খুঁজছি / সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 খুঁজছি

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

একটা গানকে আমি বিশ্বসংসারে তন্ন করে খুঁজছি

একটা গান – যা তুমি শুনিয়েছিলে

একটা গানকে খুঁজতে খুঁজতে আমি চলে গেছি

নীল আকাশে মেলা ধূ ধূ প্রান্তরে

জনহীন একটা নির্জন ক্ষেতে

যেখানে একদিন আমাকে তুমি শুনিয়েছিলে সেই গান

একটা গানকে খুঁজতে খুঁজতে চলে গেছি

পাহাড় আর জলপ্রপাতের কিনারে

হাওয়ায় হাওয়ায় যে গান জলকণার অভিমান,

আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল সে সব দিনগুলো

একটা গানকে খুঁজতে খুঁজতে চলে যাচ্ছি

রাত্তিরের সেই নির্জন বারান্দায়

একরাশ থকথকে রক্তে ভিজে উঠে

অপূর্ব বেদনায় একদিন তুমি শুনিয়েছিলে সেই গান

সেই গানটাকে খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেছি

শহরের রাজপথে, রিক্সার টুংটাং শব্দে

পথচারীর অরণ্যমায়ায়, রাত্রি নেমে আসা আকাশের নীচে

আমরা হাঁটছিলাম, তোমার পদশব্দে সেদিন বেজে উঠেছিল এই গানটাই

একটা গানকে খুঁজতে খুঁজতে আমি পৌঁছে গেছি

মেসোপটেমিয়ার প্রত্নশহরে, মহেঞ্জোদারোর শিলালিপিতে

পার্কসার্কাস কবরস্থানে, ছায়াফেলা গাছ গাছালির নীচে -

আমি শুনতে পাচ্ছি তোমার গান, অথচ ছুঁতে পারছি না

সেই গানটাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি পৌঁছে গেছি

ছত্তিশগড়ের জঙ্গলে, তোমার পাশে আমি

দেখলাম, গান গাইতে গাইতে তুমি গাড়ি ড্রাইভ করছো

তক্ষুনিই জঙ্গল ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো একদল সশস্ত্র আদিবাসী -

                 তুমি ওদের কানে কানে কি বললে

সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র মানুষগুলো অভিবাদন জানালো – কমরেড! কমরেড!

আমরা এগিয়ে গেলাম,

পেছনে ফেলে আসা তোমার সেই গানটা ভেসে চল্লো এক দেশ থেকে অন্য দেশে –

অথচ এখন দিনের পর দিন খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমার গাওয়া সেই গানটা

কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না!

একটা গানকে খুঁজতে খুঁজতে এখন আমি পৌঁছে গেছি

দিকশূন্যহীন সেই হ্রদের কিনারে,

চেঁচিয়ে বললাম, আমি শুনতে চাই সেই গান – কোনো সাড়াশব্দ নেই

শুধু কাঁপা কাঁপা হাওয়ার খিলানে একটা রাজপ্রাসাদ,

তার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তুমি হাসছো

তারপরেই দিকশূন্যপুরের সুনীল চক্রবালে ফুটে উঠলো একটা কোলাজ

সেই ক্যানভাসে ভেসে উঠলো এক অভিমানিনী সাম্রাজ্ঞী –

ঠোঁট ফুলিয়ে গলা কাঁপিয়ে মাথার খোপাটা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে

মেঘের আড়াল থেকে তুমি উচ্চস্বরে একটা গান গাইছো -

অথচ আমি কেন তা শুনতে পাচ্ছি না?

একটা গানকে খুঁজতে খুঁজতে আমি পৌঁছে গেছি নদীর কিনারে

ঘাটে বাঁধা আছে শ’খানেক নৌকা, পাশে মাছওয়ালাদের চিৎকার চ্যাঁচামেচি

নদীর বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে আসছে অজস্র স্মৃতি

ট্যুরের সাথী বান্ধবীদের থামিয়ে দিয়ে তুমি গেয়ে উঠলে সেই গান –

সবাই মুহূর্তের জন্যে স্থির দাঁড়িয়ে গেলো – কারোর মুখে কথা নেই

সেই গোলমালের মধ্যে দেখতে পেলাম

অদৃশ্য থেকে ইশারায় তুমি আমায় বলছো – এই গানটা শোনো

এইমাত্র আমি সন্তর্পনে সজাগ হয়ে কান পেতে রইলাম –

                কই এও কি মরীচিকা!

