আঁতুড়ঘর
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
#
আঁতুড়ঘরের
সামনে দাঁড়ালে গা শিরশির করে,
আঁতুড়ঘরের
দেয়ালে ঝুঁকে আছে প্রতিবন্ধী হাওয়া,
আঁতুড়ঘরের
মেঝেতে শুয়ে আছে একলক্ষ মা,
আঁতুড়ঘরে
একলক্ষ সন্তানেরা জন্মানোর অপেক্ষায়!
#
আঁতুড়ঘরে
কোন নার্সিংহোম নেই,
হস্পিটাল নেই,
অ্যাপ্রোন-পরা ময়ুরাক্ষী
নার্সেরা নেই,
প্রাচীন
পৃথিবীর ধাই-মা’র মতো এখানে আছে মমতাময়ী আলো
ভোরকে
ছিনিয়ে নেয়ার মতো
আছে
আলো-আঁধারির খেলা,
আছে
টুকরো টুকরো ব্লেড,
গরমজল, জীবানুনাশক তরল
আর
কিছু পরিষ্কার ন্যাকড়া।
#
আমাদের
মা রক্তস্রোতে ভেসে যাচ্ছে।
আঁতুড়ঘর
থেকে জন্ম নিচ্ছে ভারতবর্ষ;
আসাম
থেকে মহারাষ্ট্র,
কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা
আঁতুড়ঘরের
গুমটিগুলোর চারপাশে গোয়েন্দাদের চোখ,
আঁতুড়ঘরের
মধ্য থেকে ভেসে আসছে প্রসব-যন্ত্রণার আর্তস্বর,
এখানে
আলো হাওয়া জল-মৃত্তিকায় অধিকার উচ্চারিত হচ্ছে,
শোনা
যাচ্ছে নবজাতকের অস্ফুট কন্ঠস্বর!
#
আঁতুড়ঘরের
ভেতর একলক্ষ ধাত্রীর মমতাময়ী চোখ
আঁতুড়ঘরের
বাইরে লক্ষ লক্ষ সেবক সারিবদ্ধ
জঙ্গল
রাজত্বে বাঘের থাবার থেকে আঁতুড়ঘরকে বাঁচানোর
মরণপণ
করেছে তারা,
এই
সেবকেরাই দুর্দিনে নিয়ে আসবে জল গরমের কাঠ,
বেঁচে
থাকবার টুকিটাকি।
আঁতুড়ঘরের
বাইরে বুকের হৃৎপিন্ড হাতে নিয়ে
লক্ষ
লক্ষ সেবকের হৃদয়!
#
যে
কখনো জীবনকে সম্মানিত করে নি,
আঁতুড়ঘরে
সে তার প্রবেশাধিকার হারিয়েছে,
যে
অতিথি কোন না কোন সময়ে মানবিকতাকে
গুলিবিদ্ধ
করেছে,
আঁতুড়ঘরের
চৌহদ্দিতে তার প্রবেশ নিষেধ।
#
আঁতুড়ঘরের
মেঝেতে জীবনের অসহ্য যন্ত্রণা,
আঁতুড়ঘরের
খড়ো চালে অতর্কিত ঝড়ের ঝাপ্টা
আঁতুড়ঘরের
প্রসাধনহীন সময়ে বঞ্চনার শূন্য উদাসীনতা,
আঁতুড়ঘরের
ভাঙা কাঠামোয়,
বাঁচতে
চেয়েছিল যে মেয়েটি এবং বেঁচে উঠেছে যে মেয়েটি
তাদেরই
শক্ত প্রাণের সীমাহীন জেদ!
#
আঁতুড়ঘর
থেকেই জীবন,
যে
জীবন বাঁচবে,
ঘুরে দাঁড়াবে, লড়াইতে নামবে,
যে
জীবনের কিছু কিছু অসময়ে পঙ্গু হবে, অকালেই মরে যাবে;
তবু
জন্মানোর কি অপরিসীম নিষ্ঠা,
ধাই
মা’দের চোখে ঘুম নেই,
লক্ষ
পুরুষেরা আঁতুড়ঘরের বাইরে অনবরত টহল দিচ্ছে,
এই
আঁতুড়ঘরের মধ্য থেকেই জেগে উঠছে
জীবনের
লক্ষ লক্ষ কিশলয়।
#
যারা
সুসভ্য নাগরিক,
তারা আঁতুরঘরকে মোটেই
ভালো
চোখে দেখে না,
আমলারা
পাহারা বসায়-
আঁতুড়ঘর
মানে অসহ্য,
আঁতুড়ঘর
মানে ষড়যন্ত্র,
আঁতুড়ঘর মানে সন্ত্রাস!
#
নগরায়ণে
উন্নয়ণ হয়,
কিন্তু
সেই সব উন্নয়ণে আঁতুড়ঘরের স্থান নেই;
হাসপাতাল, মেটার্নিটি ওয়ার্ড, বিশ্বস্বাস্থ্য পর্যন্ত
আঁতুড়ঘরেরা
পৌঁছাতে পারে না।
অথচ
এই আঁতুড়ঘরের মধ্য দিয়েই জন্ম নেবার জন্য
আকাশে
গোত্তা মারছে লক্ষ লক্ষ স্বপ্ন!
#
স্বপ্ন
নির্মাণকে ডেকেছে,
গাছ
গাছালি লতাগুল্মের পথ মানুষকে ডেকেছে,
নদী, পাহাড়
আর আবহবিদ মানুষকে ডেকেছে,
চাঁদ, সূর্য
আর হাওয়ার সাথে মিলে মিশে
স্বপ্নের
মতো করে জীবনের আদলে তৈরী হয়েছে
এ
আঁতুড়ঘর।
#
কি
অসাধারণ তার সম্ভাবনা!
অসংখ্য
মেধা এখানে জন্ম নেবে,
অসংখ্য
লড়াকু এখানে জন্ম নেবে।
অসংখ্য
শ্রমজীবি এখানে জন্ম নেবে।
আঁতুড়ঘরের
ভেতরে এক লক্ষ মা যন্ত্রণায় চীৎকার করছে,
আঁতুড়ঘরের
ভেতরে এক লক্ষ নিবেদিত সেবিকা,
আঁতুড়ঘরের
বাইরে লক্ষ লক্ষ সেবক!
#
যখনই
বাইরে শুরু হয়েছে ঝড়ো হাওয়া,
তীক্ষ্ণ
বর্শার ফলকের মতো বৃষ্টি,
জঙ্গলের
ফাঁকে ওৎ পেতে বসে আছে চিতা বাঘ;
ঠিক
তখনই এই আঁতুড়ঘরের অভ্যন্তরে
জন্ম
নেবার জন্যে চীৎকার করে চলেছে-
আরো
একটা ভারতবর্ষ!
======= © biswas.samarendra@hotmail.com
Comments
Post a Comment