তিন-আঙ্গুলের খেল

 

ছোটগল্প

তিন-আঙ্গুলের খেল

সমরেন্দ্র বিশ্বাস


চারদিকে এন আর সি-র হুজ্জোত চলছে অফিস থেকে ফিরে মানসিক ভাবে খুব ক্লান্ত ছিল তাই মিত্রসাহেব তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল

মাঝরাতে কি একটা শব্দে মিত্রসাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেল বেড সুইচে টিপে ডিম লাইটটা জ্বেলে বিছানায় উঠে বসলো শব্দটা আর নেই একটু জল খেয়ে আবার শুতে যাবে, তখনই মনে হলো কাটা আঙ্গুলের মতো কিছু একটা ঘরের মেঝেতে লেথরে লেথরে যাচ্ছে

মিত্রসাহেব চোখ খুলে জরিপ করতে চেষ্টা করলো ওর মনে হলো মেঝেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তিনটে রক্তাক্ত আঙ্গুল -  মধ্যমা, তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলি!

চমকে উঠলো হাই অফিসিয়াল শম্ভুদেব মিত্র আজকেই দুপুরে জরুরী একটা মিটিং সেরে নিজের অফিসে ফিরছিল দিল্লীর রাস্তায় গাড়ী ছুটছিল দূর থেকে নজরে এলো একটা জায়গায় লোকজনদের ভীড় ড্রাইভার স্পীড কমিয়ে দিল সাহেব গাড়ীটাকে দাঁড়া করাতে বললো ড্রাইভার আর মিত্রসাহেব দুজনে ভীড়ের মধ্য দিয়ে একটু উঁকি ঝুঁকি দিল রাস্তার কিনারে একটা লাশ পড়ে আছে রক্তে চারপাশ ভেসে গেছে ডানহাতটা বুকের উপর আশ্চর্যের ব্যাপার, ডানহাত থেকে কে বা কারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে নিয়েছে লোকটার তিনটে আঙ্গুলমধ্যমা, তর্জনী, বৃদ্ধাঙ্গুলি!

এই রাত্রে চুরি হয়ে যাওয়া সেই আঙ্গুলগুলোই কি উঠে এসেছে শম্ভুদেব মিত্রর কামরায়!

বিছানায় বসে সুইচে হাতটা লাগাতেই জ্বলে উঠলো ঘরের জোরালো টিউব লাইট সমস্ত ঘরটা ফকফকে পরিষ্কার পালঙ্কের ধারে নীচটায় রাখা ওর নিজের পায়ের চপ্পল, পাপোশ আর মিলটনের জলের বোতলটা! কিচ্ছুই নেই মিত্রসাহেব তখন বিছানায় বসে বাহাতের মুঠো দিয়ে নিজের ডানহাতের তিনটে আঙ্গুলকে চেপে ধরলো ওর নিজের তিনটে আঙ্গুল হাতের পাতার সাথে ঠিকঠাকই তো জোড়া আছে! ও কি ভুল স্বপ্ন দেখছিল? লাইটগুলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেই ওর মগজে উঠে আসতে লাগলো ফেলে আসা দিনটা! শুয়ে শুয়ে মিত্রসাহেব ভাবতে লাগলো 

 

#

লোকটাকে এমন করে মেরে রাস্তায় কেন ফেলে রেখেছিল? কে বা কারা?

রাজধানীর রাস্তাঘাটের অবস্থা মোটেই ভালো নাএদিকে ওদিকে এন আর সি-র জমায়েত চলছেনাগরিক-পঞ্জী সংক্রান্ত আইনের বিরোধিতায় কলেজ স্টুডেন্টরা রাস্তায় নেমেছেঅন্যদিকে পার্টির ব্যাজ পরে এই আইনের স্বপক্ষে নেমেছে কিছু দাদা মার্কা টাইপের মস্তান; পুলিশের সামনে খোলা পিস্তল নিয়ে লোকজন বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেএদিক ওদিকে দাঙ্গা! এন আর সি-র মিছিলের উপর হামলাইতিমধ্যে কয়েকটা লাশও পড়ে গেছে! এসব কিছু শম্ভুদেব মিত্রর দৈনন্দিন জীবনে আজকাল অতি পরিচিত ঘটনা

কিন্তু দুপুর বেলার সেই দৃশ্যটা! ওই নিরপরাধ মার্কা লোকটা! কে বা কারা মেরে ফেলে রেখে গেছিলো? দিনদুপুরে শহরের ওরকম একটা ব্যস্ত-সমস্ত রাস্তায়এমন বীভৎসভাবে! কোন উল্লাসে  কেটে নেয়া হয়েছিল লোকটার ডান হাতের তিন তিনটে আঙ্গুল! লোকটা কি নাগরিক-পঞ্জী বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিল?