                  আমার সামনে কোনো গান নেই –

শুধু রিমঝিম বৃষ্টির গুমরে ওঠা কান্না।

একটা গানকে খুঁজতে খুঁজতে আমি পৌঁছে গেছি

ভবানীপুরের এক কমরেড বন্ধুর ড্যাম্প-পরা একতালায়,

দেখছি সেখানে বসে আছে বন্ধুবান্ধব আর আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম

বিড়ির ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঘরটা ফ্যাকাসে

তুমি ফুৎকারে ধোঁয়াগুলো উড়িয়ে দিয়ে

বিস্মৃতির ওপার থেকে গেয়ে উঠলে সেই গানটা –

অথচ আজ সন্ধ্যায় এমন কি হোলো, চারপাশে অন্ধকার,

আমি কেন কিছুই শুনতে পাচ্ছি না!

একটা গানকে খুঁজতে খুঁজতে আমি এখন অন্ধকারে হাঁটছি,

দেখতে পাচ্ছি অন্যায়ের প্রতিবাদে ভীষণ অভিমানে তুমি ফিরে যাচ্ছো

যেন এক্ষুনি বিশ্বসংসারকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে!

সেই আগুন নিভে গেলে যখন তুমি দেবীর মতো ফিরে এলে

তোমার উদাত্ত গলায় ভেসে বেড়ালো আমার প্রিয় সেই গানটা

ওই তো দেখতে পাচ্ছি, তোমার গানটা ধাক্কা খাচ্ছে তিনতালার কোয়াটারে

তোমার গান ভেঙ্গে ফেলছে শ্রীরামজীর সরু দেয়াল

তোমার গান মায়ের মমতায় দিগন্ত থেকে তুলে আনছে বাচ্চা সূর্যটাকে!

দেখতে পাচ্ছি, ঘরে ফিরতে ফিরতে তুমি দরাজ গলায় গাইছো সেই গানটা

অথচ আমি কি বয়রা হয়ে গেছি? কানে কালা?

              কেন শুনতে পাচ্ছি না সেই গান,

আমার চারপাশে শুধু অন্ধকারের কুয়াশা!

একটা গানকে কেবলই আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছি –

যে গানটা তুমি গাইতে, আর গাইতে গাইতে

যে গানের কথাটা তোমার দু’ঠোটের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়তো,

যে কথাগুলো গহ্বরের থেকে বেরিয়ে আসতো গমগম আগুনের মতো

যে গানের সুরেরা জ্বালিয়ে দিত লোহার গ্রীল, দরজা জানালা, সমস্ত বাঁধন

তারপর চরাচর টুকরো টুকরো দোল খেতো উদভ্রান্ত জোছনায়

দিন থেকে রাত্রি, মাটি থেকে আকাশ, সমুদ্র থেকে পর্বত

আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমার গাওয়া সেই গান,

অথচ গানের বদলে চারদিকে শুধু হাহাকার,

খুঁজে পাচ্ছি না চাঁদ আর সূর্যের সেইসব স্থিতিস্থাপক দিনগুলি!

আঝোর বৃষ্টি, প্রচন্ড স্পীডে অন্ধের মতো গাড়ি চালাতে চালাতে

আমি এখন খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমার গাওয়া সেই গান

তুমি হাসলে, কিছুক্ষণ কাঁদলে, তারপর গম্ভীর রাগে এম্নিই গান গাইলে

গাইতে গাইতে নিমেষেই জ্ঞান হারালে, গাইতে গাইতে তুমি অচেতন

তোমাকে গভীর ঘুম থেকে জাগিয়ে আনতে আমি অন্ধের মতো গাড়ি ছোটাচ্ছি,

তোমার সেই গানটা সেসময়ে কি ঝড়ঝঞ্ঝার গর্জনে নির্মূল হয়ে যাচ্ছিলো?

না, আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। কেন পাচ্ছিলাম না?

