হাড় কিংবা একটি অস্থির কারণ অনুসন্ধানে
গল্প
হাড় কিংবা একটি অস্থির কারণ অনুসন্ধানে
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
# অমর #
উনোন সাজাতে সাজাতে সুনীতা চেঁচিয়ে উঠলো, ‘দাদা, এদিকে দেখে যা না!’
আমি ঘরের ভেতর থেকে বলে উঠলাম ‘কেন, কি হয়েছে?’
‘দেখেই যা না, কাঠকয়লার মধ্যে কি একটা জিনিষ?’
অপূর্ব বললো, ‘দেখেই আয় না। বেশী চেঁচামেচি করিস না। হীরা বা সোনাটোনা হলে সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেবে।’
ওদিক থেকে আমার বোন সুনীতা চেঁচাচ্ছে, ‘কি বিশ্রী একটা চিজ – আমি ইয়ার্কি মারছি না, এদিকে আয় না।’
শহর ছাড়িয়ে বহুদূরে একটা প্রত্যন্ত গ্রামে আমি আছি। অপূর্বর সঙ্গে অনেক দিন বাদে দেখা। ও এই অঞ্চলে এসেছে কয়েকদিনের জন্যে। সরকারী একটা প্রোজেক্টের তরফে এখানকার আদিবাসীদের উপর একটা সমীক্ষা চালাতে।
এটা একটা হদ্দ গ্রাম। ইলেকট্রিসিটি আসে নি। কেরোসিন তেলের লণ্ঠন, না হলে মোমবাতিই
ভরসা।
ম্লান লন্ঠনের
আলোয় একটা ঘরোয়া শীতের সন্ধ্যা। আমি আর অপূর্ব খাটিয়ায় বসে মেজাজে আড্ডা মারছিলাম। শেষ পর্যন্ত সুনীতার চেঁচামেচি
শুনে আমাকে উঠতেই হলো।
দেখলাম ছোট্ট হাত-চুলাটা অম্নিই পড়ে আছে, পাশেই কাঠকয়লার ঢাই করা। সুনীতা উনোন
ধরানোর জন্যে কাঠকয়লা তুলছিল।
আমি যেতেই ও কেরোসিনের ল্যাম্পটা তুলে ধরলো । দেখলাম কাঠকয়লার
গাদার মধ্যে বেঢপ চেহারার সাদাটে কিছু একটা উঁকি মারছে। ল্যাম্পের আলোটা ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে ভালো করে দেখলাম। মনে হলো একটা প্লাস্টিকের ক্ষয়ে যাওয়া কোন যাদুদন্ড!
খাটিয়ার আড্ডা ছেড়ে
অপূর্বও রান্নাঘরে এসে হাজির। ও দেখে মন্তব্য করলো – ‘ওটা একটা ঐশ্বরিক
বস্তু।
বুঝতে
পারছিস না,
কোন
জন্তুর হাড়,
আধাপোড়া
হাড়।’
আমি এখানকার একটা প্রাইমারী স্কুল টিচার। একটা সরকারী স্কুলে, প্রত্যন্ত গ্রামে পোস্টিং। বছর
খানেক হলো বদলী হয়েছি। আমার সঙ্গে আছে সুনীতা, আমার একমাত্র বোন। ও ডিভোর্সি, ছেলে মেয়ে নেই। এই সংসারে ও আমার
সঙ্গে, থুরি ওর অবিবাহিত দাদাটার সঙ্গেই থাকে। দুজনের নির্জন পরিবারে আজ
অন্য রকম একটা বিকেল। সন্ধ্যায় অতিথি হয়ে এসেছে অপূর্ব। সুনীতা কাঠকয়লায় উনান জ্বালিয়ে কিছু রান্না বান্নার ব্যবস্থা করতে গেছিল ; তখনই এই ব্যাগরা – কাঠকয়লার মধ্যে উঠে এসেছে কি একটা আজীব চিজ।
সুনীতা ঘেন্নায় থু থু করলো। আমার উপর ক্ষেপে গেল, -‘দাদা, তুই কয়লায়ালাকে
বলতে পারিস না।
একে
তো মাঝেমধ্যে ভিজে কয়লা দিচ্ছে, তার সাথে কি সমস্ত যাচ্ছেতাই একটা জিনিষ! মাগো, ঘেন্নায় বমি আসছে!’
