কম্বুদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ও কন্দর্প-কথন
কম্বুদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ও কন্দর্প-কথন /
সমরেন্দ্র
বিশ্বাস
প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রেমের দেবতা কন্দর্পদেবকে আজকেই সন্ধ্যায় পুড়িয়ে মারা হবে। মেয়রের উদ্যোগে
কম্বুদ্বীপের মিলিটারি
প্যারেড গ্রাউন্ডে
তাই প্রেম-বিরোধী বিশাল জন
সমাগম। প্রেম একটা আবেগ, তাকেই কিনা হত্যা করা হবে!
কম্বুদ্বীপ একটা ছোট্ট দেশ। প্রেসিডেন্টের
সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই সে দেশের সংবিধান চলে। কম্বুদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এসেই সংসদে ঘোষণা করলো একের পর এক কতোগুলো
প্রস্তাব। কারণ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
সংবিধান সংশোধনী বিলের একটা অন্যতম
বিষয় হলো মানুষের মধ্যকার অবারিত প্রেম প্রেম সম্পর্কের দ্রুত রাশ টানতে হবে।
প্রেসিডেন্টের ভাষণে কারণ হিসেবে বলা হলো, মনুষ্যজীবনে প্রেম সম্পর্কিত আবেগের
অপব্যয় তার প্রতিষ্ঠানিক কর্মক্ষমতাকে দারুণ মাত্রায় কমিয়ে দেয়। তাছাড়া প্রেম সম্পর্কিত বিভিন্ন
ঘটনা নানা আইনী জটিলতার সৃষ্টি করে। আদালাতে এরকম হাজার হাজার কেস পেন্ডিং।
মিডিয়ার মাধ্যমে লোকেদের জানানো হলো,
এই প্রেম–ভালোবাসার জন্যে
কম্বুদ্বীপে গত
বছরে ২৫টা খুন, ১৩টা সংঘর্ষ আর ১৭টা আত্মহত্যার
ঘটনা ঘটে গেছে। অনিয়ন্ত্রিত প্রেমের ফলে
অল্পবয়েসী ছেলে মেয়েগুলো গোল্লায় যাচ্ছে। প্রেমের চক্করে সরকারী দপ্তরে কাজের
এফিসিয়েন্সি ৩০% কমে গেছে! এজন্যেই দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতির চরম শত্রু
- মানুষের আবেগ এবং প্রেম – এসব ব্যাপারগুলোকে যেমন করেই হোক
বন্ধ করতে হবে!
কম্বুদ্বীপের প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণায়
দেশের মানুষজন অবাক হলো। ঘরে ঘরে মানুষেরা বলাবলি শুরু করলো – এ কেমন বিটকেলে আইন গো!
এক দম্পতি হাতে হাত ধরে শরীরে শরীর
ঠেকিয়ে পাশাপাশি হাঁটছিলো। কম্বু দ্বীপের পুলিশ আইন ভঙ্গের জন্যে তাদের দুজনকে গ্রেপ্তার
করলো। এক বৃদ্ধ পার্কের নরম সবুজ ঘাসে শুয়েছিলো, তার তরুণী পরিচারিকার কোলে মাথা রেখে। খবরটা নজরে
আসতেই বুড়োর নামে নোটিশ এলো, প্রকাশ্যে প্রেম বিরোধী আইন ভঙ্গ করার জন্যে পাঁচ হাজার
টাকার ফাইন হলো। কো-এডুকেশন স্কুল কলেজগুলো বন্ধ করে দেয়া হলো। এ জায়গা সে জায়গা থেকে
জোয়ান রক্তের কম বয়েসী ছেলে মেয়েরা প্রায় প্রতিদিনই গ্রেপ্তার হতে লাগলো – অভিযোগ তারা
নাকি পাশাপাশি বসেছিলো আর প্রকাশ্যে প্রেম নিবেদনের চেষ্টা করছিলো।
দেশের এই কালা কানুন থেকে রেহাই পেতে তরুণ তরুনীরা প্রতিবাদী হতে চাইলো। প্রসিডেন্টের
একতরফা রাস্ট্র, আর সেটাও একটা দমনমূলক মিলিটারি পুলিশের দেশ।
এখানে সামনা সামনি প্রতিবাদ করা সম্ভব নয়। হতাশ হয়ে অনেকেই ঘরে ঘরে প্রেমের দেবতা কন্দর্পদেবের বিগ্রহ
বসিয়ে পূজাআচ্ছা শুরু করে দিলো। যদি অবস্থাটা ফেরে, যদি এইসব কালা কানুনগুলো পালটায়।
ওদিকে কিছু বিরোধী মানুষ প্রেসিডেন্টের
এই একতরফা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলো! তারা মিছিল করে জানালো - প্রকাশ্যে প্রেম জনিত
আবেগের প্রকাশ
কোন খারাপ কিছু
না। তাদের হাতে পোষ্টার –
‘প্রেম ও আবেগ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি!’
