্বর- ডিসেম্বরকে এই মাসগুলোকে জড়িয়ে নিয়ে থাকে। আমার শৈশবে হেমন্তের কথা কিছু কিছু মনে পড়ে। দুর্গাপুজোটুজো শেষ হয়ে স্কুল খুলেছে নভেম্বরের কাছাকাছি, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পরীক্ষা। তাই হেমন্ত শুরু হতেই বুক দুরু দুরু। রাস্তার ধূসর ধূলো উড়িতো, ঘরে ফিরতাম। মাথায় টেনশন অ্যানুয়াল পরীক্ষায় পাশ করতে হবে, নইলে কপালে দুঃখ আছে!

শরত ঋতুতে পূজোর ছুটির মধ্যে তো আমরা খুব আনন্দ করেছি। সেই সব আনন্দের দিন কেটে যেতেই মনে হতো বাংলার প্রকৃতি-পর্বে কিছু একটা বদল হতে যাচ্ছে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাজি নিয়ে ফুল কুড়াতে যেতাম, ভোরের দুর্বা ঘাসে লেগে থাকতো ভেজা ভেজা শিশির, হাওয়াই চপ্পলের পাদুটো শিশিরের জল মাখামাখি হয়ে যেতো! সকাল দশটায় পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। দেখতাম, আকাশটা নীল, তাতে পেঁজা তুলোর মতো খন্ড খণ্ড মেঘ ভাসছে!

মনটা কেন জানি না খারাপ হয়ে যেতো। শরতের পালা-পার্বণ আসতে আসতে আরো একটা বছর লেগে যাবে, চক্রাকারে সবগুলো ঋতুর পরিভ্রমণ শেষ হলে আবার সেই কত দিন বাদে দুর্গাপূজার ছুটিতে মামার বাড়ী বেড়াতে যাবো!

তাই হেমন্ত ঋতু আসাতে আমার মনে কোনো আনন্দ থাকতো না। একটা নিঃস্বতা অনুভব করতাম। বিকেলে স্কুল ফেরতা হাওয়াই চপ্পলে ধূলো বালি ছড়াতে ছড়াতে মাটির পথ হাঁটতাম। মনে হতো, ফাঁকা রাস্তায় হেমন্ত ঋতু একজন দুঃখীর মতো আমার পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে, যার পকেটাটা বিলকুল শূণ্য!

গাছে তখন সদ্য কাঁচা কুল ধরেছে। তাই পকেটে পুরে কোনো কোনো দিন পাড়াতুতো দোস্ত জুনুর সাথে চলে যেতাম তারাপদর বিলে। সেখানে কয়েকটা খালি নৌকা বাঁধা থাকতো। নৌকায় বসে কাঁচা কুল আর ঝাল নুনে মুখগুলো কষিয়ে ফেলতাম। বিলে তখনো ফুটে আছে গাদা গাদা শাপলা, দু-একটা পদ্ম ফুল। নৌকায় বসে বসে গল্প করতাম। বিলের কিনারে সূর্য ডুবে যেতো, যার লাল – হলুদ- গোলাপী আভাস লেগে থাকতো পশ্চিমে। বিলের অন্য প্রান্তে, জলের সাথে মিশে যাওয়া আকাশটাও রঙের ছটায় আলোকিত হয়ে উঠতো।

তড়িঘড়ি পা চালিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে দেখতাম, কারা যেন তাদের বেড়ার বাড়িতে লম্বা বাঁশের ডগার নীল রঙের আকাশ-প্রদীপ জ্বালিয়েছে!

গ্রামের স্কুল জীবন শেষ করে যখন কোলকাতার এক ইউনিভার্সিটিতে এসে উঠেছি, কিংবা  আরো কয়েকটা বছর পরে চাকুরী নিয়ে যখন ছত্তিশগড়-ভিলাই চলে এসেছি, তখন হেমন্ত ঋতুকে আলাদা করে চিনে নেয়া একদম মুস্কিল হতো! গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, শীত এসব ঋতুদের মতো হেমন্তের তেমন বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে কি? গ্রামেগঞ্জে তাও হেমন্ত ঋতুকে কিছুটা চেনা বোঝা গেলেও, শহরে তাকে চিনে নেয়া খুব মুস্কিল!

শহর জীবনে হেমন্ত ঋতুর উপস্থিতি কেমন নীরব আর নীরস! বাংলাতে হেমন্ত বলে একটা কাল আছে, কিন্তু সে সময়টা খুব দীন দুঃখীর মতো!

এই জন্যে হেমন্ত জানে ঋতুর রঙ্গমঞ্চে সে একজন এক্সট্রা প্লেয়ার! এনিয়ে তার কোন দুঃখ বা ক্ষোভ নেই। শরৎ কালের একটা জেল্লা আছেঢ্যাম কুড়াকুড় ঢাকের বোলে, মানুষের পোষাকে আষাকে অন্যদিকে শীতকালটা রাগী মাস্টারণির মতোআদুল হাতে পায়ে ঠাণ্ডার বেত-চাবুক! মানুষেরা চাদর, সোয়েটার, কম্বলের আশ্রয় খোঁজে শরৎ আর শীত এই দুই ঋতুই সাড়ম্বরে মানুষকে জানান দিয়ে আসে সেই তুলনায় হেমন্ত ঋতু কেমন যেন নিস্প্রভরাস্তায় হেঁটে যাওয়া চতুর্থ ঋতু, একটা হাঁদারাম, ছয় ভাইয়ের মধ্যে সব চাইতে যে নিস্প্রভ, যায় উপস্থিতি এই জগত সংসারে আড়ম্বরহীনমনে হয় এ বেচারা কেনই বা বেঁচে আছে! এজন্যেই প্রকৃতির এই অবহেলিত চতুর্থ সন্তানটির জন্যে আমার মায়া হয়, দয়া হয়! কেন যে অবহেলিত এই ঋতুটিকে আমরা দেখেও দেখি না! দুনিয়ার মানুষ প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় – ‘হেমন্ত, আসুক বা না আসুক, আমাদের কি অসুবিধে! বাকী পাঁচটা ঋতু নিয়েই আমরা কাজ চালিয়ে নেবো!’