‘কয়লায়ালাকে বলে আর কি হবে! যার কাছেই যাবি
ওজন বাড়ানোর জন্যে ওরা কাঠকয়লায় জল ঢালবে। তাছাড়া কয়লা এমন কোন সফিস্টিকেটেড জিনিষ না, ঝেড়ে-বেছে ময়লা পরিষ্কার
করে তারপর বাজারে ছাড়বে।’
আমার ভিলেজ-স্কুল মাস্টারের স্বভাব। আত্মপক্ষ সমর্থন করে বাধ্যের
ছোট্ট বোনটাকে স্কুল ছাত্রীর মতো বোঝাতে লাগলাম, ‘জানিস, কাঠকয়লা কিভাবে
তৈরী হয়?
গাছ
কেটে কাঠ জড়ো করা হয়। সেইসব গাদাগুচ্ছের কাঠ স্তুপীকৃত করা হয়। সেই স্তুপটাকে মাটির
পরতে ঢেকে দেয়া হয়।
তারপর
তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া - ওই কাঠ ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। এমনি ভাবে কাঠ কয়লা
তৈরী হতে কয়েক দিন লেগে যায়। হতে পরে ওরই মধ্যে ফেসে গিয়েছিল কোন জন্তুর এক আধটা
হাড়!
সেই
ঐশ্বরিক বস্তুটাই আধা পোড়া হয়ে কাঠকয়লার সঙ্গে আমাদের ঘরে চলে এসেছে।’
ইতিমধ্যে ঝুকে পড়ে অপূর্ব জিনিষটা হাতে তুলে নিয়েছে।
সুনীতা তীব্র আপত্তি জানালো, ‘অপূর্বদা, নোংরা জিনিষটা আবার
শুধু শুধু হাতে নিয়েছেন?’
সাইজে ইঞ্চি তিনেক লম্বা, সাদাটে। পোড়া লম্বা জিনিষটায়
অঙ্গারের কালচে পরত মাখানো। গম্ভীর হয়ে অপূর্ব বললো, ‘দেখতে তো আপত্তি
নেই।’
আরো কিছু বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও সাম্প্রতিক খররের কাগজ আমার মাথায়
খলবলিয়ে উঠলো।–
‘হতে
পারে এই স্তুপীকৃত জ্বালানীটা কাঠকয়লাই নয়। অন্য কিছু। অল্প একটু মাটি খুড়লেই কয়লার
মতো এ জিনিষটা কোথাও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে। না, লিগনাইট বা বিটুমিনাস কয়লাও নয়। এর নাম কি পীট কয়লা?’
