দোস্ত, বেঁচে থাকার এই তো সময় !
দোস্ত, বেঁচে থাকার এই
তো সময় !
সমরেন্দ্র বিশ্বাস
#
ঝড়ের মুখে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে! ঝড় এসেছে, ঝড় আসছে- ঝড়!
ফেস্টুনটাকে ভাগাতে ভাগেতে
তেড়ে আসছে ‘ধ্বংস করো’ তীব্র হাওয়া
বিপন্ন সময় মানুষদেরকে ঘাড়ে
ধরে শিখিয়ে নিচ্ছে – কি করে বেঁচে থাকতে হয়!
- এ সময়ে উচিত আমাদের
মাথাগুলোকে সিধা রাখা!
#
সমুদ্র থেকে তেড়ে আসছে জলস্রোত
চরাচর ভাসিয়ে নিচ্ছে সুনামি, ভেসে আসছে অনেকগুলো
লাশ!
চোখের সামনে এইমাত্র দেখলাম
একটা মানুষ আঁকড়ে ধরে আছে টুকরো কাঠ -
সে বাঁচতে চায়, হয়তো বেঁচেও যাবে
দোস্ত, এ সময় দরকার হিম্মতকে
ধরে রাখা।
#
ধ্বংসের ইতিহাস খুঁজতে এই
তো আমি পাগলা ঘোড়ার পিঠে চেপে
ঢুকে পড়েছি অন্ধকারাচ্ছন্ন
অতীতে!
হোয়ংহো, ইয়াং-সিকিয়াং নদীর দুকূল
ছাপিয়ে উঠে আসছে বন্যা,
নিখোঁজ মৃতদেহগুলোর শোকে
হাহাকার করছে অসংখ্য নরনারী।
আমাদের চোখের সামনেই তারপরও
নতুন করে ঘর বাঁধছে চীনের সভ্যতা,
মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে লংমার্চের
পথে!
ওই দেশেরই অভ্যন্তরে জামার
হাতের নীচে থাবা ও নখ লুকিয়ে
এইমাত্র হেঁটে গেল একদল
কর্পোরেট দালাল!
দোস্ত, মাথা ঠান্ডা রাখার
এই তো সময়।
#
একটু আগেই আরেকটা ঝড় উঠেছিল,
তাতে দাউ দাউ করে জ্বলে
যাচ্ছে আমাদের ঘর বাড়ি
হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে
সেই আগুন।
এই ঝড়ের দাপটেই হিন্দু মুসলমানের
ঘর্মাক্ত রক্তবীজ বুকে
ভেসে যাচ্ছে নদীর নাস্তিক
শ্যাওলা!
দেখতে পাচ্ছি, আত্মীয় স্বজনদের
হারিয়ে
আমার বাবার কৈশোর একা একা
হেঁটে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে দেশান্তরের দিকে!
এমন ভাঙ্গনের দিনে আমি কি
খোলা তলোয়ার হাতে
বরিশালের রাস্তায় রাস্তায়
দৌড়ে বেড়াবো?
দোস্ত, এমন সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গার দিনে
মাথাগুলো ঠান্ডা রাখা খুবই জরুরী।
#
গাজা স্ট্রিপ আর ইজরায়েলের
সীমান্তে দাঁড়িয়ে
আমি দেখছি মাথার উপর দিয়ে
ভেসে আসছে বোমারু বিমান,
বিস্ফোরণে ভেঙ্গে যাচ্ছে
আমার বসত বাড়ি,
শেরেউক
টাওয়ার
যুদ্ধ, যুদ্ধ আর যুদ্ধ - আকাশে এরোপ্লেনের হানাগোনা, সাইরেণের সূচালো
শব্দ
ধূলো, আগুন আর তীব্র উত্তাপে
ভেসে যাচ্ছে চারদিক।
ইহুদী, জিউস, মুসলমান, খৃষ্টান ইত্যাদি
শব্দগুলো
মাছির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে
এক একটা শবদেহের মুখে!
দোস্ত, উন্মাদ হওয়া নয়, আত্মঘাতী এরকম লড়াইয়ের
দিনে
ঠান্ডা মাথায় পৃথিবীটাকে
অক্ষত এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এ দুনিয়ার
দায়।
#
আদিগন্ত বিপর্যয়ের মধ্যে
আমি এখন হেঁটে আসছি অদৃশ্য
ভাইরাসের উত্তাল ঢেউগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে!
জানি না, শেষ পর্যন্ত শুকনো
ডাঙায় উঠতে আরো কতটা সময়?