ওরা ওই ভীড়ের মধ্যে বেশীক্ষণ দাঁড়ায় নিওদের জন্যে সেটা যুক্তিযুক্তও নয়চট জলদি জটলা থেকে বেরিয়ে এলোমাঝপথে এভাবে দাঁড়ানোটা নেহাৎই একটা ক্ষনিকের মানবিক কৌতূহল!

রাস্তায় ফিরতে ফিরতে ড্রাইভার রামবিলাস মিত্রসাহেবকে বলছিল, ‘স্যার! এসব পাবলিকের ঝুট ঝামেলায় বেশীক্ষণ না থাকাই ভালোআজকাল দিনকাল একদম ভালো না!’

একটা মানুষকে মেরে ফেলার পর এরকম তিনটে আঙ্গুল কেটে নেয়ার পেছনে কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?’

রামবিলাস ড্রাইভারের সীটে সাহেবের প্রশ্নের উত্তর ভেসে এলো, ‘সেটাই তো মাথায় ঢুকছে না লোকটার উপরে কারো হয়তো রাগ ছিল প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কেউ হয়তো ডান হাতের আঙ্গুল তিনটেই কেটে নিয়েছে!’

ফেলে আসা দিনটা গাড়ীতে ফিরতে ফিরতে শম্ভুদেব মিত্রর মাথায় তখন নানান চিন্তা অফিসে ফিরে একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং দুপুরেই ফোনটা এসেছিল একটা কমপ্লিকেটেড ফাইলকে আর্জেন্টলি ক্লিয়ার করতে হবে বড়ো ঝামেলার চাকরী!

শুয়ে শুয়ে মিত্রসাহেব ভাবছে বিগত দিনটার কিছুঘন্টার কিসসা কাহিনী দুপুরে রাস্তায় দেখা সেই নৃশংস দৃশ্যটা! মানুষ কেন মানুষের আঙ্গুল কেটে নেবে? খুন তো আকছারই হচ্ছে! কিন্তু আঙ্গুলগুলো কি কারো শত্রু হতে পারে?  ওগুলো কি কোন অস্ত্রের চাইতেও মারাত্মক?

#

 

এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মিত্রসাহেব কখন আবার ঘুমিয়ে পড়লোবন্ধ কামরার এয়ার-কন্ডিশনারের মৃদু হাওয়া, সাহেবের নিঃশ্বাস জনিত শব্দ

    রাত তখন সাড়ে তিনটে শম্ভুদেব মিত্র ঘুমের মধ্যে আবার স্পষ্ট দেখতে পেলো রক্তাক্ত আঙ্গুলগুলো কিছুক্ষন আগের ঘুম ভেঙ্গে দেখা সেই দৃশ্যটা - মধ্যমা, তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলি! ওগুলো মেঝেতে আবার ঘুরে বেড়াচ্ছে! স্পষ্ট শুনতে পেলো, আঙ্গুলগুলো নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে

রক্তমাখা তর্জনীটা বলছিল - ভাগ্যিস আমরা  জনতার আঙ্গুল-ব্যাঙ্ক থেকে পালিয়ে এসেছি! আজকাল মুদ্রা ব্যাঙ্কের সাথে সাথে গোপনে গোপনে আঙ্গুল-ব্যাঙ্ক এর অসাধু কাজ-কারবার চলছে!

ঘুমের মধ্যে মিত্রসাহেব ভাবতে বসলো, - কি উদ্ভট কথা! ভোট ব্যাঙ্কের কথা শুনেছি! তর্জনীটা কিসব বলছে? আজীব কোনো আঙ্গুল ব্যাঙ্কের কাহিনী

ঘুমন্ত মিত্রসাহেবের তোয়াক্কা না করে মেঝেতে লেতরে লেতরে চলা বৃদ্ধাঙ্গুলিটা বলে উঠল হায় কলিকাল! আজকাল চোরেরা আঙ্গুল চুরি করে সেগুলোকে রসায়ণাগারে সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করছে

 মিত্র সাহেব দেখলো, কর্তিত মধ্যমাটির এক প্রান্তে নখ, অন্য প্রান্তে থলথলে তাজা রক্ত-মাংস অথচ সেটা কেমন জ্যান্ত

মধ্যমা-অঙ্গুলিটা অনায়াসে এই অন্ধকারে তার নিজের কথা বলে যাচ্ছে - ব্যাঙ্ক-কম্পিউটরে আর আধার কার্ডের সংরক্ষিত ছাপটা আমিই, আমার শরীরটা! দাঙ্গায় মানুষ নিহত হয়  সেই খুন হয়ে যাওয়া মানুষটার বায়োমেট্রিক ছাপ সঙ্গে নিয়ে আমি কেমন নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছি!

মিত্র সাহেব ঘুমের মধ্যে হাসতে লাগলো - পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়!