আমি কয়লার ঢাই থেকে
এক টুকরো কয়লা হাতে নিলাম, ওটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। হতে পারে এটাই মাটির
অগভীর স্তরে আটকে থাকা আনম্যাচিওরড কোন কয়লা। মাটির নীচেই কোন গরু, মোষ বা কোন বন্য
প্রাণীর হাড় বৃক্ষের ডালপালার সাথে সমাধিস্থ হয়ে ছিল।
খবরের কাগজে দেখেছিলাম। কিছু দিন আগে পুরুলিয়াতে
উঁচু কোন একটা জায়গায়। টিলার পাশে জঙ্গল, তার পাশ দিয়ে একটা নদী। সেখানকার নাবাল
জমিতে জড়ো হয়েছে শ’খানেক গাঁয়ের লোক। ওদের মধ্যে হুল্লোড়, মার পিট লেগে গেছে। মাটিতে গর্ত করলেই
বেরিয়ে আসছে কয়লা।
তখনো
প্রশাসন খবর পায় নি। সমস্ত লোক ভীড় লাগিয়ে
কয়লা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। হবে হয়তো এটাও সেরকমই কোন আনম্যাচিওরড কয়লা।
অপূর্ব আমাকে থামিয়ে দিল – ‘অমর, তোর ভাবনাগুলো ডিটেকটিভদের
মতো উড়তে উড়তে চলে! এবার চুপ কর। এটা তুই যা বলছিস, মাটির অগভীর স্তর
থেকে তুলে আনা কোন আনম্যাচিওরড কয়লা, তা নয়। কাঠ পুড়িয়েই এটা
তৈরী হয়েছে,
দেখছিস
না এটা কেমন হাল্কা।’
আমাদের দুজনের বিতর্কের মাঝে সুনিতা নির্বাক দর্শক।
একটু থেমে অপূর্ব আমার দিকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোনদিন মড়া পুড়িয়েছিস। পুড়ে গেলে হাড় কি
রকম হয় দেখেছিস?
আমি অপূর্বর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মড়া পোড়ানো দেখেছি। কিন্তু ওসবের ব্যাপারে
আমি খুঁটিনাটি জানি না, এসব জানতেও ভালো লাগে না!
অপূর্ব কনফিডেন্টলি ঘোষণা করলো, ‘এটা কোন লোকের অর্ধদদ্ধ
হাড়!’
সুনীতা আঁতকে উঠলো, উঁচু গলায় চীৎকার করে বলে
উঠলো-
‘বীভৎস!’
‘বীভৎস’ কথাটা সেই টিম টিমে লন্ঠনের আলোয় কেঁপে কেঁপে উঠলো। শব্দটা ঘরের রং-চটা রান্নাঘরের
পুরোনো দেয়ালে ধাক্কা খেলো। অবশেষে সেই শব্দটা আমাদের তিনটে মানুষের চারপাশে
ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো।
‘এটা দেবু’দার হাড় হলেও হতে পারে। কে বলতে পারে এটা সেই হাড়
নয়? দেবব্রত দাশরায়! সেই পনেরো বছর আগেকার
কথা
……’।
ধীরে
ধীরে নিশি লাগা মানুষের মতো হাল্কা স্বরে অপূর্ব কথাগুলো বলে গেলো।
আমি বলে উঠলাম, ‘কি আলফাল বকছিস?’
‘অমর! এই হাড়টা কিভাবে কয়লার মধ্যে এসেছে সেটা সম্পর্কে
তোর সন্দেহ থাকতেই পারে! কিন্তু ঘটনাটা আল্ফাল্ ছিল না। সেটা উনিশশো-উনসত্তর সালের একটা
দিন।’
আমরা তিনজনে হাত ধুয়ে নিলাম। রান্নঘর ছেড়ে ভিতরের ঘরে
এসে বসলাম।
এরই
মধ্যে সুনীতা স্টোভ জ্বালিয়ে তডিঘড়ি আমাদের জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে এলো। চায়ে চুমুক দিতে
দিতে অপূর্ব বলতে শুরু করলো।
# অপূর্ব #
অনেক বছর আগেকার
একটা বিকেল।
সেটা
উনিশশো উনসত্তর সাল হবে। তোরা তো জানিস, সেই সময়টা রক্তে মাটি ভিজে
যাওয়ার দিন!