কিংবা
‘প্রেসিডেন্টের প্রেম বিরোধী ফতোয়া
মানছি না, মানবো না!’
কম্বুদ্বীপের সরকার তাদের ছোট্ট দেশে নানা পদক্ষেপ নেয়া শুরু করলো। কি করে মানুষের আবেগে রাশ
টানা যায়, প্রকাশ্যে প্রেম প্রেম ভাব দেখানো বন্ধ করা যায়। বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো এরকম
–
১) প্রেম বিরোধী স্কোয়াড চালু হলো।
২) ছেলে-মেয়েদের জন্যে আলাদা আলাদা স্কুল,
আলাদা আলাদা পরিবহন ব্যবস্থা।
৩) সামগ্রিক ভাবে প্রেমের দেবতা কন্দর্পদেবের
পূজা নিষিদ্ধ করা হলো।
৪) যুবক যুবতীর বিবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন, যা কি না পাত্র-পাত্রীর স্থানীয় সরকারী প্রেম-অনুশাসন অফিসারের অনুমোদন
সাপেক্ষ হতে হবে।
৫) সরকারী কর্মসূচীর প্রোপাগান্ডা হিসেবে
প্রেম-বিরোধী বিভিন্ন প্রচারমূলক অনুষ্ঠান চালু থাকবে।
বসন্তের এক শুভ দিন, কম্বুদ্বীপের প্রসিডেন্টে তার কয়েকজন
সেক্রেটারী আর আমলাদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করলো আগামী ১৪ই ফেব্রুয়ারী কন্দর্প নিধন
অনুষ্ঠান করতে হবে, সে অনুষ্ঠানটা হবে বিশালাকারে, প্যারেড গ্রাউন্ডে। প্রেমের দেবতা কন্দর্পদেব। প্রতীকি ভাবে এই কন্দর্পদেবকে অগ্নিসহযোগে নিধন করতে হবে –
তা করা হবে উন্মুক্ত ভাবে জনসাধারণের সামনে।
####
কম্বুদ্বীপের প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রেসিডেন্টের
নির্দেশে ১৪ই ফেব্রুয়ারী আয়োজিত হচ্ছে কন্দর্প-নিধন অনুষ্ঠান।
কন্দর্পদে্বের একটা বিশাল মূর্তি, সেটাকে ময়দানে দাঁড়া করানো হয়েছে। মিলিটারি পুলিশ
ভ্যান গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স সাংবাদিক। হাজার হাজার মানুষ। পুরুষ মহিলাদের আলাদা আলাদা বসবার ব্যবস্থা।
যুবক যুবতী, অল্প বয়েসী ছোরা-ছুরিরা মজা দেখতে
এসেছে। বুড়ো বুড়ি, নানা বয়সের
মানুষেরাও হাজির। কেননা আজকের প্যারেড গ্রাউন্ডে এই হাজির থাকাটা অনেকাংশে বাধ্যতামূলক।
এদিকে ওদিকে ঢাক ঢোল কর্তাল। শব্দ বাজী। মাইক্রোফোনের
ঘোষণা। প্রচণ্ড ভীড়ে মানুষজন গা ঘেষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি দাঁডিয়ে আছে বিভিন্ন বয়সের মানুষজন। আজকে দিনের রীতি অমান্য
করে, ভীড়ের মধ্যে লুকিয়ে চুরিয়ে একসাথে দাঁড়িয়ে আছে কম বয়সের যুবক যুবতী। তাদের কাঁধে
কাঁধ ঠেকে আছে।
এই সব যুবক-যুবতীদের হাতের বা শরীরের ছোঁয়া লেগে বিদ্যুতের মতো শরীরে প্রেমের
অনুভূতি
জাগছে।
অথচ আজকের পর এই দেশে আর কেউ কারো সাথে প্রেম
করতে পারবে না। তারই প্রতীকি আয়োজন এই কন্দর্প-নিধনের মেগা অনুষ্ঠান!