হাই অফিসিয়াল একজন জলজ্যান্ত সুস্থ শক্তিমান মানুষ পালঙ্কে ঘুমোচ্ছে তবুও ঘুমন্ত মানুষটার উপস্থিতিকে উপেক্ষা করে কাটা আঙ্গুল তিনটে তাদের কনফরেন্স চালিয়ে যাচ্ছে! ওদের কথা থামছে না

বিচ্ছিন্ন বৃদ্ধাঙ্গুলিটা বলছে আমার সঙ্গে আছে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলবার থাম্ব ইম্প্রেশন! ইচ্ছে করলেই নিজেকে ব্যবহার করে লাখ লাখ টাকার জোগাড় করে ফেলতে পারি!

অফিসে চাপরাশিকে ধমকানোর মতো করে ঘুমের মধ্যে মিত্রসাহেব বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলো,- ইডিয়েট কাহাকা! গেট আউট ফ্রম মাই রুম!

কাউকে পাত্তা না দিয়ে রক্তমাখা তর্জনীটা নিজের মনেই ফিস ফিস করে হাসছে আর বলছে   আমার সাথে আছে বায়োমেট্রিক ছাপ, আর সেই নখটা ইলেকশনের সময়ে এই নখে ভোটের কালি লাগানো যায়! মার্কেটপ্রাইস আমার মোটেই খারাপ না!

এদের কথাবার্তায় বিরক্ত হয়ে মিত্রসাহেব ভাবলো একটা বেলচা দিয়ে আঙ্গুলগুলোকে তুলে তার পুরোনো একটা ব্রীফকেসের মধ্যে রাখবে আঙ্গুলগুলোকে কাল ব্রীজটার উপর দিয়ে যেতে যেতে যমুনা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেই ল্যাঠা খতম

একটা সুসজ্জিত বন্ধ অ্যাপার্টমেন্ট দেয়ালের ডিজিটাল ঘড়িটার আলোকিত সংকেত মিত্রসাহেবের ঘুমন্ত রাতটাকে ভোরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো

#

 

পরদিন রোববার অফিসছুটির দিন রাতে ভালো ঘুম না হওয়াতে পরদিন দেরী করে মিত্রসাহেবের ঘুম ভাঙ্গলো তাও একটা জরুরী ফোন এসেছিল

এই সকালে তার মনটা কেমন কেমন করতে লাগলো দেশে কি সত্যি সত্যি ব্যক্তিগত কারচুপির মামলা চরমে উঠেছে? বায়োমেট্রিক ছাপের কারচুপির মামলা সত্যি কি সম্ভব? আঙ্গুল তিনটে রাতে কি সব কথা বলছিল! নাঃ, ওসব তো স্বপ্ন!

মনে পড়ল কয়েকমাস আগেকার কথা! অফিসের টেবিলে একটা টাইপ করা আদেশপত্রের খসড়া সে স্টাডি করছিলযারা দেশের বিভিন্ন ইস্যুগুলো নিয়ে তড়পাচ্ছে, যারা এ দেশে ঘুসপেটিয়া, যাদের কাছে ঠিকঠাক কাগজপত্র নেই, যারা রাস্তাঘাট আটকে বেআইনী মিটিং মিছিল করবেঠিক করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে ব্যবস্থা নেয়া হবে এটাও একটা প্রশাসনিক নির্দেশখসড়াটা তার হাত হয়ে আরো উঁচুতলায় যাবে

 সেদিন মিত্রসাহেবের অফিসে টেবিলের উপরেই একটা ফাইলে রাখা ছিল কাগজটা তিন আঙ্গুলের ফাঁকে নিজের কলমটা বেশ শক্ত করেই আঁকড়ে রেখেছিল মিত্রসাহেবমধ্যমা, তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলি - এগুলোকে যথাযথ ভাবে সেদিন সে ব্যবহার করেছিল মিত্রসাহেব নিজের অফিসিয়াল কর্তব্য পালন করেছিল সেই আদেশপত্রের খসড়ায় অনায়াসেই ডান হাতের কলমে তার সইটা হয়েছিল তখনো বোঝে নি, এই আদেশপত্র শীঘ্রই কানুন হয়ে যাবে তাতে পাড়া ছাড়া হবে বেশ কিছু লোক, ডিটেনশন ক্যাম্পে যাবে অনেকগুলো পরিবার, গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাবে বেশ কিছু মানুষ! রাস্তার উপরে খুন হয়ে পড়ে থাকবে গতকালের তিনটে আঙ্গুল খোয়ানো কাটা লাশটা!

আদেশপত্রে তার সইটাও তো ছিল মাত্র তিনটে আঙ্গুলের খেল!

 


[ প্রকাশিত – সাপ্তাহিক বর্তমান – 19 December 2020 issue. ]

Comments

  1. একটি প্রকাশিত‌গল্প।‌ সাপ্তাহিক বর্তমান। ১৯/১২/২০২০

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

জীবন

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

দয়াবতী, যাও, ফিরে যাও!