চোরা
গোপ্তা দেয়াল পোস্টার লেখা হচ্ছে। সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন। যুবকেরা এদিক ওদিক
পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
আমিও
তখন স্বপ্ন-দেখা সময়ের সঙ্গে
সঙ্গে আকাশে উড়ছি।
সে সময়ে নানা পরিকল্পনা চলছে। এদিক ওদিকে গনসংগঠন করতে
হবে।
জোতদারের
জমি দখল হবে।
জমিদারদের
জমির ধান কেটে নেয়া হবে। গ্রামে গ্রামে ডিফেন্স কমিটি তৈরী করতে হবে। অ্যাকশন করে জোতদারের
গোলায় ওঠা ধান কেড়ে নিয়ে হবে। বাজেয়াপ্ত হওয়া ধান গরীর ভূমিহীন গ্রামবাসীদের মধ্যে
বিলি করে দিতে হবে।
আদিবাসী-গ্রামের নির্জন পাড়ায়, গাছপালা ঘেরা একটা
মাঠের মধ্যে হ্যারিকেনের আলোয় আমাদের একটা জরুরী মিটিং চলছিল। রাত্তির তখন আটটা কি ন’টা হবে।
হঠাৎ জোতদারের গুন্ডারা
আমাদের দলটাকে অ্যাটাক করলো। আমরা বুঝতেই পারি নি, কি করে ওরা এই মিটিংটার
খবর পেয়েছিল!
আমাদের কাছেও কিছু দিশি অস্ত্রও ছিল। স্থানীয় কয়েকজন লোকের সাথে
ছিল তীরধনুক।
আত্মরক্ষার
জন্যে আমরাও এনকাউন্টার করলাম।
শেষ পর্যন্ত বুঝলো; আমাদের সঙ্গে পেরে উঠবে
না।
তাই
ওরা ভয়ে পালালো।
কিন্তু
পালানোর আগেও ওদের এলোপাথারি বন্দুকের গুলিতে আমাদের একজন মাটিতে পড়ে গেল। আমরা শুনতে পেলাম
একটা আর্তনাদ-
‘মাআআগোওও …… !’ প্রথমে অন্ধকারে
বুঝে উঠতে পারি নি- কে পড়েছে? অরুণ, বিমল, বাচ্চু, না কমলেশ?
গুন্ডাগুলো পালিয়ে যেতেই টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম, ঝোপের দিকে যে শরীরটা
পড়ে আছে,
সে
আমাদের দেবুদা!
দেবব্রত
দাশরায়!
বুক
থেকে গল গল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। কয়েকটা বুলেট ওনার বুকটাকে এফোড় ওফোড় করে দিয়েছে। ততক্ষণে সবই শেষ! আমরা পরীক্ষা করে
দেখলাম,
নাড়ীর স্পন্দন থেমে গেছে, শরীরের স্বাভাবিক
উত্তাপ যেন ঠান্ডা হতে শুরু করেছে।
তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে হবে। জোতদারের লোকেরা যে কোন
সময়েই আবার আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
সব শেষ। আমরা বুঝলাম, দেবুদাকে আর বাঁচানো
গেল না।
কিন্তু
ওর শরীরটাকে তো এখানে এভাবে ফেলে রাখা যাবে না।
অগত্যা চারজন মিলে দেহটাকে কাঁধে তুলে আমরা পালাতে লাগলাম। রাত্তিরের জনশূন্য
মাঠ।
কোথাও
কোথাও বেওয়ারিশ কুত্তাগুলো আমাদের দেখে চেঁচাতে লাগলো। সে এক ভয়ঙ্কর অভিযান! দু’একটা জায়গায় একটু থামলাম। এমনিতে রাতে এখানে রাস্তায় লোকজন নেই। তবুও আমাদের ভয়, যে কোন মুহূর্তেই আমরা আবার আক্রান্ত হতে পারি! বুকে দমবন্ধ উত্তেজনা!
