যন্ত্রণানগর
অনুগল্প
যন্ত্রণানগর
সমরেন্দ্র
বিশ্বাস
সেই কবে থেকে খুঁজছি !
খুঁজেই চলেছি। ভাঙাচোরা রাস্তায়, অন্ধগলিতে, ছাপরা ঝুঁকে পড়া মাটির বাড়ীতে, ভাঙা
কল-কারখানার পাশে পরিত্যক্ত বস্তিতে, শহরের বড় রেস্তোরায়, নামকরা সাহেবের কাছারি-বাড়ীতে।
আজও খুঁজছি। মাথার উপর একটা নীল আকাশ আর এক ধরনের বাসন্তী গন্ধের স্মৃতি আমাকে
মাতিয়ে বেড়াচ্ছে।
এখন একটা রেললাইনের উপর
আধাগজানো জঙ্গল আর মরে যাওয়া স্লিপারের উপর পা মেলে মেলে হেঁটে চলেছি। মেপে মেপে
পা। পরিত্যক্ত এই লাইনে কোন গাড়ী চলে না। সরীসৃপ ভয়। সাপের জিভ যে কোন মুহূর্তে
আমার দু’খানা পা চেটে দিতে পারে। অদূরেই
ঘেরা ষড়যন্ত্রের শহর; অধুনা পরিত্যক্ত; তবুও ক্রিয়াশীল।
হল্ট্! একটা জং ধরা
বোর্ড, ইংরেজী চারটে হরফে সাবধানী শব্দটা লেখা। রেল লাইনের আড়াআড়ি একটা লোহার গেট।
গেটটা অকেজো। এখান থেকে রেল লাইনটা একটা ঘেরা পরিসরে ঢুকে গেছে। এই পরিসরের নাম যন্ত্রণানগর।
বোর্ডে লেখা- হল্ট্!
থামবো কি করে? আমি তো খুঁজতেই বেরিয়েছি। সেই কতকাল ধরে। বললেই কি আর থামা যায়? আমি
উবু হয়ে বসে লেভেলক্রসিং মার্কা গেটটা পেরিয়ে এলাম। অনায়াসে ঢুকে গেলাম
যন্ত্রণানগরে। আমার পেছনে পড়ে রইলো লোহার টুকরোতে লেখা নির্মম শব্দটুকু – হল্ট্!
যন্ত্রণানগরের রঙ ধূসর।
সাপের গায়ের মতো। দুপাশে সারি সারি কুঠুরি। মাঝখান দিয়ে চলে
গেছে সৈন্যের জুতোর তলার মতো কালো, কাঁটা-মারা পাথরের রাস্তা। যন্ত্রণানগরের
ঘরগুলো পরিত্যক্ত। নিয়মিত ভাবে এখানে কেউ থাকে না। ঘরগুলোর ছোট্ট ঘুলঘুলির গায়ে
নাজি-আমলের বিষাক্ত গ্যাসের বাদামী আভা। স্বপ্নময় কিছু একটা খুঁজতে বেরিয়েছি।
সেজন্যেই ষড়যন্ত্র করে এই নাজি-নিপীড়িত যন্ত্রণানগরে প্রবেশ করতে কেউ কি আমাকে প্ররোচিত
করেছে? কুছ পরোয়া নেহী।
যন্ত্রণানগর আমার শরীরকে
বিষ-বর্ণ করে দিল। শরীর জুড়ে এক ধরণের অবসন্ন বিবশতা। আমি খুঁজতে লাগলাম। মাথার
উপর আমার জন্মের সময়কার নীল আকাশ, তাতে ছেটানো ফুলের মতো কতগুলো তারা যন্ত্রণায়
কাঁপছে। ডুম লাইটের মতো একটা চাঁদ সমস্ত যন্ত্রণানগরকে আলোকিত রেখেছে, বিষাদের
ম্লান আভা।
যন্ত্রণার অন্ধকারে
ঠোক্কর খেতে খেতে আমি দেখতে পেলাম একটা হাল্কা ছায়া, সে কি মায়া, না কি মতিভ্রম। বিবশ চাঁদের আলো। অদ্ভুত একটা স্মৃতিময় গন্ধ
আমাকে চিনিয়ে দিল তাকে। একটা অব্যবহৃত ভাষ্কর্যের মত আমার প্রেম পাথরে একা একা বসে
আছে। অবিশ্বাস্য! আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।
যন্ত্রণানগরে আমি সংযুক্তাকে
খুঁজে পেলাম। নিমেষেই সমস্ত আকাশ, চাঁদ আর তারাগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে আমাদের মাথায় শরীরে
ছড়িয়ে পড়লো। ভুলে গেলাম পেছনে
ফেলে আসা মড়ার খুলি, সাবধান চিহ্নিত সেই আড়াআড়ি লেভেল-ক্রসিং মার্কা নিষিদ্ধ গেট।
হঠাৎ জমিন ফুঁড়ে উড়ে এলো
একটা কালো শকট। শকটের যাত্রীদের কালো কালো জহ্লাদ পোষাক; সঙ্গীন তাদের অস্ত্র।
আমাদের দিকে তাক্ করা ডবল বোরের রাইফেল।
পৃথিবীর সমস্ত প্রেম,
সমস্ত বিষন্নতা, সমস্ত সৌন্দর্য নিমেষেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। কালো সন্ত্রাস নির্মম
থাবা উঁচিয়ে আমাদের দিকে ছুটে এলো। আমরা দৌড়ে পালাতে গেলাম। আমি আর আমার স্বপ্ন -
ছুটছি ছুটছি ! নাৎসী অধিকৃত যন্ত্রণানগরে আমাদের পেছন পেছন ভেসে এল জহ্লাদদের তীক্ষ্ণ
কন্ঠস্বর – হল্ট্!
[ প্রকাশিত – ঋতবাক ]
Comments
Post a Comment