সামনে বন্ধ হয়ে আসা হাসপাতালের
দরোজা
অসহায় মানুষদের আর্ত চিৎকার,
আমরা কি ভুলে গেছি, দুঃসময়ে কি করে
বাড়িয়ে দিতে হয় নিজেদের এ দুটো হাত?
এই মাত্র আমি ফিরে এসেছি
আমার জন্ম মুহূর্তে
আমার ধাইমা রোগা রোগা দুটো
হাতে আমাকে চেনাচ্ছে পৃথিবীর প্রথম আলো,
আমাদের পড়োশী ধাইমার দুটো
হাতই খুব লম্বা আর প্রলম্বিত!
এই পৃথিবীতে যারা মানুষদের
প্রথম আলো দেখিয়েছে,
তাদের হাতগুলো হয় আকাশের
মতো উঁচু,
সে
সব হাতগুলোই পারে
আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা
ঝড় আর ঝঞ্ঝাগুলো থেকে মানুষদের বাঁচাতে!
তাহলে জামার আস্তিনে ঢাকা
আমাদের হাতগুলো আজকাল কেন ছোট্ট হয়ে আসছে?
#
খরা দুর্দিনে এক্ষুনি হাহাকার
উঠলো মন্বন্তরের!
উন্নিশো চেতাল্লিশ ছুঁয়ে
আমি হেঁটে যাচ্ছি অনাহার কবলিত মৃত বাংলার ফুটপাথে
ভিক্ষার বাটি হাতে মানুষেরা
দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে – ‘ফ্যান, মাগো, ফ্যান দাও’!
কয়েক লক্ষ কঙ্কাল নিজের
শরীরে জড়িয়ে
সেইসব দিনগুলোকে পেরিয়ে
এই তো আমি এখনো নিদারুন বেঁচে আছি!
#
কুহেলিকার অর্থ খুঁজতে পাগলা
ঘোড়ার পিঠে এই তো আমি বসে আছি
আয়লায় বীভৎসতাকে চিনতে এই
তো আমি এসে দাঁড়িয়েছি সুন্দরবনের বদ্বীপে
বিপন্নতার ইতিহাসকে বুঝতে
এই তো আমি ফিরে এসেছি থরো থরো ভূমিকম্পে,
থমকে যাওয়া হরপ্পার অতীত
ফাটলে ছুঁয়ে এই তো আমি আজও আশ্চর্য বেঁচে আছি।
#
এই মাত্র আমি শুয়ে পড়েছি
জওহরলাল হাসপাতালের চব্বিশ নম্বর বেডে,
শুনতে পাচ্ছি কতগুলো অশরীরি
মৃত্যু-হুঙ্কার
চারদিক থেকে উঠে আসছে চোখ
বন্ধ করা দামাল হাওয়া,
ঠিক তখনি এগিয়ে এলো হাসপাতাল
কর্মীদের অনেকগুলো দস্তানা-পরা সাদা হাত।
কয়েকদিন পরে জ্ঞান ফিরলো, আমি দেখতে পাচ্ছি
হাসপাতালের জানালায় অনেকগুলো
পাখী ডাকছে,
ঝড়
থেমে গেছে!
#
একটা শূণ্যতার চোখ নিয়ে
আম্ফান আবার তেড়ে আসছে এই ভূখন্ডে,
অনেকগুলো সমস্যার-ঘূর্ণাবর্ত আজকেই তেড়ে আসছে এই
পৃথিবীতে
ওরা তেড়ে আসছে ইউ এন ও-র অফিসে, বিপন্ন পরিবেশের
বিধ্বস্ত দলিল-নামায়!
নিম্নচাপগুলো তেড়ে আসছে
বিশ্বায়ণের পাগল উল্লাসে, বাণিজ্যচুক্তির হাহাকারে,
আরেকটা ঝড়ের গতিপথ আজকেই তেড়ে আসছে কৃষকদের ধর্ণা-সমাবেশে,
নিম্নচাপ দাপিয়ে মারছে বন্ধ
কারখানাগুলোর গেট আর পরিযায়ী জনস্রোত!
এরকম একেকটা ঝড় আমাদেরকে
শিখিয়ে যাচ্ছে
-
কি করে এবড়ো খেবড়ো রাস্তা
ধরে মানুষেরা হেঁটে যায়
কি ভাবে হাতে হাত ধরে প্রত্যেক
দিনই সবাইকে পেরোতে হয় মৃত্যুর লেভেল ক্রসিং!