এমনি
ভাবে আমরা তিন-
চার
মাইল এগিয়ে এলাম।
সামনেই
ছোট্ট একটা গ্রামে।
আমাদের
দলের পরাণদের গ্রাম। এই অঞ্চলটাকে ও চেনে।
রাত্রির রাস্তা ধরে আমরা হেঁটে চলেছি। আমাদের দলের মধ্যে মেডিকেল
কলেজের ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র কমলেশ। ও বললো, ‘একটা ডেড বডি এভাবে
কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া খুব মুস্কিলের। আমরাও ধরা পরে যেতে পারি! এর একটা ব্যবস্থা
করতে হবে।’
উত্তরে পরাণ কিছু বলতে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই অনেক দূরে গাড়ির
আওয়াজের মতো ক্ষীণ একটা শব্দ। দূরে সার্চলাইটের হাল্কা আলো। বাচ্চু ব্যাপারটা
আন্দাজ করে বললো, ‘সাবধান…… পেছনে কোন দূরে
কোথাও গাড়ি আওয়াজ। রাস্তার পাশে ঝোপে লুকিয়ে
পড়ো। জঙ্গলে তাড়াতাড়ি গা ঢাকা দাও!’
আবার কি এক প্রস্থ গোলাগুলি চলবে? আমরা নিমেষেই দেবুদার
শরীরটা একটা ঝোপের আড়ালে শুইয়ে দিলাম। পুরো দলটাই খুব তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশের
জঙ্গল,
বড়ো
বড়ো গাছ গাছালির মধ্যে আত্মগোপন করলাম। টহল দিতে বেরোনো মিলিটারিদের জীপগাড়িটা রাতের নির্জনতাকে
সশব্দে কাঁপিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। না, এটা ওদের হয়তো কোন রুটিন
ডিউটি!
মিলিটারি-জীপগাড়িটা চলে যাবার
মিনিট দশেক বাদে আমরা সবাই জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম। দেবুদার দেহটাকে আবার কাঁধে ঝুলিয়ে সামনে এগোতে লাগলাম।
পরাণ এ অঞ্চলের মানুষ। ও বললো, ‘আরো মাইল চারেক
গেলেই একটা শশ্মান গোছের মাঠ আছে। ওখানেই আমরা দেবুদার সৎকার করতে পারি।’
আমাদের দলেরই একজন বললো, ‘এতদূর দেবুদার মরা
শরীরটা টেনে নিয়ে যাওয়া খুবই বিপদজনক, …… তার চাইতে বরং বডিটাকে নদীর
মধ্যে ফেলে দিয়ে আমরা পালাই?’
অনেকেই এতে আপত্তি জানালো। শেষপর্যন্ত বিপদের ঝুঁকি
নিয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, দেবুদার শরীরটাকে সসম্মানে সৎকার করতেই হবে। কিন্তু এবার আমরা
গায়ের প্রধান সড়ক অনুসরণ না করে কিছুটা ঘুরপথে সামনে এগোতে লাগলাম। শুনশান মাঠ। রাতের ঝিঁঝি পোকা, বেওয়ারিশ কুত্তার
ডাক।
পরাণ
আমাদের রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।
আরো ঘন্টা দুয়েক হেঁটে আমরা শ্মশানে পৌঁছালাম। আসলে শ্মশান মানে
একটা খোলা মাঠ।
গ্রামের
লোকেরা কখনো সখনো এখানে মড়া পোড়ায়। কাছেই একটা বড়ো দীঘি। খোলা মাঠটার পাশে দু’তিনটে মাত্র ঝোপড়ি। কয়েকটা পরিবারের
বাস।
ওরা
টাকা পেলে কখনো সখনো মড়া পোড়ায়, আবার কখনো বা জমি জিরেতে মাটি কাটে, আগাছা নিড়ানির কাজ
করে।
বাড়ীর
মেয়েরা বাঁশ দিয়ে ঝুড়ি, ধামা বোনে। শুনলাম, এখান থেকে কিছুটা
দূরে নদী,
তার
পাড়ে ভগ্নপ্রায় একটা কালীমন্দির, আরো কয়েকঘর জনবসতি সেখানেও আছে।
পরাণের তৎপরতায় খোলা মাঠের এই শ্মশানে এত রাতেও সব কিছুরই ব্যবস্থা
হয়ে গেল। ওখানকার ঝোপড়ির জনাদুয়েক লোক জ্বালানী কাঠের ব্যবস্থা করে দিল।
রাত তখন তিনটে। দেবুদাকে চিতায় শুইয়ে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই
আগুনের শিখারা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো।
আমরা দেবুদার চারপাশ ঘিরে ‘ইন্টারন্যাশানালের
গান’
গাইলাম।
পুড়তে পুড়তে দেবুদার দেহটা কুকড়ে যেতে লাগলো। ধোঁয়া ওড়া সময়ে
আমাদের অরুণ কি সব বকবক করছিল, ওর স্মৃতিচারণাগুলো ধোঁয়ার সাথে বাতাসে উড়ছিল। আমরা অ্যানালিসিস করার চেষ্টা
করতে লাগলাম,
গুণ্ডাগুলো
এমনি করে আচমকা কেন আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল?
