পুস্তক সমীক্ষা / আমার আঁতুড়ঘর – গৌরাঙ্গ দাস

 

শ্রমজীবনের কঠিন পথ পেরিয়ে আসা এক কবি ও

তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ

 

সম্প্রতি গৌরাঙ্গ দাসের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘আমার আঁতুড়ঘর’ পড়বার সৌভাগ্য হলো ‘প্লাবন’ সম্পাদকের সৌজন্যে কবি-পরিচিতি থেকে জানা যায় তার শৈশব অত্যন্ত অভাবে কাটে, যে কারণে পড়াশোনাও ততোটা এগোয় নি। খুব কম বয়েস থেকেই তাকে নানা কষ্টকর জীবিকা ও বৃত্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যদিও বর্তমানে সংসার জীবনে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। অবশ্যই এই আলোচনার প্রারম্ভে কবি গৌরাঙ্গ দাসকে আমার অভিনন্দন জানাই।

এই কবির কবিতা ছুঁয়ে থাকে বর্তমান সময়। তার লেখায় উঠে আসে কারখানার লক-আউট, শিল্পায়ণের বিতর্ক, ঢেউ তোলা ছিটমহল, ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জীবন, ধর্মান্ধতার নামে মানুষে মানুষে বিভেদ, রাষ্ট্রের মৌলবাদিতা, যশোর রোডের মৃত গাছ, ইত্যাদি বিভিন্ন সমসাময়িক কথা।

দেশ ও সময়কে তিনি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লেখেন –

‘নিমপাতা দাঁতে কেটে হাতে পায়ে আগুন সেঁকে

এই মাত্র ঘরে ফিরলো ভারতবর্ষ’  [ পৃষ্ঠা – ৮৮]

‘আমার আঁতুড়ঘর’ কাব্যগ্রন্থটি তিনটি পরিচ্ছেদে ভাগ করা – (১)গ্রহণ (২)হে শীত, হে বসন্ত (৩)আমার আঁতুড়ঘর 

প্রথম (গ্রহণ) পরিচ্ছেদে মূলতঃ তিনি ব্যক্ত করেন মৌলবাদের প্রতি তার অনাস্থা, ধর্মান্ধতাকে তিনি ঘৃণা করেন। তাই সহজেই তিনি লিখে ফেলেন এই সব পংক্তিগুলো –

‘স্যাক্সোফোনে গেরুয়া ও আলখাল্লা/ রক্তের উৎসবে জারজ নদী/  প্লাবন আনছে’ কিংবা ‘টুপি আর ত্রিশূল/ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে আজ/ ...... সংকীর্ণতার বীজ বুনছে মৌলবাদী রাষ্ট্র! [ পৃষ্ঠা – ১৪-১৫]।

দ্বিতীয় (হে শীত, হে বসন্ত) পরিচ্ছেদে তিনি লেখেন, জীবন সংগ্রামের ভাগীদার হয়ে এগিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই তার জীবন-বীক্ষা। দুর্বল সময় যে সবল হবে না, কে বলতে পারে? সমবেত জীবনের আহ্বানে তাই তিনি বলেন - ‘পদচিহ্ন রেখে যাওয়া- নদীর রেখার মতো / ক্ষীণ হলেও একদিন খরস্রোতা হতেই পারে’ [এসো]।

কবির ‘সংকীর্ণতা’  কবিতাটাও খুব সুন্দর। এখানে ব্যক্ত হয়েছে কবির উদ্বেগ – কেননা তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন, আমাদের সংকীর্ণতা শকুনের ধারালো ঠোঁটের মতো ঠুকরে খাচ্ছে মানুষের সংহতি!

কবি শঙ্খ ঘোষকে উৎসর্গীকৃত ‘আকাশ আকাশ’ কবিতাটির নিবেদন খুব কাব্যিক, যেমন – ‘সিঁড়িতে চলা একটা মৃদু শব্দ/ সেলফোনটাতে, আমার দৃষ্টি তখন/ অন্তরীক্ষের ওপারে রাজপুত্রের মতো/ মানুষ দেখছে, দেবর্ষি কি? ...... গঙ্গার ঘাটে নিমগ্ন সন্ধ্যা বলে উঠল/ আকাশ আকাশ’।