#
আজ মায়নামারের এক ঘূর্ণির
রাতে জেগে থাকতে থাকতে যখন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি,
ঠিক তখনই গাঢ় অন্ধকারে স্বপ্ন
দেখিয়ে কেউ আমাকে একটা ই-মেল পাঠালো -
তাতে আছে একটা ছোট্ট সংকেত! আর আছে দুনিয়ার পুরোণো সমীকরণগুলোকে ডিলিট করে
নতুন ইকোয়েশন লিখে ফেলবার
গোপন চিঠি!
কি করে সমীকরণগুলোকে সাজাতে
হবে বুঝতে না পেরে
এইসব লন্ডভণ্ড করা জল-হাওয়ার মধ্যেই আমি
বেরিয়ে এসেছি ঘরের বাইরে!
ছুটতে ছুটতে দেখতে পাচ্ছি
চারপাশের এই অব্যবস্থা
- যার কিছু কিছু প্রাকৃতিক, এই যে অব্যবস্থা
তার অনেকটাই সামাজিক!
এ সময় দরকার ঝড় নির্ণায়ক
রাডার আর সঙ্কেত পড়ে নেয়ার মতো বোধবুদ্ধি!
আদিগন্ত ঝড়ের মধ্যে পাগলের
মতো ছুটতে ছুটতে বুঝতে পাচ্ছি
এখন এইসব ভয়ংকর দিনে মানুষদের
দরকার কিছু বোধিসত্ত্ব সক্রিয়তা,
তাই তো বলছি দোস্ত,
নিজের মস্তিষ্কটাকে ওই ঝড়ে ভাসা বুড়ো মানুষটার মতো স্থির রাখো।
#
ঐ তো ঝড়ের মধ্যে তোলপাড়
হচ্ছে বুড়ো মানুষটার ডিঙি নৌকো!
ওল্ড ম্যান আর্নেষ্ট হেমিংওয়ের
সমুদ্রে প্রচন্ড তোলপাড় -
বৃদ্ধটি প্রচন্ড বিশ্বাসে
আঁকড়ে ধরে আছে তার জেলে ডিঙি!
আমি হেমিংওয়ের নৌকায় বসে
আছি
জানি, দাঁতালো হাঙরগুলোর
মুখগহ্বরে থুথু ছিঁটিয়ে মানুষটি ঘরে ফিরে আসবেই।
সময়ের সামনে তোলপাড় হচ্ছে
সমুদ্রের ভয়ংকর ঢেউ,
মুখ হাঁ করে দাঁত দেখাচ্ছে
জান্তব কিছু মনুষ্যত্ব!
দোস্ত, এ দিনগুলোয় দরকার নিজেদের মাথাগুলোকে মানবিক রাখা।
#
আজকে ভয়ংকর জল ঝড়ের দিন। উঁচু একটা টিলার
উপর দুর্গত মানুষেরা জড়ো হচ্ছে!
একটা লোক এক ব্যাগ ত্রাণ
নিয়ে হেঁটে আসছে, ছাতা মাথায় এক হাঁটু
জল আর জোঁক
;
এই তো দেখতে পাচ্ছি- তুমিও এক হাঁটু
জলে দাঁড়িয়ে জীবনবাহী শকটদের মোবাইল করছো,
বালির বস্তা আর নিজের শরীরগুলোকে
শুইয়ে দিয়ে সবাই ভাঙ্গা নদীর বাঁধ আটকাচ্ছে;
তোমাদের দিকেই আমি হেঁটে
আসছি,
যেমনি
সবাই এসেছিল বাষ্প আর বরফের যুগ পেরিয়ে।
#
এভাবেই মানুষদের চিরদিন
হেঁটে
আসা!
এইখানে সমুদ্র আছে, জীবনের অবিরাম অনিশ্চয়তা
আছে,
এখানেই
মারকুট্টে ঘূর্ণি আছে
এইখানে ধীমান বাতাসেরা মাথার
উপরে,
যদিও
বিশ্বাসঘাতকেরা আশেপাশেই টহল দিচ্ছে!
আমাদের পৃথিবীতে মৃত্যুর
পরে উঠে দাঁড়ানোর জন্যেও জীবন আছে!
দোস্ত, এ সময় দরকার মাথাটাকে
ঠান্ডা রাখা।
এ সময় দরকার হিম্মতগুলোকে জিইয়ে রাখা।
[ কাব্যগ্রন্থ – গ্যালিলিওর ছায়া / জানুয়ারী ২০২৩ ]
Comments
Post a Comment