পরাণ বলল,- ‘জোতদার শালাদের চক্রান্ত, ওরা নিশ্চয়ই খবর
পেয়েছিল,
এ
বছরেও ধানের জমি লুট হবে! এই চক্রান্তের সঙ্গে ভাটিখানার মালিক মদন সাহুও আছে। কেন তোমরা এ অঞ্চলে
মানুষদের দারু,
দিশি
মদ খাওয়া ছাড়াচ্ছিলে? জোতদার, জমিদার, ভাটিখানার মালিক
কেউই চায় না,
এখানে
গ্রামে গ্রামে কৃষক সভা হোক, লোকেরা জোট বাঁধুক বা ডিফেন্স-কমিটি গঠিত হোক!’
বাচ্চু খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বড় একটা ডান্ডা দিয়ে শবটাকে মাঝ আগুনে
ঠেলে দিচ্ছিল।
ভোর
তখন পাঁচটা।
হঠাৎ আমরা আবার সবাই একসঙ্গে চমকে উঠলাম। আবার শুনতে পেলাম কোন গাড়ীর যান্ত্রিক আওয়াজ। সেটা ক্রমশ এদিকেই
এগিয়ে আসছে।
কমলেশ
চেঁচিয়ে বলে উঠলো, - ‘নির্ঘাত পুলিশের গাড়ী! এক্ষুনি পালাও। শালারা মনে হচ্ছে
খবর পেয়ে গেছে।’
আমার কাছাকাছি পরাণ ছিলো। ও গ্রামের লোকগুলোকে বুঝিয়ে
দিল,
পুলিশ
এসে যদি জিজ্ঞেস করে ওদের বলবি ‘গতকাল রাতেই একদল লোক শ্মশানে দাহ করতে এসেছিল, মড়া পুড়িয়ে সবাই
চলে গেছে।’ যদি জানতে চায়, তবে বলবি – ওই লোকগুলোকে
তোরা চিনি না, কোথায় থাকে তাও তোরা
কিছু জানি না। কি বুঝলি তো। ওরা সহজ সরল মানুষ, নির্দ্বিধায় মাথা ঝাকালো।
হাতে খুব অল্প সময়। আমরা সবাই নিমেষেই অদৃশ্য হয়ে গেলাম। যে যেদিকে পারলো। আমাদের কয়েকজন ওদের
ঝোপড়িগুলোর আড়ালে ঝোপঝাড়ে আত্মগোপন করলো। আমি ও পরাণ ধরা না পড়ার জন্যে দীঘির জলে ঝাঁপিয়ে
পড়লাম।
অল্প সময়ের মধ্যেই একটা গাড়ি হাজির, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, কৌতূহলবশতঃ কয়েকজন
পুলিশ গাড়ী থেকে নেমে এলো। ওরা শ্মশান গোছের মাঠটা একটু নিরীক্ষণ করলো। তখন আমি আর পরাণ
দীঘিতে। আমার চারপাশে শ্যাওলা আর কচুরিপানা, দীঘিটার কিনারে
জলের ভেতরে শরীরটা কোনমতে ডুবিয়ে আমরা দুজন পাশাপাশি বসে রইলাম। জলের উপর নাকটা
শুধু জেগে রইলো।
পুলিশের
জোরালো টর্চের আলো আমাদের আশপাশ ঘুরে গেল। আমরা সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
পুলিশের লোকেরা
গ্রামের লোকদুটোর সঙ্গে সামান্য কিছু কথা বললো। গ্রামবাসীরা ওদের কিছু বলল, ওরা কি বুঝলো কে
জানে?
