দেবদারু একটি নদীর নাম

 



দেবদারু একটি নদীর নাম

সমরেন্দ্র বিশ্বাস


নদীর গতিপথকে কারা কিনে নেয়? নদীর জলে কেন ভেসে আসে মানুষের লাশ? কেন বন্দুকের গুলি? কেনই বা মৃত মানুষের দুর্গন্ধময় শরীর?

দেবদারু নদীটাকে বেঁচে দেয়া হয়েছে হাওয়ায় হাওয়ায় এ খবরটা ছড়িয়ে পড়লো দিকে দিকে, আশপাশের শহরগুলোতে, সংবাদপত্রেও গাছপালা, পশুপাখি, যাদু-টোনা করে যারা ভূতপ্রেত নামায়, তারা সবাই এ খবরে শিউরে উঠলো

পবন খুড়ো মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে বিড়ি টানছিল সে বললো, এরপর তো হাওয়াকেও বেচে দেয়া হবে বলবে, একঘন্টা নিঃশ্বাস নিয়েছো, এবার টাকা দাও!

খবর কাগজে নদী বিক্রির খবরটা ছোট্ট করে ছাপা হলো

দেবদারু নদীকে লিজ দেয়া হয়েছে মেসার্স বার্ড অ্যান্ড ওয়াটার রিসোর্স কোম্পানীকে ভাঙ্গনধরা গ্রামটার কাছে বাঁধ বা এনিকট তৈরী হবে সেখান থেকে উপরের কুড়ি কিলোমিটার পর্যন্ত নদীটার নিয়ন্ত্রণ এই কোম্পানীর হাতেই ভবিষ্যতে সবাইকে এদের থেকেই জল কিনতে হবে

এ কি অলুক্ষুণে কথা! কি যে দিনকাল আসছে! দেবদারু নদীটা বিক্রি হচ্ছে এরপর দেখতে দেখতে পয়সায়ালা মালিকেরা কিনে নেবে দুপাশে গাছপালা, বন জঙ্গল, ঝোপঝাড়, পাখি ওড়া আকাশটাও! এই নদীর জলে তাহলে কি মানুষের আর কোন মৌলিক অধিকার থাকবে না?

#

সমাজসেবী সাধ্বী সাগরিকা দেবদারু নদীর পাড়ে বাঁধানো ঘাটে ধর্ণায় বসেছে নদীর বেসরকারীকরণ চলবে না! তার বক্তব্য জল, হাওয়া এইসব প্রাকৃতিক সম্পদ সবার ব্যবহারের জন্যে সাধ্বী সাগরিকার ধর্ণার সমর্থনে দূর শহর থেকে আজকেই একটা সাইকেল  র্যালি এখানে এসে পৌঁছাবে নদীর ঘাটটার পাশেই ময়দানে প্রায় শতিনেক মানুষও জড়ো হয়েছে এই অঞ্চলের নদী বাঁচাও আন্দোলনের নেতা নির্মল শর্মা আজকের জমায়েতের প্রধান উদ্যোক্তা

বেশ জমে উঠেছে জনসমাবেশে নির্মল শর্মা ভাষণ দিচ্ছে বলছে-

 সমস্ত জনগনগ্রামবাসী , কৃষকভাই, সবাই মিলে এই নদীর বেচে-দেয়াকে আমরা আটকাবো, জল কিংবা হাওয়ার মতো প্রাকৃতিক সম্পদে বেসরকারী নিয়ন্ত্রণ আমরা মানছি না, মানবো না! ভাঙ্গনধরা গ্রামটার কাছে বাঁধ বা এনিকট তৈরী হলে ওরা ইচ্ছে মতো জলস্তর নিয়ন্ত্রণ করবে ডাউনস্ট্রীমের নীচের দিকটা সারা বছর জলের অভাবে শুকনোই থাকবে অন্যদিকে আপারস্ট্রীমের নদী ভরপুর থাকবে তাহলেও উপরের গ্রামগুলোয় লোকদের সে জলে কোন অধিকার থাকবে না তারা পাম্প চালিয়ে বা নালি কেটে নদীর থেকে সরাসরি জল তুলতে পারবে না সামনে বড় দুর্দিন তাই অনুরোধ সমস্ত ভাইবন্ধু, আপনারা সঙ্গে থাকুন নদী বেসরকারীকরণের এই অন্যায় চক্রান্তের কথা শহরে শহরে, নানা সোসাল মিডিয়াতে পৌঁছে দিন আমরা চাই, চার দিকেই প্রতিবাদের ঝড় উঠুক