ভালো লাগে কবির এই লাইনগুলোও- ‘এখন কবিতার থেকে চেয়ে নেবো ঘুঙুর/ পরে নেবো, হেঁটে যাবো অন্ধকারে, যদি- / বেঁচে ওঠে একটা মৃত বন্দর’ [ যদি বেঁচে ওঠে]।  

 আমার মনে হয়, তৃতীয় পরিচ্ছেদ, আমার আঁতুড়ঘর-এর কবিতাগুলোতে কবি উঠে এসেছেন তার ব্যক্তিগত জীবনের কাছাকাছি। নিজস্ব ঘর-সংসারের পরিধিতে বসে তিনি নির্মাণ করেছেন তার সময়, বোধ, বুদ্ধি, অনুভূতি এবং নিজস্ব শব্দমালা!

এজন্যেই এখানে তিনি লেখেন নিজস্ব আর্তির কথা- ‘মনে হচ্ছে মিসড্‌ - কল আসছে বার বার /ওষুধ আর খেতে ইচ্ছা করছে না’ [পৃষ্ঠা – ৮০]।

অথবা

‘আমাকে ঠুকরে খাচ্ছেন ঈশ্বর’ [পৃষ্ঠা – ৭৪]।   

এমনই ভাবে, কবির নিজস্ব জীবনের আর্তি প্রাণময় হয়ে ওঠে, যখন তিনি লেখেন – ‘চুপ নয় / আমি বলব / ত্রিশ বছরের জমে থাকা কথা’ [পৃষ্ঠা – ৮৫]।

অথবা

‘সত্যের কাছে পৌঁছাতে আমি মৃত্যুর আরাধনা করছি’ [পৃষ্ঠা – ৬৭]

তার একটি কবিতার উপসংহার বিশাল প্রশ্ন জাগায়, সাসপেন্স উঠে আসে; লক্ষ্য করুণ সেই কবিতাটির অন্তিম লাইনটি – ‘শ্যামলী হারাচ্ছে কি কাউকে?’

কবির হাতে খুব সুন্দর লেখা হয়েছে আরেকটা লাইন – ‘চায়ের কাপ হাতে ডাকছে পূর্ণিমার চাঁদ’!

অথবা খুব সুন্দর এই বর্ণনা –

‘চাঁদের আলো নিয়ে উড়ে যায় পাখি / ডানা থেকে খসে পড়া প্রেম / প্রণাম হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চরাচর’ [পৃষ্ঠা – ৮১]।

আবার তার কিছু কিছু কবিতা [যেমন পৃষ্ঠা – ৭৮,৭৯] শুধুই কতকটা বিবৃতি, নিছক কিছু বর্ণনা! এরকম লেখার মধ্যে কাব্যিক উপাদান কম। কবিতার চিত্রকল্প, তার নির্মাণ, শব্দপুঞ্জ, ভাবের গভীরতা আমাদের অনুভূতিকে বিশেষ কিছু দিয়ে যাব- যে কোনো ভালো কবিতার কাছে এটাই সবার কাম্য অথচ তার কিছু কিছু কবিতায় এই উপাদানগুলোর অভাব লক্ষ্য করা যায়। এ বিষয়ে কবি ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই সচেতন হবেন।   

কবি গৌরাঙ্গ দাসের কবিতাগুলো বুঝিয়ে দেয়, তিনি একজন শ্রমজীবি কবি। তার কলমে উঠে আসে সত্যনিষ্ঠ উচ্চারণ – ‘সত্যের কাছে পৌঁছাতে আমি মৃত্যুর আরাধনা করছি’[ পৃষ্ঠা – ৬৭]। আমরা আশা রাখবো, কবির সাহিত্য চর্চার এই প্রয়াস ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। আমরা সাদরে অপেক্ষায় রইলাম কবিপরবর্তী কাব্যগ্রন্থটি অধ্যয়ণের জন্যে।

-   সমরেন্দ্র বিশ্বাস

 

==========  ===========

আমার আঁতুড়ঘর – গৌরাঙ্গ দাস / ( কবিতা গ্রন্থ)

প্রকাশক – অহর্নিশ , আশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা।

মূল্য – ৮০ টাকা।

==========  ===========

Comments

Popular posts from this blog

আমার অপমানিত সিঁড়ির বুক মাড়িয়ে

কামিনের জন্যে কবিতা

হীরাকুদ, উৎপল সেন ও আমাদের অগ্রজেরা