জীবন প্রমানপত্র
গল্প
জীবন প্রমানপত্র
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
জীবন প্রমান পত্র দিতে হবে; বৃদ্ধাবস্থার পেনশনটা
আটকে গেছে। হোক না সামান্য কটা টাকা - এ পোড়া
সংসারে সেটাই অনেকখানি। হারাধন দুপুর বেলা অটোরিক্সা থেকে নেমে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ব্যাঙ্কে
এলো।
আঙ্গুলের বায়োমেট্রিক দিতে বুড়োদের লম্বা লাইন। শেষ মেষ
হারাধনের পালা। টেবিলে রাখা কমপিউটার। ব্যাঙ্কের
অফিসার চৌকো খেলনার মতো ছোট্ট একটা জিনিষ দেখিয়ে বললো- “এখানে, এখানে আঙ্গুল
রাখুন।... না না এই আঙ্গুলটা।’
নির্দেশমতো হারাধন তার আঙ্গুলের ডগা স্ক্যানারে
বুলিয়েই যাচ্ছে!
কিন্তু কমপিউটর বিট্রে করছে। মানুষটার আঙ্গুলের ছাপ কম্পিউটর
চিনতে পারছে না। ব্যাঙ্কের অফিসার মুখ তুলে জিগ্যেস করলো- ‘এটাই আপনার নাম্বার?
আপনিই হারাধন ব্যানার্জী? তা হলে আপনার আঙ্গুলের ছাপ মিলছে না কেন?’
-‘স্যার, এই দেখেন আমার ওরিজিনাল আধার কার্ড। এটা
আমারই নাম্বার। আমি ‘আমি’ না হয়ে অন্য লোক হতে যাবো কোন দুঃখে!’ এ কথা বলে ফেলে
হারাধন একটু বোকা বোকা হাসলো। ক্লান্তিতে তার পা দুটো কাঁপছিলো।
বিরক্ত ব্যাঙ্ক অফিসার ওকে সেদিনের জন্যে ফেরৎ পাঠিয়ে
বল্লো- ‘ আপনি কি আরেক দিন আসবেন?’
মনে হলো কেউ যেন বলছে, - ‘আপনি কি আরেক দিন বাঁচবেন?’
এরকম অবাক কান্ডই হয়েছিলো দুদিন আগে। ডাক্তারের চেম্বারে লাইন লাগিয়ে ছিলো, শরীরটায় জুত লাগছে না। হারাধন যখন চেম্বারে ঢুকতে পারলো, তখন ডাক্তার তো পরেসান!
হাতে প্রেসার মাপার যন্ত্র লাগানো; হারাধনের বুকে স্টেথিস্কোপ; ডাক্তারের চক্ষু তো
চড়কগাছ – ‘আপনি তো দিব্যি এখানে হেঁটে এসেছেন! অথচ আপনার হার্ট বিটটাও ঠিক ঠাক
শুনতে পাচ্ছি না? প্রেসার মাপার যন্ত্রটাও ভালো কিছু রিডিং দেখাচ্ছে না, বলুন
আপনার কি কি সমস্যা? আপনি ঠিকঠাক বেঁচে আছেন তো?’
হারাধনের সব কথা শুনে ডাক্তার টোটাল মেডিক্যাল চেক
আপের একটা ফর্দ লিখে দিলো। আবার অনেকগুলো টাকার গচ্ছা! এক সময়
হারাধন সুরুৎ করে ডাক্তারের চেম্বার থেকে সরে এলো। অনেকদিন ধরেই আজকাল হারাধন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করা শুরু করেছে- ‘আমি কি বেঁচে
আছি?’
হারাধনের বউ এর আবার আর্থারাইটিস, তার মধ্যে হাঁটুর
জয়েন্টটা জবাব দিয়েছে। ওয়াকার নিয়ে হাঁটে। হারাধনের বেকার ছেলে নতুন কি একটা
বিজনেস কোম্পানীতে ঢুকেছে, এ বাড়ির সঙ্গে সে কোন সম্পর্ক রাখে না। ওদের কোম্পানীর ব্যাবসাটা বড় অদ্ভুত; মানুষকে গাধা বানানো বা গাধাকে মানুষ
বানানোর কি সব ওষুধপত্র বিক্কিরি করা! হারাধন বুঝে পায় না এসব ওষুধ কে কেনে?
