আমিনুলের দিন

 

অনুগল্প

# আমিনুলের দিন #

সমরেন্দ্র বিশ্বাস

গেরুয়া রঙের বিশাল মঞ্চলোকজনদের জন্যে বিশাল বিশাল সামিয়ানা, তাতেও গেরুয়া রঙের আচ্ছাদনপ্রত্যেকটা সামিয়ানার ভেতর বড় বড় এলইডি-টিভির ব্যবস্থা দু’ঘন্টার ব্যাপক রাজকীয় সমাবেশ। রাস্তার দুধারে গাছের সবুজগুলোকে ঢেকে দেয়ার জন্যে অগুন্তি নিশানের গৈরিক চিহ্ণ মোতায়েন রয়েছে অসংখ্য ভলান্টিয়ার, উর্দি পরা নিরাপত্তা কর্মীদের দল। ল্যাম্পপোষ্টের প্লাকার্ডে লটকে আছে নেতাদের ছোটো বড়ো চেহারা। দম বন্ধ করা ভীড়, এই একটু আগেই ভাষণ চলার সময়ে এলইডির পর্দায় ভেসে আসছিল লম্বা জোব্বা পরিহিত এক রাষ্ট্রনায়কের বিশাল চেহারা, তার প্রতিশ্রুতিময় আশীর্বাদ বানী! এই যে দু’ঘন্টার মিটিং শেষ হলো, এর জন্যে রাজ্য জুড়ে চলছে চার সপ্তাহের প্রশাসনিক প্রস্তুতি। আপাতত এই মিটিং শেষ।

সমাবেশ শেষ হতেই মন্ডপ ছেড়ে একে একে ফিরে যাচ্ছে ক্যাডার, শ্রোতা, সাধারণ পাবলিকের দলফিরে যাচ্ছে দূর দূরান্ত থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা মানুষজন। যারা যারা মিটিং-এ এসেছিলো তাদের সবাইকে ধরিয়ে দেয়া হয়েছিলো বিজ্ঞাপন আঁকা সুদৃশ্য গেরুয়া টুপি, নানা কিসিমের রঙ্গীন দিনের লিফলেট। তাই এখন যারা ফিরে যাচ্ছে, তাদের সবারই মাথায় টুপি! রাস্তায় গেরুয়া টুপির স্রোত।

ফিরছে আমিনুলও, নতুন দিনের লিফলেটটা ওর বুক পকেটে গোঁজা, এই দাদনের দিনেও ওর হতাশাময় বিকেল। আমিনুলেরা থাকে একটা গাঁয়ে - প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে। কয়েকদিন ধরে ওর তেমনকিছু রোজগারপাতি হয় নি। কেউ বলেছিল মিটিংএ গেলে খাওয়া আর ষাটটা টাকা মিলবে। দূর গ্রামের রাস্তা থেকে এই লোকটাকেও ট্রাকে ভরে গোরু মোষের মতো এখানে নিয়ে এসেছিলো এক দালালরাজকীয় মিটিংএর শেষে খাবার প্যাকেটটা তো মিলেছে, কিন্তু টাকা দেবে বলেছিলো যে লোকটা, তার দেখা নেই। ফাঁফা পকেটে মিটিং-ফেরত ওর শরীরটায় একটা বিমারী জিন ভর করেভীড়ের মধ্যে খুঁজতে থাকে দালালটাকে, আর খোঁজে সেই ট্রাকটাকে যেটায় করে সকালবেলায় ওরা এখানে এসে পৌঁছেছিল মিটিং শেষের উত্তাল ভীড়, এখন এখানে তার নিজেকে একটা অবাঞ্ছিত মানুষ মনে হয়।

‘শালা ঠগবাজের দল!’- চেঁচানোটা কি জোরে হয়েছিলো? মুখ ভর্তি সূচালু দাঁড়ি, বিরক্তিকর মুখনিজের মাথার গেরুয়া টুপিটাকে খেলার বলের মতো করে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিল সে, আবার সেটাকেই ক্যাচ করে লুফে নিল, একটা পাগল পাগল খেলা! এই ভীড়ের মধ্যেই একটা অদ্ভূত দৃশ্যঅনেকেরই নজর ওর দিকেআমিনুল আবার ব্রহ্মনাদে চেঁচিয়ে ওঠে – ‘আমার দিনভরের মজুরী ষাটটা টাকা হাবিশ করে দিল রে! শালা ঠগবাজ কোথাকার!’ 

সূচালো দাঁড়ি ওর মুসলমানী চেহারায় কিছু কি বিশেষত্ব ছিল? অনেকক্ষন ধরে আমিনুলকে কিছু লোক সন্দেহের চোখে দেখছিল। মুখ থেকে চ্যাঁচানি বেরুতেই লোকগুলো ওকে ঘিরে ধরে। -‘শালা কাটুয়া! এখানে ঝামেলা পাকাতে এসেছিস!’

কথায় কথা বাড়ে। বিজ্ঞাপন আঁকা গেরুয়া টুপিটা বলের মতো আকাশে ছোঁড়া? এটা তো এই সমাবেশের অপমান! আচমকাই জনা তিনেক লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে আমিনুলের উপর। হঠাৎই শুরু হয় ধোলাই। আক্রান্ত আমিনুল পড়ে থাকে মাটিতে।

গনধোলাই বেশী এগোনোর আগেই সৎ বুদ্ধির কয়েকজন ওকে তুলে দেয় পুলিশের হাতে ......! ততক্ষণে মার খেয়ে হাত পা ছড়ে গেছে, গালে রক্তের ছোপ!

এই ঘটনার ঘন্টা খানেক পরে আমিনুলকে নিয়ে জীপগাড়ী ছোটে থানার দিকে। রাজকীয় সমাবেশে শান্তি ভঙ্গের জন্যে ওকে কি শোধনাগারে পাঠানো হবে?

রাস্তায় যেতে যেতে আমিনুল ঘাড় কাত করে দেখে এই রাজকীয় সমাবেশের কারণে সামনের কালো পীচের রাস্তাগুলোকেও কারা যেন গেরুয়া রঙ দিয়ে লেপে গেছে।

রাজকীয় জমায়েতে দাঙ্গা বাঁধানো – আপাততঃ এই মিথ্যা অভিযোগে বেচারা আমিনুল এখন আটকে আছে থানার লকআপে! ঠিক সেই মুহূর্তেই আমিনুলের ঘরে দানাপানির অপেক্ষায় হা পিত্যেশ করে বসে আছে একটা ধর্মহীন বর্ণহীন শতছিন্ন ক্ষুধার্ত পরিবার। সামনের এঁদো পুকুরের মরা জলে জঞ্জাল শ্যাওলা কচুরীপানা, তারই মাঝে তখন ঠ্যাং ডুবিয়ে মুন্ডু উঁচিয়ে দাদাগিরি করছে গোটা কয়েক বিশিষ্ট পদ্মফুল!

Rev.- 4

[Published ‘আহ্নিক’ January-2019. Subsequently minor editing done on 14.02.2019 ]

Comments

Popular posts from this blog

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

কামিনের জন্যে কবিতা

হীরাকুদ, উৎপল সেন ও আমাদের অগ্রজেরা