ভালোবাসার সন্ধানে কয়েকটি চরিত্র
ভালোবাসার সন্ধানে কয়েকটি চরিত্র
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
দরজায় কলিং বেল টিপলাম, ভেতর থেকে কোকিলের ডাক ভেসে এলো। দরজা খুলে গেলো। দেখলাম, প্রিয়াঙ্কা নিজেই বেরিয়ে এসেছে।
এক ঝলক হেসে প্রিয়াঙ্কা জিজ্ঞাসা করলো ‘আরে, তুমি!’
আমি একটু হাসলাম। কোন কথা বললাম না। সোজা ওদের সবুজ সোফাটায় গিয়ে বসে পড়লাম। প্রিয়াঙ্কা সোফাতেই আমার পাশে ধপ করে বসে পড়লো। সোফার স্প্রিংগুলো নড়ে চড়ে উঠলো। সামনের দরজাটায় ঝুলছিল একটা সবুজ ভারী পর্দা।
আমরা মান্না দে’র গান নিয়ে, অনুপ জলোটার গজল নিয়ে, জার্ণালিজমের কোর্স নিয়ে এবং মেসোমশাইর মারুতি গাড়ী কেনা নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে
আলোচনা করলাম। এক সময় কোন প্রসঙ্গই আর তেমন ভাবে এগোলো না। শুধু নীরবতা সময়কে কাটতে লাগলো।
তারপর প্রিয়াঙ্কা আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো। ওর সপ্রতিভ ভাবটা এতক্ষণে যেন ফিরে পেয়েছে।
আমায় সপ্রতিভ ভাবেই বললো, ‘আচ্ছা একটা কথা বলবো? তুমি ইউ পি এস সি-র পরীক্ষাটায় বসছো না কেন?’
প্রিয়াঙ্কার উপর আমার রাগ হলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এসব পরীক্ষা টরীক্ষা দিয়ে কি হবে?’
প্রিয়াঙ্কা হালকা করে হেসে জবাব দিলো, ‘জানো তো, একটা
ভালো পজিসন না হলে – প্রোপার ইনকাম না থাকলে ছেলেদের প্রেস্টিজ
নেই!’
‘তাহলে দেখছি তোমার পাশের বাড়ীর ফাইন্যান্সের
অ্যাকাউন্টেন্ট চিন্ময়ই তোমার কাছে সব চাইতে প্রেস্টিজিয়াস ম্যান!’
‘তুমি সব কথাগুলো এমন ভাবে নাও,
- তোমাকে কিছু বলাটাও অন্যায়।’
তারপর আমাদের আলোচনাটা ভোঁতা হয়ে গেলো। আমি প্রিয়াঙ্কাদের ড্রয়িং রুমের দামী আসবাবপত্র দেখতে
লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে ওদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে
আসতে চোখে পড়লো বেলজিয়াম গ্লাসে প্রতিফলিত আমার পুরো চেহারাটা।
নিদারুণ ভাবে মনে হলো এই বিকেলে প্রিয়াঙ্কা আমার প্রেস্টিজটা
মাটি করে দিয়েছে।
# # #
অনুশীলা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। আমার কাছাকাছি বয়সের কোন যুবতী মেয়েকে আমি এমনভাবে কাঁদতে
দেখিনি।
কাঁপা গলায় অনুশীলা বলতে লাগলো, ‘বিশ্বাস করো, আমি
ওকে ভীষণ ভালোবাসি। অথচ ভীষণ ভয় হয় – তুমিই বলো আমি কি
করবো?’