মনে
হয় পুলিশদলটার কোন আর্জেন্ট কল ছিল, গাড়ী যে পথ ধরে এসেছিল, সেপথ ধরেই ওরা সামনে
এগিয়ে গেল।
আমরা দুজন তাও আরো কিছুক্ষণ যেমনি ছিলাম, জলে আত্মগোপন করে
রইলাম।
পরে
নিশ্চিত হলাম,
পুলিশের
গাড়ী আর ফেরৎ আসছে না। আমি আর পরাণ জল থেকে উঠে এলাম। বাকী এদিক ওদিক যারা লুকিয়েছিল, তারাও ততক্ষণে বেরিয়ে
এসে গেছে।
ভোর
হয়ে আসছে।
ঝোপড়ির
আরো কয়েকটা নতুন মুখ দেখা গেল।
পরাণ বললো,-‘চলো, আমরা দেবুদা’কে শেষ প্রণাম জানিয়ে
আসি।’
পরাণ আর আমি নিঃসাড়ে প্রায় নিভে যাওয়া চিতার কাছে এগিয়ে গেলাম। দেবুদার নিভন্ত
চিতার কাছে তখন আর কেউ নেই। দুটো বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে মাটির হাড়িতে করে চিতায়
জল ঢালছে। আমাদের দেখে হাড়ি ফেলে রেখে ছেলেদুটো ভয়ে পিছিয়ে গেলো।
পরাণ সস্নেহে ওদের ডাকলো,- ‘এই শোন, ডরাস্ ক্যান? ইদিক আয়। আমরা ভালো লুক!’
পরাণের কথায় কিশোর ছেলেদুটো আশ্বাস পেলো। ওরা ধীরে ধীরে পরাণের
কাছে এগিয়ে এলো।
বড় ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো,-‘তুমরা পুলিশের লুক
লও তো?’
পরাণ হাসলো - ‘না। তুরা দেখলি? পুলিশের গাড়ি কুন
দিকে গ্যাছে?’
ছোট ছেলেটা আঙ্গুল তুলে দূর রাস্তার দিকটা দেখিয়ে দিল। ওরা দু’জন নিশ্চিত হয়ে
পাশের ডোবা থেকে আবার হাড়িতে করে জল এনে চিতায় টালতে লাগল। জল পেয়ে উত্তপ্ত চিতা ফুস
ফুস করে উঠলো।
দেখলাম, চিতার একপাশে ছিটকে এসেছে না পোড়া শরীরের ছোট্ট কয়েক
টুকরো হাড়।
দেবুদার-! মানে পুরো হাড়গোড়
শেষ পর্যন্ত পোড়ে নি।
পরাণ আমার হাত টিপলো। জলদি আমাদের সবাইকে এখান থেকে ভাগতে হবে।
শেষ মেষ আমি ছেলে দুটোকে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না ,- ‘আগুনে জল ঢালছিস
কেন?
জল
ঢালতে কে বলেছে?’
বড় ছেলেটা উত্তর দিল, ‘আগ জ্বালাবার কোয়লা
হবেক,
কাঠ
কোয়লা।’
ছোট
ছেলেটা ঠান্ডা হওয়া পোড়া কাঠগুলোকে একপাশে জড়ো করছিল, হয়তো ঘরে নিয়ে যাবে।
# সুনীতা #
অপূর্ব থামলো।
সমস্ত কাহিনীটার ততটা গুরুত্ব না দিয়ে সুনীতা বলে উঠলো,- ‘তার মানে আপনি বলতে
চাইছেন,
এগুলো
মড়া পোড়ানো শ্মশানের কাঠকয়লা!’