প্রচুর হাততালির মধ্য দিয়ে নির্মল শর্মা ও বাকী সবার ভাষণ শেষ হলো স্থানীয় প্রশাসন এখানে এমন জমজমাট সভার কথা চিন্তাও করতে পারে নি

প্রতিরোধী-জমায়েত, বিক্ষোভ, সাইকেল মিছিল, সাধ্বী সাগরিকার ধর্ণা, এসব মিলে ঘুমন্ত অঞ্চলটা নড়েচড়ে উঠছে নদী কি জানে সভ্যতার এতো সব চক্রান্তের কথা? জলস্রোত কি শুনতে পায় মানুষদের এই হৈচৈ? নদী ধীরে ধীরে বয়ে চলে কুলু কুলু শব্দে, নিজের খেয়ালে! বড়ো পবিত্র এই দেবদারু নদী! বনজোছনা থেকে বেরিয়ে এসে পরীরা এখানে কাপড় খুলে চান করে কথিত আছে, প্রাচীনকালে দেবতারা সুরাপানের আসরে পবিত্র এই নদীর জল দারুর সাথে মিশিয়ে সেবন করতেনতাই এই নদীর নাম দেবদারু!

#

দেখতে দেখতে কিছু দিনের মধ্যেই ভাঙ্গনধরা গ্রামটার কাছে বাঁধটা তৈরী হয়ে গেলো পাশেই বিশাল পাম্প হাউজ বিভিন্ন বানিজ্যিক উদ্যোগ ও পানীয় জল সরবরাহের জন্যে পাইপলাইনও বসে গেছে বার্ড অ্যান্ড ওয়াটার রিসোর্স কোম্পানী এখন জল বেচছে

যেমনটা ভাবা হয়েছিল, কিছুদিন বাদে তাই হলো ডাউনস্ট্রীমের নদীটায় জল কমে গেছে; গ্রীষ্মকালে দেবদারু নদীর এমন শুকনো চেহারাটা কোনদিনই লোকেরা দেখে নি নির্মল শর্মার নেতৃত্বে আবার লোকজনেরা জড়ো হচ্ছে ধীরে ধীরে এ আন্দোলনটাকে তীব্র করতে হবে! ভাঙ্গনধরার বাঁধে জড়ো হয়েছে প্রচুর মানুষ! শ্লোগান উঠছে জল চাই, জল দাও’ ‘জল বিতরণে বেসরকারী নিয়ন্ত্রণ মানছি না, মানবো না!’

নদীর আপারস্ট্রীমে পাম্পহাউজের কাছে দাঁড়িয়ে আছে বার্ড অ্যান্ড ওয়াটারএর সুসজ্জিত পাহারাদারী মোটর-বোটটা

#

কোম্পানীর তরফে আজ দেবদারু নদীর বুকেনদী-বান্ধবঅভিযান কোম্পানীই যে নদীর মালিক, ‘নদী-বান্ধবঅভিযানটা সেই প্রচারের একটা কৌশল মোটর-বোটে কোম্পানীর ঝান্ডা লাগিয়ে সমস্ত নদীপথটা ঘুরতে ঘুরতে এই প্রচার চলবে;  এই অঞ্চলে জলসরবরাহের যে দায়িত্ব তারা  নিয়েছে, তা সমস্ত শিল্প-উদ্যোগ, কৃষকবন্ধু আর স্থানীয় নাগরিকের ভালোর জন্যেইজবরদস্তি লোকদেখানো এ প্রচারটা সমস্ত কাহিনীরই একটা এপিসোড

এই অভিযানের বিরুদ্ধে পালটা প্রচারের জন্যে নির্মল শর্মাদের নেতৃত্বে লোকজন তৈরীই ছিল নদীর দুপারে গ্রামের প্রচুর লোকজন জড়ো হয়েছে