দেবাশীষকে আমি চিনি।অনুশীলার কান্না ভরা আয়নার মুখোমুখি
বসে আমি কয়েক মুহূর্তের জন্যে দেবাশীষকে নিয়ে ভাবতে লাগলাম।
সমস্ত বিশ্ব যদি ডান দিকে হেঁটে যায়, তবে দেবাশীষ হাঁটবে বাম দিকে। ওর অবস্থানটা কলেজের সাধারণ ছাত্রদের বিপরীত মেরুতে। টগবগে একটা যৌবন। যেন একটা হাতিয়ার। ভি সি-র ঘরে প্রতিবাদ জানাতে যাও – সেখানে দেবাশীষ। স্টুডেন্টস্ ইউনিয়নের এইড ফান্ডের মিটিং – সেখানে দেবাশীষ। প্যালেস্টাইনীদের জন্যে সাহায্য
তোলা – সেখানে দেবাশীষ। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে মিছিল – সেখানেও।
অনুশীলাকে তো আমি চিনি। কত শান্ত। ধীর স্থির। লাজুক।
লোকের সঙ্গে পারতপক্ষে কথাও বলে কম।
আসলে আগে আমি সত্যিই জানতাম না, দেবাশীষের জন্যে
অনুশীলার এই দুর্বলতার কথা। আমি একটু অবাক হলাম।
যাই হোক, ব্যাপারটা একটু যাচাই করে নেওয়ার জন্যে
অনুশীলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এ ব্যাপারে ও তোমাকে কি বলেছে?’
‘আমি জানি দেবাশীষ আমাকে ভালোবাসে। ও আমাকে বলেছে –
আমাকে এখনো ‘হয়ে উঠতে’ হবে। আসলে ও চায় আমাকে ওর মতো করে গড়ে নিতে।’
অনুশীলাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম- ‘তাহলে তোমার সমস্যাটা
কোথায়?’
‘আসলে আমার ভয় হয় আমি নিজেকে ওর সঙ্গে কতটা মানিয়ে
নিতে পারবো!’ অনুশীলা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
আমি আর কিই বা বলবো। তবু অনুশীলার মুখের দিকে তাকিয়ে
আমায় কিছু বলতেই হলো, ‘দ্যাখো, তুমি দেবাশীষের উদ্দম ঝড়ো জীবনের সাথে কতখানি খাপ
খাইয়ে নিতে পারবে সেটা তোমার নিজেরই ভাবার ব্যাপার। তবে একটা জিনিষ, কোন ব্যাপারে
ভীরু মানসিকতার পরিচয় দেয়াটা – ’
অনুশীলা এবার উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো।
# # #
যাদবপুর এইট-বি বাসস্ট্যান্ডের ধারেকাছে চক্কোর
দিচ্ছিলাম। দেখা হয়ে গেলো শর্মিষ্ঠা আর অসীমের সঙ্গে। আমিও ভিড়ে গেলাম ওদের
জুটিতে!
কিছুক্ষণ বাদে অফিসের কি একটা জরুরী কাজে অসীমকে কেটে
পরতে হলো। তিনজন থেকে আমরা আবার দুজন হয়ে গেলাম।
আমরা দুজন কফি হাউজের একটা টেবিল দখল করলাম। তখনই
আমার কথাটা শুনে শর্মিষ্ঠা খিল খিল করে হেসে উঠলো।
বললাম, ‘হাসছো যে, আমি সিরিয়াসলি তোমায় জিজ্ঞেস
করছি।’
উত্তরে শর্মিষ্ঠা আমার দিকে রহস্যভরা দু’চোখ মেলে
দিলো। তারপর সপ্রতিভভাবেই জবাব দিলো- ‘তুমি ক্ষেপেছো?’
শর্মিষ্ঠা কথাগুলো বলতে বলতে ওর কপালের উপর ঝুঁকে পড়া
চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে নিলো।
আমি বললাম, ‘কিন্তু অনেকেই জানে অসীম তোমার প্রেমে
পড়েছে।’
‘তাই নাকি?’ আমার কথা কেড়ে নিয়ে শর্মিষ্ঠা জবাব দিলো,
‘অসীমের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে পারে, ব্যাস, ওই পর্যন্তই। তার বেশী আর কিছু নয়!’
অসীমের কথা মনে করে আমার দুঃখ হলো। কালো লম্বাটে মুখ,
বলিষ্ঠ চেহারা অসীমের। ওর সপ্রতিভ আর করিতকর্মা ভাবটাও আমার ভালো লাগতো। না। তবে
দেখতে সুন্দর বলি কি করে অসীমকে!
ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের পুরো চেহারাটা আমার দেখা
আছে। আমি অসীমের মতো দেখতে অতোটা খারাপ নই। অসীমের প্রেমের জন্যে আমার করুণা ও
সহানুভূতি জেগে উঠলো। আমার মনে হলো,
শর্মিষ্ঠার চোখে আমিও হয়তো যথেষ্ট সুন্দর নই। কারণ শর্মিষ্ঠাদের চোখে
ছেলেরা যথেষ্ট সুন্দর হয় না।
# # #
ট্রাম লাইন পেরোচ্ছিল মিলি।
আমি চেঁচিয়ে ওর নাম ধরে ডাকলাম।
ও দাঁড়িয়ে পড়লো।
‘কোথায় যাচ্ছো? লাইব্রেরী?’ মিলি আমায় জিজ্ঞেস করলো।
আমি বললাম , ‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি?’
মিলি বললো, ‘আমিও লাইব্রেরী।’
আমরা দুজনে হাঁটতে লাগলাম।
এক সময়ে আমি মিলিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা মিলি, তুমি
কাউকে কোনোদিন ভালোবেসেছ?’
মিলি যেন চমকে উঠলো। উল্টো আমায় জিজ্ঞেস করলো, ‘হঠাৎ
এ প্রশ্নটা তোমার মাথায় এলো কেন?’
‘এম্নি জিজ্ঞেস করছিলাম। বলো না, কাউকে কোনো দিন
ভালোবেসেছো কিনা?’
মিলি সপাটে উত্তর দিল, ‘না, এখনো পর্যন্ত না।’
আমার শেষ দুর্গটাকে কে যেন গোলা মেরে উড়িয়ে দিলো।
মিলি কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পরে মুখ খুললো। উলটো আমায়
প্রশ্ন করলো, ‘ভালোবাসা বলতে তোমার কি মনে হয়?’
আমি ভেতরে ভেতরে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম, ‘ধরো
বিশেষ কারোর জন্যে খুব বেশী ভাবা, বা ফিল করা?’
মিলি বললো, ‘তাহলে তো আমি অনেককেই ভালোবাসি।’
লাইব্রেরীর সামনের বিশাল বিশাল গাছগুলো সবুজ সবুজ
হাওয়া দিচ্ছিলো।
আমি আমার যুক্তিগুলো সাজাতে চেষ্টা করলাম। ‘ধরো,
বিশেষ কাউকে খুব ভালোলাগা, বা তার প্রতি খুব সহানুভূতিশীল হওয়া।’
মিলি হো হো করে হেসে উঠলো। বললো, ‘তাহলেও তো আমি
অনেকরই প্রতি খুব সহানুভূতিশীল।’
ও আমাকে খুব আঘাত দিল।
মিলি বললো, ‘আসলে আমার ভাবনাচিন্তাগুলো আরো কারোর
সঙ্গে মেশা চাই। আর এটা বুঝে নেয়া একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার! জীবনের খোলা রাস্তায়
একসঙ্গে অনেকক্ষণ না হাঁটলে এটা বোঝা যায় না।’
আমার মনে হলো, ইচ্ছে করেই মিলি আমায় বুঝতে চাইছে না।
# # #
প্রিয়াঙ্কা, অনুশীলা, শর্মিষ্ঠা, মিলি আর আমি।
ইউনিভার্সিটির ক্লাস বাতিল করে দিয়ে, আমরা মেট্রোর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সিনেমাহল
হাউজ ফুল। আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কি করা যায়। প্রিয়াঙ্কার রিয়ার স্টলের দামী
টিকিট চাই। অনুশীলাকে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। শর্মিষ্ঠা আবার অমিতাভ বচ্চন
ছাড়া অন্য কারো বই পছন্দ করে না। মিলির যে সিনেমা দেখতেই হবে এমন কোন চাহিদা নেই।
ডিসিশন না নিতে পেরে হাঁ করে আমরা চৌরঙ্গীর চলমান
গাড়ী আর মানুষজন দেখতে লাগলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা উসখুসানি ভাব!
