নেলসনের হাসি
অনুগল্প #
নেলসনের হাসি
#
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
#
চওড়া রাস্তাটা নদীর ধার ঘেঁসে চলে
গেছে। রাস্তার একপাশে কালো কুচকুচে নাক-চ্যাপ্টা লোকটা ডুগডুগি বাজিয়ে লোকেদের নজর
কাড়ছিল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হাঁকছিলো – ‘বাবুরা, মা-রা - এই নদীর কিনারে নেলসনের উঁচা
মূর্তি বসবেক ! নেলসনের বহুৎ উঁচা মূর্তি!”
পাশেই বয়ে যাচ্ছে নর্মদার চওড়া
জলস্রোত। ব্যস্ত রাস্তা, ট্রাক, বাস, ট্যাক্সি, লোকজন, দোকানপাট। কোথাও কোথাও
রাস্তার কিনারটা ফাঁকা, গাছপালা, খোলা ফুটপাথ। দু চারটে গজিয়ে ওঠা অস্থায়ী ঝুপড়ি।
ওই ব্যস্ত রাস্তাটা দিয়েই পায়ে হেঁটে যাচ্ছি, হঠাৎ নজরে এলো ডুগডুগি বাজানো লোকটার
চ্যাঁচানি। বর্ণ-বৈষম্য আর দারিদ্রের দেশ পেরিয়ে কানে এসে বিদ্ধ হলো সাদা-কালো
কথাগুলো -“নেলসনের বহুৎ উঁচা মূর্তি!”
লোকটা
ভিখারি গোছের। সামনেই অস্থায়ী ঝুপড়ি, ভবঘুরেদের আস্তানা যেমন হয় –
তবে নিকানো গোছানো। ঝুপড়ির সামনে, রাস্তার কিনারেই কালো পলিথিনের আসন পাতা। তিন চারটে আলগা পাঁজা করে রাখা ইঁটে
হেলান দিয়ে রাখা একটা ফটোফ্রেমে ভারতমাতার মূর্তি। ফটোটার সামনে বড়ো স্টীলের থালা। সেখানে দু-তিনটে নোট, বেশ কিছু
খুচরো পয়সা।
লোকটা ডুগডুগি বাজিয়ে চলছে, মাঝে
বাজনা থামিয়ে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মানুষগুলোর দিকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হাঁকছে –
“বাবুরা, মা’রা! আপনারা কিছু কিছু ভিক্কখা দিয়ে যাবেন! ভারতমাতার কিরা! আপনাদের
দানে এই নদীর কিনারে নেলসনের মূর্তি বসবে গো!”
ডুগডুগির শব্দ আর লোকটার নাটকীয়
সম্ভাষনে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। ঝুপড়ির খুটিতে ঠেক দেয়া একটা টিনের সাইনবোর্ড! তাতে
আঁকাবাকা হরফে লেখানো হয়েছে - ‘নেলসন-মূর্তি নির্মান সহায়তা ফান্ড। মুক্ত হস্তে
দান করুন।’ দারুণ বিজনেস বুদ্ধি!
লোকটা আমার দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখেই একটা
পেন্নাম ঠুকলো। কালো থোবরায় সাদা দাঁতগুলো বেরিয়ে এলো, সঙ্গে একটা
প্রাগৈতিহাসিক হাসি। ভিক্ষার থালাটা জমির থেকে তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। ফটো সাজিয়ে, লোকটা
ভারতমাতার দিব্যি খেয়ে অনুদান চাইছে। তাও আবার একটা অদ্ভুত উদ্দেশ্যে। আমি অবাক
হলাম। নর্মদা নদীর কিনারে ও নাকি বর্ণ-বৈষম্য আর নিগ্রোদের নেতা ‘নেলসন’এর একটা লম্বা
উঁচু মূর্তি বসাবে!
নেলসন ম্যান্ডেলা ! অসহায় মানবাত্মার সাথী। আফ্রিকার
নিগ্রো আন্দোলন! নেলসনের বিশাল মূর্তি? সেটা কত ফুট উঁচু হবে? সেসব তো অনেক খরচার
ব্যাপার। লোকটা তো একটা ফুটপাথের ভিখিরি – তাও কোন ব্যবসায়ী বা মিনিষ্টার
টিনিষ্টার হলে কথা ছিল! এটা নিশ্চয়ই একটা আধ-পাগলা!