সবাই দেখছে বার্ড অ্যান্ড ওয়াটারএর সুসজ্জিত পাহারাদারী মোটর-বোটটা নদীতে চক্কোর দিচ্ছে সেখান থেকে মাইক্রোফোনে ভেসে আসছে লারেলাপ্পা গান বোটের উপর দাঁড়িয়ে কিছু মস্তান গুন্ডার চেহারা ওদের হাতে বন্দু্ক। নদীর কিনারা ঘেষে ঘুরে বেড়াচ্ছে মোটর বোট । বোটের গুন্ডামার্কা চেহারাগুলো শব্দবাজী ফাটাতে ফাটাতে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন কোন উৎসবজড়ো হওয়া লোকজনদের ঘাবড়ে দেয়ার জন্যে মাঝে মাঝে তারা বন্দুকের গুলি ছুড়ছে আকাশে যেন পাখি কিংবা আকাশকে গুলিবিদ্ধ করে এই নদীর জলকে রক্তাক্ত করা খুবই সহজ

নদীপাড়ে মহল্লার যে সব লোকজন দাঁড়িয়েছিল, এসব বেয়াদবি তাদের সহ্য হচ্ছিল না নদীর দুই পারে তখন জুটে গেছে শচারেক লোক, কারো কারো হাতে লাঠি সড়কি! নদীতে জড়ো হয়েছে জেলেদের নৌকাগুলো ওই যে মস্তান গুন্ডাগুলো, মোটরবোটে ভেসে বেড়ানো জল-কোম্পানীর ভাড়া করা দালাল! ওদের শিক্ষা দিতেই হবে! নদীর কিনারে জড়ো হওয়া মানুষগুলো ঝঁপিয়ে পড়লো নদীতে, কেউ ডিঙ্গিতে, জেলেরা তাদের ছোট নৌকায়, কেউ কেউ নদীর কিনারা ধরে ছুটতে লাগলো মোটরবোটের দিকে

- ‘ধর! ধর! ধরে ফ্যাল ব্যাটাদের! পাকড়ো দুশমন হারামী আদমী লোগকো। এ পানি হাম লোগো কো, পানি কো সওদা করণে নেহী দুঙ্গা!’

-‘এই জল আমাদের বার্ড অ্যান্ড ওয়াটার কোম্পানী এখান থেকে জলদি ভাগো

নদী ধারে জনসমাবেশের খবর পেয়ে ছুটে এলো কোম্পানীর  আরেকটা মোটরবোট, এই বোটের উপর এবার কিছু ধোপ দুরস্ত মানুষ, সুপারভাইজার, কোম্পানীর এজেন্ট!  

এরই মধ্যে অনেকগুলো নৌকা ঘিরে ফেলেছে দুটো মোটরবোটকে, দুরস্তমানুষগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেকোম্পানীর উল্লাস নিমেষেই মিইয়ে গেল, গুন্ডাগুলোর হাত থেকে কেড়ে নেয়া হলো ক্যামেরা, লাঠি-সোটা, বন্দুক, সেগুলোকে ফেলে দেয়া হল দিক চিহ্নহীন নদীর গভীর জলে। না, ভাগ্যি ভালো, কারোর লাশ পড়েনি সেদিনের গল্পের এখানেই পরিসমাপ্তি! এ ঘটনায় প্রশাসন অবশ্য পুলিশ পাঠিয়েছিলসে অনেক পরে

 #

পরের দিনই খবর এলো, নদী বাঁচাও আন্দোলনের নেতা নির্মল শর্মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না জলজ্যান্ত মানুষটা নিখোঁজ  কোথায় গেছে লোকটা? পরিবারের মানুষজন, বন্ধুবান্ধবেরা কেউ কিচ্ছু জানে না

 জল নিয়ে কোম্পানীর বিরুদ্ধে লোকেদের ক্ষোভ উত্তুঙ্গে ঠিক দুদিন বাদে গ্রামের কিছু লোক মিলেমিশে ঠিক করলো- অ্যাকশন! রাতের অন্ধকারে নদীর বাঁধটাকে ভেঙ্গে ফেলা হবে  