বিনীত পথিকের মতো কখনো কখনো হেমন্ত ঋতু তর্জনী বাড়িয়ে দেখায় গাছে গাছে ফুটে থাকা ফুলের দিকেওরা শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকাহেমন্তর দীর্ঘশ্বাসে গাছের সবুজ সবুজ পুরুষ্টু পাতারা হাসতে হাসতে বলে এই তো আমরা এখনো ঝরি নি!

যারা গ্রামে থাকে তারা দেখে! খেতের সবুজ সবুজ ধান গাছগুলো মাথা নাড়তে নাড়তে হেমন্তকে সান্ত্বনা দিয়ে লছে – ‘এতো দুঃখ কেন? আমরা তো তোমারই আপনজন আমাদের হলুদ হলুদ ধানের শীষে শস্যেরা যখন হেসে উঠবে, তখন তোমাকে কেউ আর অবহেলা করবে না!’ কয়েকদিন অপেক্ষার পর হেমন্তের মন কিছুটা খুশীতে ভরে ওঠে, তখন ধান কাটার সময় আসছে!

 ওই তো তখনই চাষিদের ঘরে ঘরে উঠছে নতুন নতুন ধান আর সেই আনন্দ উপলক্ষে গ্রামবাংলা মেতে উঠেছে নবান্ন উৎসবে। গ্রামে গ্রামে শুরু হয়ে গেছে পিঠেপুলির আয়োজন। 

আমার মতো শহরে থাকা একজন লোক কখনো কখনো সুদূর গ্রামে আসেহেমন্তের সাথে তার খুব ভাব হয়ে যায় আমি হেমন্তকে বলে উঠি – ‘তুমি কি সুন্দর! ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা- কি সুন্দর তুমি প্রাকৃতিক সেজে আছো ঋতুবন্ধু, আমাদের শহরে তোমাকে খুঁজে পাই না কেন?’  

হেমন্ত বিজ্ঞের মতো উত্তর দেয় – ‘তোমরা শহরের বাবু গাড়ি ঘোড়া কল কারখানা অফিস কাছারিএসব নিয়েই তোমরা মত্ত থাকো! আমাকে যে দুচোখ ভরে দেখবে, তোমাদের সে সব সময় কোথায়! তার পরে ধোঁয়ায় ভরা তোমাদের শহরের আকাশদূষিত একটা পরিবেশএ জন্যেই তো শহরে যখন থাকো তোমরা আমাকে অনুভব করতে পারো না!’

পরিবেশবিদেরা এই দুঃখ জানে আধুনিক যুগে পৃথিবীতে বাড়তে থাকা দূষণের মাত্রা বাংলার শহরাঞ্চল থেকে হেমন্তকে একরকম মুছেই দিয়েছে। সে কারণেই আজকাল শহুরে বাঙালি সাধারণভাবে হেমন্তকে আলাদা করে অনুভব করতে পারে না।  

তবু কবির কলমে হেমন্ত উপেক্ষিত নয় হেমন্ত তাই বার বার উঠে এসেছে কবিতায় বা গানে, যদিও তার পটভূমি গ্রামীণ জীবন যেমন

হেমন্ত বৈকালে
উড়ো পাখপাখালির পালে
উঠানের পেতে থাকে কান, শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ
অঘ্রাণের মাঝরাতে।   [ জীবনানন্দ দাশ]

অথবা

 

প্রথম ফসল গেছে ঘরে
হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা![ জীবনানন্দ দাশ]

 

কিংবা রবীন্দ্র নাথের এই গানটি  -  

হিমের রাতের ওই গগনের দীপগুলিরে

হেমন্তিকা করলো গোপন আঁচল ঘিরে।। ……

শূণ্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,

কাশ ঝরে নদীর তীরে

বঙ্গ ঋতু-চক্রের পরিক্রমায় শরতের পরে শূণ্যতা, রিক্ততা ও প্রকৃতির উদাসীনতা নিয়ে আমাদের সামনে আসে এই হেমন্ত যেন একজন নির্লিপ্ত ঋতু! দুমাস কোন রকমে তার ডিউটি সেরে সময়টাকে চট জলদি ঠেলে এগিয়ে দেয়খুব লাজুক আর প্রচারবিমুখ এই ঋতু শীতকালকে নিজের জায়গায় বসিয়ে দিয়ে হেমন্ত কালটা তড়িঘড়ি বিদায় নেয়! 

আমার শহরে থাকা পাঠকেরা সত্যি সত্যিই কি হেমন্তকে একটুখানি পছন্দ করবে? দূষিত পরিবেশ ও পরিকল্পণাহীন নগরায়ণকে আটকাতে কিছুটা সক্রিয় হবে? হেমন্তকে একটি সর্বাঙ্গীন ঋতু হিসেবে মেনে নিয়ে তার অনুসন্ধানে গ্রামে গঞ্জে ঘুরবে? নিদেন পক্ষে কার্তিক মাসের শেষে আকাশে একটা ঝাড়-লণ্ঠন জ্বালিয়ে উদাসী হেমন্তকে একটুখানি সম্মানিত করবে?


                                         

 

                                                                                                                      [ 23.09.2021]

                                         কবিতা পাঠচক্র ব্লগজিন - Dec-2021

 






Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

দয়াবতী, যাও, ফিরে যাও!