কিছুটা করুণা করেই লোকটাকে জিজ্ঞেস
করলাম – “তোমার উদেশ্যটা ভীষণ ভালো, তুমি নেলসনের একটা বিশাল মূর্তি গড়বে। কিন্তু
এসবে তো বহুৎ খরচাপাতির ব্যাপার! দেখছি একটা সাইনবোর্ডও লাগিয়ে রেখেছো,
নেলসন-ফান্ড! এসব তোমার ভিক্ষা চাইবার ধান্ধাবাজি নয় তো?” থালাতে দশ টাকার একটা নোট
এগিয়ে দিলাম। লোকটা খুশী হয়ে খিল খিল করে হাসির মাত্রাটা দ্বিগুন বাড়িয়ে দিল।
বললো -“ঝুট বলবো না, বাবু! আপনাদের
কিরা, ভগমানের কিরা। মিথ্যা বিলকুল বলছি না। এই থালায় যে পয়সা পাই, তার
সামান্য কিছু আমার খানাপিনার জন্যে রাখি। বাকীটা জমাই। এখন পর্যন্ত আমার কাছে
পাঁচহাজার তিনশো টাকা জমা হয়েছে। ধীরে ধীরে সেটা জমতে জমতে যখন অনেক হবে, তখন লোকজন
ডেকে উঁচা স্বপ্নের লাহান সেই লোহার মূর্তিটা বানাবো”।
মাঝ-বয়েসি মানুষটাকে এবার জিজ্ঞেস
করলাম- “তা বাবাজী, তুমি যে বলছো নেলসনের মূর্তি বানাবে, তা এই নেলসন লোকটা কে?
নেলসনকে তুমি কি কখনো দেখেছো?”
“সে কি বলেন যে বাবু! নিজেকে কি
নিজের কখনো দেকতে লাগে? বাবু, আমিই তো নেলসন। এই আমার হাত, এই আমার পা, এই আমার
মাথা! আমার নাম - নেলসন হেমব্রম, জাতি- সাঁওতাল, সাকিন- বীরভূম। ভিটা থেকে উৎখাত
হয়েচি বটে, আমাদের গ্রামে বিজলির নতুন কারখানা হয়েচে। তখন খেত-মজুর ছিলাম, এখন
ভিকারি; আজকাল নর্মদা-নদীই আমার মা, এই রাস্তার কিনারাতেই থাকি!”
লোকটার দিকে বড় বড় চোখে তাকালাম। ও
বলে চল্লো- “খোরাকির ধান্ধায় এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, দেকলাম এই নদীর কিনারে কি
বিরাট একটা মূর্তি তৈরী হচ্ছে, বাপ রে বাপ – আসমান সমান উঁচা! তখনও কাজ চলছিলো।
ওখানে অল্প কিছু দিন ঠিকা মজদুরির কাজ মিললো; মাটি কাটা, মাল বওয়ার কাজ। কিছুদিন বাদে কাজ আর মিললো না। ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে এলাম, এই জায়গাটা কিন্তু
বেশ ভালো। তাই এখানেই নদীর কিনারে ঝুপড়ি লাগিয়ে বসে গেলাম!”
লোকটার মুখে আবার সেই নিশ্চিন্তি শিশুসুলভ
হাসি!- “অনেক দিন থেকেই আমার স্বপ্ন, আহা! আমার নিজেরও একটা আকাশ ছোঁয়া মূর্তি হোক! বাচ্চাকালে গ্রামের মাস্টারটা আমাকে
বলতো
- ‘নেইলসন! তুঁ অ্যানেক বড়ো হবি – অ্যানেক লুকে তুকে
চিনবেক!’ হেঁ হেঁ !”
লোকটা বলে চলল,- “তাই তো এখনো আমার
খুব ইচ্ছে - আমার একটা বিশাল
চেহারা আসমান ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকুক এই নদীর কিনারে। অনেক ঝড়, অনেক উলগুলান পেরিয়ে-
অনেক অনেক বছর, আমার মূর্তি এখানে থাকবে। আমি দাঁড়িয়ে থাকবো এই নদীর কিনারে।
লোকেরা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বলবে – ‘দ্যাখ! দ্যাখ! উঁ নেইলসন বহুৎ বড়ো বাপের
বিটা ছিলো রে!’”
পাগল মানুষ একটা! আমাকে নিজের কাজ
আছে, সামনের দিকে হাঁটা লাগালাম।
এদিকে সড়ক কিনারে ডুগডুগি বাজিয়ে ওই
লোকটা তখনো খিল খিল করে হাসছিল! চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল – ‘ভারতমাতার কিরা! আপনারা
বাবুরা দিল খুলে সাহায্য করুন! নেলসনের মূর্তি হবে! সাহায্য করুন! দু চার টাকা
দিয়ে যান!’
এখান থেকে বেশ কিছু কিলোমিটার
দূরে, নর্মদা নদীর কিনারে, আকাশ-ছোঁয়া সুউচ্চ একটা বিখ্যাত মূর্তি- স্ট্যাচু অফ
ইউনিটি, দর্শক পরিবেষ্টিত, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল! সামান্য বাতাস সেদিকেই
ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আদিবাসী লোকটার আওয়াজ আর হাসি! বীরভূমবাসী কোন এক নেলসনের
অদ্ভুত স্বপ্নকথা, সশব্দ ডুগডুগির আওয়াজ শুনে সম্মানীয় সেই স্ট্যাচুটি সেই
মুহূর্তে প্রচন্ড ভাবগম্ভীর হয়ে উঠলো! হঠাৎই থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়লো পশ্চিমবাহিনী
নর্মদা নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যাবতীয় হাওয়া , থেমে গেলো এ সময়ের ভেসে বেড়ানো সমস্ত
দেশজ শ্লোগান আর দিনরাতের কোলাহল!
[ ‘MANAN’ –
January- May-2020]
Comments
Post a Comment