ভরপুর জোছনার রাত, চরাচর জুড়ে নির্জনতা ভাঙ্গনধরা বাঁধের উপর জড়ো হয়েছে শদুয়েক লোক ওদের হাতে শাবল, কোদাল, গাইতি ওরা এদিক ওদিকে নদীর বাঁধটাকে খুঁড়তে লাগলো জায়গায় জায়গায় খুঁড়ে শাবল মেরে ক্ষত বিক্ষত করে দিতে লাগলো বাঁধটাকে বেশ কয়েক ঘন্টার মেহনতে গ্রামবাসীরা বিপদজনক এ কাজটা করে উঠে এলো দেখলো, উখরে যাওয়া বাঁধটার ভাঙ্গা দেয়ালে ফাটল ধরেছে, এদিক ওদিক দিয়ে জলের স্রোত বেরিয়ে আসছে ভরা জলের তোড়ে আলগা হয়ে যাচ্ছে বাঁধের গাথুনি, উপচে পরছে জল

নীচের তৃষ্ণার্ত নদীর ভুখাশুখা জলস্রোত দুআঁজলা বাড়িয়ে উপরের টইটম্বুর নদী, অবরুদ্ধ সহোদরাকে ডাকছে – ‘আয়! নেমে আয়!’

#

পরের দিনইসবাই দেখলো স্বর্গীয় দেবদারু নদীটা জলে ভরে গেছে স্নিগ্ধ হাওয়া। নদীর পারে সেদিন উৎসব। গ্রামবাসীরা জলের অধিকারের বিজয় উৎসবটা পালন করছে। তারা বাঁধটা ভেঙ্গে দিয়ে নদীটাকে সওদা হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে! কেউ কেউ আবার দিশি মদ আর হাড়িয়া খেয়ে নদীর কিনারে চুপচাপ ঝিমাচ্ছেহাঁটু ডোবা নদীর জল তখন কোমর, কাঁধ, মাথা ছাড়িয়ে গেছে! সাধ্বী সাগরিকা তার আশ্রম থেকে সন্দেশ পাঠিয়েছে, স্বাগত জানিয়েছে জনগনের এই বিজয়কে

বিকেলের দিকে গ্রামের মানুষজন দেখলো, ভাসমান শ্যাওলা জড়ানো বাদামী কিছু একটা, সেটা নদীতে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছেএকসময়ে সেটা আটকে গেল নদীর কিনারে, একটা ঝোপে।

মৃতের শরীরে দুর্গন্ধ! ইষৎ খোলা চোখে গলে যাওয়া পচা মাছের দৃষ্টি। অনেকে মিলে দেহটাকে তুলে নিয়ে এলো নদীর পাড়েবিষাক্ত গন্ধে থমকে যাওয়া মানুষজন চিল্লিয়ে ঘোষণা করলো, এই মৃত মানুষটিই তাদের দেবতা। নদীকে কোম্পানীর হাতে বেচে দেয়ার যে চক্রান্ত চলছিলো, এই লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল তারই বিরুদ্ধে; মৃত লোকটি নির্মল শর্মা আন্দোলনটাকে দমাতে তাকে খতম করা হয়েছে খুনটা হয়েছে দিন তিনেক আগেই!

খবর পেয়ে মানুষজন আবার জড়ো হচ্ছে দেবদারু নদীর কিনারে সবাই হাহুতাশ করছে, ক্ষোভে ফুঁসছে! কিন্তু মৃতদেহের মধ্যে আজ আর কোন সংজ্ঞা নেই! যে লোকটা নদীকে ভালবেসে তার জীবনটাকে সমর্পণ করেছিল, সেই প্রেমিকা নদীই ফিরিয়ে এনেছে তার লাশ!

[‘আমি অনন্যাদিনের শেষেআয়োজিত যৌথ গল্প-প্রতিযোগিতাতে এই গল্পটি সম্মাননা-২০২০প্রাপ্ত]

 

17.05.2020 R3

 [ গল্পগ্রন্থ – ফুফুর কফিন ]

Comments

  1. ছবি - এবং সইকথা'র সৌজন্যে প্রাপ্ত।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

কামিনের জন্যে কবিতা

হীরাকুদ, উৎপল সেন ও আমাদের অগ্রজেরা