এই তো সেই গানটাকে খুঁজতে খুঁজতে

একটা ঝাপসা রাতের গাঢ় অন্ধকার শকটে আমি ছুটছি –

যদি সেই গানটা আবার ভেসে আসে, আমার পাশে তুমি –

অন্ধের মতো আমি ছুটছি

অথচ এখন কেন শুনতে পাচ্ছি না তোমার গাওয়া সেই গান?

আজ আমি এক্ষুনি কাছে পেতে চাইছি আমার প্রিয় সেই গানটা

যা তুমি গাইতে

যা শোনবার জন্যে আমি খুব জোর জবরদস্তি

আমরা দুজনে, আর কেউ নেই, তোমার গলা ততো ভালো নেই –

আমি চেঁচাতাম, গাও গাও প্লীজ, আর একটা বার

আমি উসকে দিতাম তোমার অগ্নিগর্ভ লাভা

ম্লান হেসে একসময়ে তুমি মুখ খুলতে

অর্গল খুলে বেরিয়ে আসতো আমার তুমি, আমার প্রিয় সেই গান

সেই মীড় আমাকে দূর দূরান্তে ভাসিয়ে নিতো  

তারই মূর্ছনা আমাকে ভরিয়ে দিতো সুখতপ্ত ক্লান্তিতে

সেই সুর আমার ভেতরে জাগাতো বোধিসত্ত্বের উচ্চারিত আলো

অথচ কতদিন সেই গান শুনি নি, কতো কতো দিন –

তাই এখন একটা গানকে খুঁজতে খুঁজতে আমি পাগলের মতো ছুটছি

সেই গানকে খুঁজতে গিয়ে আমি বসে আছি একাকী ঘরের অন্ধকারে

অরণ্যের নিস্তব্ধতায়, টিলা শীর্ষের মন্দিরে, নির্জন ফুলবাগানে

আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমার গাওয়া সেই গান

খুঁজছি খুঁজছি - অথচ দেখতে পাচ্ছি না, শুনতে পাচ্ছি না

আমি খুঁজে চলেছি আমার প্রিয় সেই গান

যেটা ভীড়-রাস্তার অ্যাম্বুলেন্স সাইরেনের সাথে ছুটতে ছুটতে সামনে যাচ্ছে,

যন্ত্রণার থাপ্পরে যে গানটা ফালা ফালা করে দিচ্ছে

মার্চমাসের একটা ভেন্টিলেটর রাতকে

তারপরেও আমি খুঁজে চলেছি সেই গানটাকে

যাকে গিলে খাচ্ছে হাই ভোল্টেজের অগ্নিশিখা

আমি খুঁজে চলেছি সেই গানটাকে

যেটাকে অভিমানে তুমি ভাসিয়ে দিয়েছিলে সীমাহীন দিগন্তে

খুঁজতে খুঁজতে আমি যেন পার করে যাচ্ছি মর্ত্য পৃথিবীর সীমারেখা

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে চিমনীর হালকা কালো কালো ধোঁয়া

দাক্ষিণদেশের এক টুকরো আকাশে জমাট বাঁধা শোকের কিউমুলাস মেঘ

একটা ন্যাংটো আকাশের অনন্ত শূণ্যতায়

আমি কি শুনতে পাচ্ছি আমার প্রিয় সেই গান?

এইমাত্র এইমাত্রই আমি শুনতে পেলাম

আমার প্রিয় গানটা তুমি দরদ দিয়ে গাইছো

আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি দীপ্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে আসছো

তুমিই মর্ণিওয়াক করছো পদ্ম-গজানো লাল সরোবরের কিনারায়

সমস্ত চরাচর তোমার সাথেই সাথেই গাইছে অনবদ্য আকুল সংগীত,

হৃৎপিন্ড মোড়ানো সংকেতে বেজে উঠছে আমার ভেতরকার কলকব্জা, অনুভূতি –

জানি এ বিশ্ব সংসারে কোনো কিছুই হারায় না, হারাও নি তুমিও

তবু তবুও আজ কেন সেই প্রিয় গানটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,

কেন কেন আমি তোমাকেও খুঁজছি?



[08.07.2024 / R-0/  Bhilai ]

প্রকাশিত – কথা , জুলাই- ডিসেম্বর ২০২৪ সংখ্যা।

Comments

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

হীরাকুদ, উৎপল সেন ও আমাদের অগ্রজেরা