প্রিয়াঙ্কার একজন বয়ফ্রেণ্ড দেখা করতে চলে এলো। আর তক্ষুণি, ও আমাদের বাই বাই টা
টা করে মোটর বাইকে চড়ে ফুস্ করে হাওয়া হয়ে গেলো। বাইকটা যখন সশব্দে স্টার্ট
দিচ্ছিলো, তখন বুঝলাম ফ্রেন্ডটার পকেট অনেকেরই মতো অবিন্যস্ত নয়।
তারও কিছুটা পরে অনুশীলা কলেজস্ট্রীটে কিছু বই কেনার
নাম করে ওখান থেকে কেটে পড়লো। আমরা নিশ্চিত হলাম, ও সময়মতোই ঘরে পৌঁছে যেতে পারবে।
দেবাশীষ হয়তো বন্ধ করখানার সামনে এখন গেট-মিটিং করছে।
আমাদের সমস্ত পরিচিত মানুষেরা কি এক অজ্ঞাত কারণে
সেদিন মেট্রো সিনেমার সামনেই ঘোরা ফেরা করছিলো, না কি গোপনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করাই
ছিল! এর পরে যে হাজির হলো, সে শর্মিষ্ঠার এক বন্ধু। বন্ধুটি সুদর্শন। শর্মিষ্ঠার
একটুও সময় নষ্ট না করে বন্ধুটির সঙ্গে চলে গেল।
তখনও দাঁডিয়ে ছিলাম আমি আর মিলি।
না। তারপর আর কেউ এলো না।
আমি আর মিলি। আমরা দুজন হাঁটতে লাগলাম। একসময়ে কলকাতা
শহরের ভীড়ে নিজেদের হারিয়ে দিলাম।
আমরা দুজন আউটরাম ঘাটের গঙ্গায় গিয়ে বসলাম।
মিলি দূরে নোঙ্গর করা নৌকাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল।
তখনও দূরে কর্মব্যস্ত মানুষের ভীড়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি দেখছো?’
মিলি উত্তর দিলো, ‘জীবনকে।’
সন্ধ্যার মুখে আকাশটা লাল হয়ে এলো। আমি আকাশের দিকে
তাকিয়ে ছিলাম। আমি ভালোবাসা নিয়ে ভাবছিলাম। দেখলাম, মিলিও পড়ন্ত সন্ধ্যায় আকাশের
দিকে তাকিয়ে আছে। গোধূলির আলোয় ওর মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি এমন একমনে ভাবছো?’
মিলি উত্তর
দিলো, ‘ ধরো, ভাবছিলাম ভালোবাসার কথা!’
সন্ধ্যা আরও গড়িয়ে এলো। অন্ধকার নামলো। আমি মিলির হাত
ধরলাম। ও উদাস হয়ে রইলো। আমি মিলিকে খুব কাছে টানলাম। ও নিঃশব্দই রইলো। আমি ওর
শরীরে হাত দিতে লাগলাম। ও মুখে কিছু বললো না। আমি ওকে বারবার জড়িয়ে ধরলাম। একসময়ে আমি
মিলিকে চুমু খেতে গেলাম।
মিলি আচমকা নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।
আমাদের জড়াজড়িতে টুং করে চাতালের শানের উপর কি যেন
একটা পড়লো। শব্দটা আমার কানে এলো।
আমি মিলিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ মাটিতে কি যেন পড়লো!’
হেসে মিলি উত্তর দিল, ‘তোমার অনুভূতি!’
আমি চাতালে খুঁজতে লাগলাম পড়ে যাওয়া জিনিষটাকে।
মৃদু হেসে মিলি বললো, ‘আমি জানি, ওটা খুঁজে পেতে এখনো
তোমার অনেক সময় লাগবে।’
দেখলাম, ইতিমধ্যেই মিলির হাতে উঠে এসেছে ওর গলার
হারের ছেঁড়া লকেটটা!
[ Published ]
Comments
Post a Comment