সন্ধ্যা সাতটায় দাউ দাউ করে আগুনে জ্বলবে কন্দর্পদেবের
কুশপুত্তলিকা। ভাষণ পর্ব শেষ হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারী, মিলিটারী আর পুলিশের চীফ, শহরের মেয়র – সবাই আজ মঞ্চে উপস্থিত। রিমোট সুইচ, ইলেকট্রিক – ইগনাইটর। প্রেসিডেন্ট বোতাম টিপলেই দাউ দাউ করে জ্বলে
উঠবে প্রেমের কুশপুত্তলিকা, তার মস্তিষ্ক, হাত-পা, বুক - দেবতার গোপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ! কন্দর্পদেবের নিধনের মধ্য দিয়ে এই কম্বুদ্বীপে
প্রকাশ্য প্রেমের সমস্ত রকম অভিব্যক্তি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এই ময়দানে বসেই অনেক মানুষ প্রশ্ন তুলছে, প্রেম
করা কি খারাপ?
বিকেল ৬-৫৮! সাতটা বাজতে আর মাত্র দু মিনিট বাকী। এক্ষুনিই কুশপুত্তলিকায় আগুন জ্বলবে। একটু পরেই দর্শকেরা
কোলাকুলি,
হ্যান্ডসেকের বদলে একজন অন্যজনের
পিঠে বা হাতের তালুতে ঘুসি মারতে মারতে, গালা গালি দিতে দিতে ঘরে ফিরে যাবে। এর পর কেউ কারো শরীরে ভালবাসার রঙিন আবীর মাখাতে পারবে না! কেউ কারোর দিকে চোখে চোখ মিলিয়ে হাসতে পারবে না। এর পর এমনটাই সরকারী নির্দেশ।
৬-৫৯ মিনিট! ঢাক ঢোল বন্ধ হোলো।
চার দিকে হঠাৎই নেমে এসেছে নিঃস্তব্ধতা। কাপড়, কাগজ ও
বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ দিয়ে বানানো কন্দর্পদেবের অতো সুন্দর মূর্তিটা এক্ষুনিই
আগুনে জ্বলে পুড়ে ভ্যানিস হয়ে যাবে! কিছু লোক কাঁদছে।
সাতটা বাজতে আর মাত্র তিন সেকেন্ড বাকী। জনতারা মেয়রের
নির্দেশে পিন-ড্রপ-সাইলেন্ট দাঁড়িয়ে আছে। থ্রী, টু, ওয়ান ...।
প্রেসিডেন্ট বোতাম টিপলেন। আগুনের গোলা! একটা
আগুনের বল এগিয়ে
যাচ্ছে একটা অনুভূমিক তার বেয়ে সামনে । এগিয়ে যাচ্ছে ত্রিশফুট উচু কন্দর্পদেবের সুসজ্জিত
কুশপুত্তলিকার দিকে! ওই তো আগুনের গোলাটা দেবতার বুকের ছাতি বরাবর ঢুকে যাচ্ছে!
মুহূর্তেই প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ। কানফাঠানো সে আওয়াজ!
দুনিয়া কেঁপে কেঁপে উঠছে!
কন্দর্পদেবের দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ছে!
কুশপুত্তলিকার ভেতরকার কাঠামো, বাশ, কঞ্চি পেরেকের টুকরোগুলো বুলেটের মতো এদিক ওদিক ছুটে যাচ্ছে।
মিলিটারি প্যারেড গ্রাউন্ডে উপস্থিত মানুষজন বুঝে উঠতে পারছে
না, হঠাৎ করে এ কি হয়ে গেলো।
আত্মরক্ষার জন্যে ভাগদৌড় শুরু হয়ে গেছে। বিশাল ময়দানটা যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্রের
চেহারা নিয়েছে!
অনেকের শরীর ক্ষত-বিক্ষত, রক্ত ঝরছে। চারদিকে আর্তনাদ।
পরবর্তী বিস্ফোরণের থেকে নিজেদের বাঁচাতে অনেকেই খোলা ময়দানে ঘাসের উপর শুয়ে
পড়েছে। একটু বেশী বয়েসীরা মাঠে বসে পড়েছে। একজন আরেক জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক একটা
করে বিস্ফোরণের শব্দ!