শুনেছে, কারখানার ক্যান্টিনে, দারুভাট্টির পাশের ঝুপড়িগুলোতে এসব ওষুধ বিক্কিরি
হয়।
সেদিন আর ব্যাঙ্কে তার জীবন প্রমানপত্র দেয়া হলো না। মন
খারাপ করে ঘরে ফিরে এলো হারাধন। ফেরার পথে নিয়ে এলো দু কিলো আতপ চাল, এক কিলো আলু,
এক পাও পেয়াজ, আর একটা মশা মারার কয়েল। বউ গজগজ করতে লাগলো- ‘তেল, নুন, জিরে-হলুদও যে আনতে
বলেছিলাম? রান্না করবো কি আমার মুন্ডুটা দিয়ে?’ গতমাসে পেনশনের সামান্য কটা টাকা
জমা পড়েছিল অনেক দেরীতে, যা জমা ছিলো তা ফতুর হয়ে গ্যাছে! ব্যাঙ্কের খাতায় এখন ভোঁ
ভাঁ – হাতেও টাকা নেই। অপেক্ষায় আছে এ মাসে পেনশনের টাকা কটা কবে আসবে।
তবুও বউএর কল্যানে দুপুরের দুমুঠো ভাত মিললো। রিটায়ার
মানুষ, অভ্যেস মতো একটু বিছানায় গড়িয়ে নিলো হারাধন।
সন্ধ্যার সময়ে দরজায় খটখট আওয়াজ। ভাবলো বাড়ীয়ালা বুঝি
ভাড়া চাইতে এসেছে। না, হারাধন দরজা খুলে দেখলো বাইরে
ঝড় উঠেছে। রাস্তার উপর পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের আবর্জনা, গাছের ঝরে পড়া মৃত পাতারা
হাওয়ায় পাক খাচ্ছে। এই ঝড়ো হাওয়ায় এককালে তার শরীরটাকে আদর করতো, শির শির করতো
গায়ের লোম । গাছের নড়োনচড়ন , হাওয়ার নাচোন কোদন দেখে সে টের পাচ্ছে এখন ঝড়
উঠেছে।
অথচ আজ শরীরে হাওয়ার স্পর্শ তেমন যেন টের পাচ্ছে না
কেন? হারাধনের শরীরে কি কোন সারই নেই, ওর নার্ভগুলো কি ঠিকঠাক কাজ করছে না?
মেঘ ডাকছে। বিদ্যুতের রেখা! উপরে তাকিয়ে হারাধন দেখলো
একটা কালো আকাশের শ্লেট ঝুলে আছে। বিদ্যুতের হরফে তাতে লেখা
–‘হারাধন বাবাজীবন! ব্যাঙ্কে তোমার আর জীবন প্রমান পত্র জমা করার দরকার নেই। কারণ
এই হা পিত্যেশের সংসারে, এই অভাবের সংসারে আজকাল তুমি মৃত!’
পেনশন-দাতারা না জানুক, ডাক্তারেরা না জানুক, হারাধন
জানে সে বেঁচে আছে! চারপাশের সমাজ-মানুষজন না জানলে সে কি ই বা করতে পারে?
তবুও হারাধন নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করলো - ‘আমি কি
সত্যি সত্যি বেঁচে নেই?’
হারাধন যে বেঁচে আছে তা প্রমান করতে সে খক্ খক্ করে
কাশলো, থুথু ছুড়লো বাড়ির দেয়ালে। এক দলা হলদেটে কফ আটকে রইলো ঘরের দেয়াল ঘেঁসা
দোপাটি ফুলের গাছটায়।
কালকে দুপুরে হারাধন আবার ব্যাঙ্কে যাবে- জীবন
প্রমানপত্রের লাইন লাগাতে!
Comments
Post a Comment