অপূর্ব উত্তর দিল, ‘না, আমি ঠিক তা বলি
নি।’
সুনীতা বলে উঠলো,-‘সে যাই হোক, বলে রাখছি, আমি আজ উনোন ধরাতে
পারবো না।’
অপূর্ব সস্নেহে বললো, ‘সুনীতা, ভয় পাচ্ছো কেন? তুমি আগুন না জ্বালালে, আমিই জ্বালাবো। কাঠকয়লার স্তুপের
ভেতরে একটা আধাপোড়া হাড় খুঁজে পাওয়া গেল কিনা, তাতে কিছু আসে যায়
না।
আর
এটাও প্রমান হয় না, কাঠ কয়লাগুলো চিতার থেকে তুলে আনা। আসলে ঘটনাটার সঙ্গে একটা
স্মৃতি জড়িয়ে ছিল কিনা- !’
সুনীতা আদুরে গলায় বললো, ‘অপূর্বদা, কাঠ কয়লার মধ্যে
খুঁজে পাওয়া একটা হাড় নিয়ে যে গল্প শোনালেন – আপনি উনোন জ্বেলে দিলেও, এখন মনে হচ্ছে, আমি রান্না করতে
পারবো না’।
কেরোসিন ল্যাম্পের আলোয় মেয়েটা এক নজরে অপূর্বর মুখটাকে দেখতে
লাগলো।
সুনীতার
কাছে এ এক অন্য,
অপরিচিত
অপূর্ব!
ওর
নীরব চেহারার মধ্যে যে এমন এক রোমাঞ্চকর অতীত লুকিয়ে ছিল তা সুনীতার কাছে অজানা। যদিও কলেজের বন্ধু
হবার সুবাদে আমি অপূর্বর এ সব কাহিনীর পুরোটা না হলেও, কিছু কিছু জানতাম।
সুনীতা এবার উনোন জ্বালাতে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো। হাতে দেশলাই আর
কেরোসিনের ল্যাম্প।
অপূর্বও
ওর পেছন পেছন গেলো।
কাঠকয়লার
গাদা থেকে পোড়া হাড়টাকে দু আঙ্গুলে তুলে সীমানার পাঁচিলের বাইরে ঝোপ জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেললো।
সুনীতা অপূর্বকে কিছু একটা প্রশ্ন করেছিল। শুনতে পাই নি।
আমি তখনো খাটিয়ায় বসেই ছিলাম। শুনতে পেলাম অপূর্বর উত্তরটা, ‘দেবুদা তো স্বার্থপর
মানুষ ছিলেন না।
তিনি
মরে গিয়েও কিছু মানুষের জন্যে সামান্য জ্বালানীর ব্যবস্থা রেখে গিয়েছিলেন – এতে আপত্তির কি
থাকতে পারে?’
মনে পড়লো, আমাদের কলেজের রাস্তার পাশে দেয়ালগুলোতে আলকাতরায়
লেখা সত্তর দশকের স্লোগানগুলো। সাদা রঙের চুনকামের নীচে সে সব লেখা বহু বছর আগেই
চাপা পড়ে গেছিলো।
অপূর্বর
আজকের উপস্থিতিতে মনে হলো, দেয়ালের চুনকাম ভেদ করে আলকাতরার সেইসব লেখাগুলো
অন্ধকার আকাশের গায়ে এখনোও লেপ্টে আছে।
সুনীতা উনোনের কাঠকয়লার তখন সত্যি সত্যিই আগুন জ্বালাচ্ছে।
[ গল্পগ্রন্থ
– ফুফুর কফিন ]
2431 words
Comments
Post a Comment