জমিতে শুয়ে থাকা এক রক্তাক্ত প্রেমিক যুগল। ছেলেটা মেয়েটাকে
চুমু খেতে খেতে বলছে – ‘জানি না আরো কতোগুলো বিস্ফোরণ হবে! জীবনটা তো কয়েকটা
মুহূর্তের। জানি না, একজন আরেকজনকে
আর কোনো দিন ভালোবাসতে পারবো কিনা।’
মেয়েটাও কেঁদে কেঁদে ছেলেটাকে চুমু খাচ্ছে আর বলছে –
‘তোমাকেও আমি খুব ভালোবাসি। আমাকে শেষ বারের মতো ভালোবাসতে দাও।’
###
কম্বুদ্বীপে সংঘটিত এই নৃশংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক
পরিষদের বিভিন্ন দেশগুলোর হুমকিতে কম্বুদ্বীপের প্রেসিডেন্টকে পদচ্যুত করতে বাধ্য করানো হয়েছে।
নিহত মানুষদের ক্ষতিপূরণ, আহত মানুষদের বিনামূল্য চিকিৎসা- আর্থিক অনুদান, নতুন প্রশাসনের নির্বাচনের মধ্য
দিয়ে কম্বুদ্বীপের অবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
তবে কম্বুদ্বীপের বর্তমান প্রশাসন লক্ষ
করছে আম-জনতার মধ্যে এক অস্বাভাবিক পরিবর্তন!
ছেলেরা আর মেয়েরা, ঘোষিত প্রেমিক যুগলেরা আগের চাইতেও আরো বেশী বেশী হাত
ধরাধরি করে রাস্তায় হাঁটছে। তারা আজকাল পার্কে আরো বেশী বেশী সময় কাটাচ্ছে। ‘প্রেম
চাই, ভালোবাসা চাই! ভালোবাসায় অবরোধকারীরা
নিপাত যাক! নিপাত যাক!’ সম্প্রতি ব্যানার নিয়ে বিশাল মিছিল করে কলেজের
ছাত্রছাত্রীরা রাজপথে বেরোচ্ছে - তাতেও প্রচুর জনসমাগম হয়েছে।
এরপরে কম্বুদ্বীপের কোনো প্রেসিডেন্ট প্রেমবিরোধী
সমাবেশের কথা আর
কখনো মাথাতেও আনেন
নি!
মিলিটারি প্যারেড গ্রাউন্ডের ১৪ই ফেব্রুয়ারীর সংঘটিত ঘটনাটির কয়েক বছর ধরে
তদন্ত চলেছিলো। কম্বুদ্বীপের কোন কোন আসামাজিক দুঃস্কৃতকারী এসব কাজ করতে পারে? এ
ব্যাপারে বিদেশী কোন জঙ্গী সংগঠনের হাত ছিল? প্রেমের দেবতা কন্দর্পদেবের শরীরে
কারা কখন কি ভাবে বোমা ঢুকিয়ে রেখেছিলো? কোনো ক্লু বা তদন্তপ্রমাণ না থাকার কারণে কম্বুদ্বীপের সরকারী গোয়েন্দারা
দীর্ঘসময় ধরে বিভ্রান্ত!
শেষপর্যন্ত সরকারী ভাবে কোনো সিদ্ধান্তে না আসা গেলেও,
বেসরকারী ভাবে একটা কথা দিকে দিকে হাওয়ায় ভাসছে – মানুষের উপর বেশী খবরদারী করার মতলবই হচ্ছে : চরম বিস্ফোরককে নিজের হাতে নিয়ে খেলা করা!
[ 03.08.2022 / R-3 / 1200 words
]
প্রকাশিত / শব্দসাঁকো -
শারদ সংখ্যা ১৪২৯

14ই ফেব্রুয়ারি প্রেম দিবসের প্রাক্কালে সমরেন্দ্র বাবু আপনার এই গল্প খুবই প্রাসঙ্গিক লাগলো। আপনি সুন্দর ভাবে মানুষের আবেগ ভালোবাসাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুশাসনের নিয়ন্ত্রণে এনে তার ভয়াবহ পরিণতির কথা এই রূপক গল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পের শেষ লাইনটি মন ছুঁয়ে গেল। সত্যিই কি আমরা তার শিকার হয়ে পড়ছি ক্রমশ?একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। ভালো লাগলো।🌹🌹 - বিশাখা দাস, কলকাতা।
ReplyDelete